সিলেট অঞ্চলে ‘এমপিও বিক্রি’ করেন তিনি
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
হবিগঞ্জ সদরের বেসরকারি পইল হাই স্কুলের শিক্ষক মো. নুরুল হুদা এমপিওভুক্ত হওয়ার আবেদন করেছিলেন প্রায় চার বছর আগে। তাঁর আবেদনটি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সিলেট অঞ্চলের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর কবির আহাম্মদ প্রথম দফায় বাতিল করে দেন। পরে আর্থিকভাবে ‘ম্যানেজ’ হয়ে একই ব্যক্তির আবেদন দ্বিতীয় দফায় অনুমোদন করেন। প্রথম দফায় এমপিওভুক্ত না করার কারণ হিসেবে নথিতে তিনি লেখেন– ‘নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলের বিবরণীতে কমিটির সদস্যদের ভিন্ন ভিন্ন তারিখে স্বাক্ষরের বিষয়টি যাচাই/ব্যাখ্যা প্রয়োজন।’ দ্বিতীয় দফায় ‘যাচাইকৃত ফলাফল বিবরণী ও স্বাক্ষরের তারিখ সঠিক হওয়ায়’ অনুমোদন করা হয় বলা হয়।
তবে সরকারি তদন্তে ধরা পড়েছে, প্রকৃতপক্ষে স্বাক্ষরের তারিখ সঠিক ছিল না। রেকর্ড যাচাইয়ে দেখা যায়, নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর। ফল শিটে মাউশির মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শেখ আলফাজ উদ্দিন ও হবিগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জিয়াউদ্দিন সই করেন তার এক মাস আগে ৩ সেপ্টেম্বর। তদন্ত কমিটি বলেছে, কীভাবে যাচাই করে ফল বিবরণী সঠিক হলো তার কোনো ব্যাখ্যা নথিতে নেই। তবে নিয়োগ বোর্ডের বাকি তিনজন ভিন্ন তারিখে কেন স্বাক্ষর করেছেন, এর কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে ফল বিবরণীর সংশোধিত আরেকটি কপি সরবরাহ করে ফাইল অনুমোদন করা হয়েছে। এতে প্রতীয়মান, নিয়োগ পরীক্ষায় সরকারি প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন না। সরকারি প্রতিনিধিরা উপস্থিত না থাকায় এই শিক্ষকের এমপিও আবেদনটি বাতিল করার কথা ছিল। তা না করে ফাইলটি উপপরিচালক অনুমোদন করেন। তদন্ত কমিটি মন্তব্য করেছে, নিয়োগ রেকর্ড যথাযথ না থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতির মাধ্যমে এমপিও আবেদনটি অনুমোদন করা হয়।
মাউশির সিলেট অঞ্চলের উপপরিচালকের বিরুদ্ধে ঘুষের বিনিময়ে বেসরকারি স্কুলের শত শত শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে সরকারি তদন্তেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ‘পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর’ (ডিআইএ) দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত ১৬ মে মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তিন সদস্যের এই তদন্ত দলের প্রধান ছিলেন ডিআইএর যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার। তদন্তে এই উপপরিচালকের কোটি কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতি ধরা পড়েছে। নিজ অফিসের বিভিন্ন কেনাকাটায়ও তিনি দু’হাতে অর্থ লুটেছেন। কেনাকাটার ক্ষেত্রে নথিতে আগে কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। তদন্তকালে মালপত্র কেনার সপক্ষে কোনো চাহিদাপত্র পাওয়া যায়নি। ক্রয়কৃত মালপত্রের কোনো এন্ট্রি স্টক রেজিস্টারে নেই। মালপত্র একসঙ্গে না কিনে খণ্ড খণ্ডভাবে কেনা দেখানো হয়েছে। মালপত্র বিক্রেতাকে টাকা পরিশোধ করা হলেও পরিশোধের সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রায় প্রতিটি কেনাকাটার ভাউচারে স্ট্যাপলার আর ক্যালকুলেটর কেনা হয়েছে দেখানো হলেও মালপত্র গ্রহণকারীর কোনো নাম নথিতে নেই। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
অবশ্য দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশের বাইরে থাকায় এসব বিষয়ে জাহাঙ্গীর কবির আহাম্মদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তাঁর ছুটিকালীন এই পদে রুটিন দায়িত্ব পালন করা সিলেট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ সমকালকে জানান, জাহাঙ্গীর কবির আহাম্মদ জুলাইয়ে দেশে ফিরবেন।
জানা গেছে, আগে মাউশির কেন্দ্রীয় কার্যালয় রাজধানীর শিক্ষাভবন থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে দেওয়া হলেও ২০১৪ সাল থেকে মাউশির ৯টি আঞ্চলিক অফিস থেকে এমপিওভুক্তি দেওয়া হচ্ছে। সিলেট বিভাগের চার জেলার সব বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক ও কর্মচারীকে এমপিওভুক্তির দায়িত্ব মাউশির সিলেট অঞ্চলের উপপরিচালকের। তিনি বিস্ময়করভাবে ২০১১ সাল থেকে টানা এই পদে আছেন। এর আগে তিনি মাউশির ময়মনসিংহ অঞ্চলের উপপরিচালক ছিলেন। দীর্ঘকাল এমপিওভুক্তির দায়িত্বে থেকে তিনি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মাঝে পরিচিতি পেয়েছেন ‘এমপিও বিক্রেতা’ হিসেবে। তাঁকে টাকা না দিয়ে সিলেট বিভাগের কোনো বেসরকারি শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে পারেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
অর্থের বিনিময়ে এমপিও বিক্রি
সুনামগঞ্জ সদরের পূর্ব পাগলা হাইস্কুলের পীযূষ কান্তি দেবের এমপিও আবেদন ‘সিএস (ফলাফল বিবরণী) কপিতে প্রদত্ত সদস্যদের স্বাক্ষরের তারিখ ঘষামাজা। সিএস যাচাই করতে হবে।’ এ কারণ দেখিয়ে বাতিল করেন উপপরিচালক জাহাঙ্গীর। পরবর্তী সময়ে নথিতে ‘সিএস ও নিয়োগ-সংক্রান্ত কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট ডিজি প্রতিনিধির প্রত্যয়নসহ উপস্থাপন করায় আবেদনটি অনুমোদন করা হয়।’ এই ব্যাখ্যায় তাঁর এমপিও আবেদন অনুমোদন করা হয়। ডিআইএর তদন্ত কমিটি বলছে, বাতিলের কারণ হিসেবে সিএস কপিতে নিয়োগ কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষরের তারিখ ঘষামাজা বলা হলেও ঘষামাজা কপিটি অপ্রদর্শিত। উপপরিচালকের সফটওয়্যার গ্যালারিতেও তা দেখা যায়নি। এমপিওভুক্তির আবেদনটি বাতিল করা হয় নিয়োগ কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষরের তারিখ ঘষামাজার কারণে। অথচ অনুমোদন করা হয়েছে ডিজি প্রতিনিধির উপস্থিতির প্রত্যয়নপত্রের মাধ্যমে। এতে প্রমাণিত হয়, দুর্নীতির মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ণ রেকর্ডকে সঠিক বলে ঘোষণা করা হয়। এমন আরও অনেক ঘটনা রয়েছে।
তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, তদন্তকালে বিভিন্ন তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করেছেন ওই কর্মকর্তা। এমনকি তথ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা দেননি। তথ্য না পাওয়া তাঁর আরও অনেক অনিয়ম তুলে আনা যায়নি বলে মনে করেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তাঁর এই দুঃসাহসের কারণে বিব্রতও তদন্ত কর্মকর্তারা।
তদন্তে দেখা গেছে, এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে সব ধরনের অনিয়মই করেছেন এই কর্মকর্তা। এমপিওভুক্তির যোগ্য নন, এমন ব্যক্তির এমপিওভুক্তির জন্য ফাইল অনুমোদন করেছেন। আবার নীতিমালা অনুযায়ী এমপিওভুক্তি প্রাপ্য এমন শিক্ষককে হয়রানি করেছেন। ফাইল ফেরত পাঠানো হয়েছে। টাকা না দিলে চার থেকে পাঁচবার পর্যন্ত একই ব্যক্তির ফাইল বাতিল করেছেন। সিলেটের সব জেলা ও উপজেলা কর্মকর্তারা সিন্ডিকেট করে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির কাজটি করছেন বলে তদন্তে উঠে আসে।
এ ছাড়া একই যোগ্যতা থাকার পর কাউকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে, আবার কাউকে এমপিওভুক্ত করা হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শচীন্দ্র কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক গৌতম সরকার সহকারী অধ্যাপক পদে এমপিওভুক্তির আবেদন করেন। সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং উপপরিচালক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হয়রানিমূলক আচরণ করে তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সহকারী অধ্যাপক স্কেল থেকে বঞ্চিত এবং সরকারি নির্দেশনা অমান্য করেছেন। এমনকি তাঁর বিপরীতে একই প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র শিক্ষকদের সহকারী অধ্যাপক স্কেলে এমপিওভুক্ত করে বিধিবহির্ভূত কাজ করেছেন বলছে তদন্ত কমিটি। সুত্র: সমকাল