পর্যটন: ‘স্বপ্ন কাজল মাখা’ সড়ক

মাসুদ নাসির :
পাহাড়ের বুক চিরে, সাপের মতো চলে গেছে এঁকেবেঁকে। দুই ধারে হৃদ, নীল জলরাশির সঙ্গে নির্মল হাওয়ার মিতালি। চলতে চলতেই মনের গহিনে বেজে উঠবে– ‘নীল আকাশের নিচেয় আমি/রাস্তা চলেছি একা/এই সবুজের শ্যামল মায়ায়/দৃষ্টি পড়েছে ঢাকা।’ বলছিলাম ‘কাপ্তাই-আসামবস্তি’ সড়কের কথা। একেবারে ছবি, যেন পটুয়া আপন হাতের স্পর্শে তাতে প্রাণ দিয়েছে! রাঙামাটির সঙ্গে পর্যটন উপজেলা কাপ্তাইয়ের সহজ যোগোযোগের সড়কটি গাজী মাজহারুল আনোয়ারের অমর গানের মতো ‘ডাক দিয়ে যায় কার দুটি চোখ/স্বপ্ন-কাজল মাখা।’
‘ধ্বংসযজ্ঞ’ থেকে ভালো কিছুর উদাহরণ কাপ্তাই-আসামবস্তি সড়ক। ২০১৭ সালের ১৩ জুন ভয়াবহ পাহাড়ধসে সড়কটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যোগাযোগ বিছিন্ন ছিল বহুদিন। গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হওয়ায় নতুন আঙ্গিকে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। তাতেই একটি সড়কে ফুটে ওঠে পর্যটনের মহিমা। অপূর্ব লেক পাহাড়, হ্রদের নীল জলরাশি, সবুজ উঁচুনিচু পাহাড়ের মিতালিতে নির্মাণশৈলী একাকার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সড়ক ঘিরে বাড়ছে পর্যটনের সম্ভাবনা। যানজট নেই। নেই কোনো ট্রাফিক ব্যবস্থা। আপন মনেই যাত্রীরা মুহূর্তে যেতে পারছেন গন্তব্যে। সড়ক ঘেঁষে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও মোহিত করেছে কিছু বেসরকারি নান্দনিক স্থাপনা। যার মধ্যে রয়েছে– বড়গাঙ, রাইন্যা টুগুন, বেরান্নে ও বাগী লেক ভ্যালি নামের কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র। ছুটির দিনগুলোতে এখানে পর্যটক ভিড় করছেন।
এ ছাড়া সড়কটি ধরে যেতেই মিলবে বৌদ্ধদের ধর্মীয় গুরু ও পরিনির্বাণপ্রাপ্ত মহাসাধক সাধনানন্দ মহাস্থবিরের (বনভান্তের) জন্মস্থানের স্মৃতি মন্দির। চোখকে শীতলতা দেবে পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের গ্রাম ও তাঁদের জীবনধারা। বৌদ্ধদের মন্দিরে প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে যেমন প্রার্থনার জন্য আসেন পুণ্যার্থী, তেমনি ভিড় করেন ভ্রমণপিয়াসী।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) রাঙামাটি সদর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, পাহাড় ধসে সড়কটিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরে আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই লেনে উন্নীতসহ এ সড়কে তিনটি নতুন সেতু করা হয়। চলতি মাসের মধ্যেই সড়কের কাজ সম্পূর্ণ শেষ হলে আরও আকর্ষণীয় হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
সড়কে নিয়মিত চলাচলকারী চন্দ্রঘোনা ক্রিশ্চিয়ান হাসপাতালের পরিচালক ডা. প্রবীর খিয়াং বলেন, ‘আসামবস্তি সড়ক দিয়ে রাঙামাটি যেতে সময় লাগছে তিন ভাগের এক ভাগ। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় বাড়ছে পর্যটক।’ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন ও শিক্ষার্থী মণি ত্রিপুরা জানান, সড়কটি ছবির মতো; তাঁদের যাতায়াতের কষ্ট কমে গেছে। মাত্র ৪৫ মিনিটে কাপ্তাই নতুন বাজার থেকে রাঙামাটি শহরে যেতে পারছেন।
আগে বিকল্প সড়কে যেখানে আড়াই ঘণ্টা লেগে যেত। রাঙামাটি ঘুরতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া জাহান বৃষ্টি বলেন, ‘সামাজিক মাধ্যমে সড়কটির ভিডিও দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বাস্তবে দেখে প্রেমে পড়ে গেছি। রাঙামাটি যাঁরা আসেন, একবার হলেও সড়কটি তাঁদের দেখা উচিত।’
কাপ্তাই উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মফিজুল হক বলেন, ‘রাঙামাটি জেলা শহরের সঙ্গে কাপ্তাইয়ের যোগাযোগ খুব সহজ করেছে আসামবস্তি সড়ক। দেশে এমন নান্দনিক সড়ক দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। পর্যটন অর্থনীতিতে দিন দিন সড়কটির গুরুত্ব বাড়ছে।’ সুত্র: সমকাল