ছুটিতে ভ্রমণ হোক কিলোরোড
নুর আলম, শাবিপ্রবি :
অনিন্দ্য সুন্দরের এক অনন্য মিলন মেলা,যা অবলোকন করতেই আঁখি দ্বয় ক্লান্তি পরশে ফিরে আসে, তবুও যেন নয়ন দুটি অতৃপ্তি বোধ করে।শুধু ক্ষুধামন্দাই ভাব জাগে, যে ক্ষুধা তোমার আঁচলে হারিয়ে যাওয়াতেই মেটে। কি অপরূপা! তোমার বুকে পায়ের আলতো ছোঁয়াতেই সেই রূপেই বাহারি দৃশ্যপটের মঞ্চে শুধু কাব্য-কবিতা-ই খেলা করে। পিচঢালা রাস্তা দ্বয়ের দুই পাশে জোড়া জোড়া সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে মেহগনি সহ হরেক রকমের গাছপালা। একপাশের গাছগুলো যেন আরেক পাশের গাছগুলোকে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে চুম্বন রূপে আলিঙ্গন করে নিচ্ছে। যা সূর্যমামার ক্ষোভের তীব্রতা থেকে রেহাই দিচ্ছে তার পথচারীদের। তবুও দিনদুপুরের কিছু রোদ্রকণা সবুজ পাতার ছাঁদকে ভেদ করে পিচঢালা রাস্তায় ডায়মন্ড কালারের পাথরকণা-তে প্রতিফলিত হচ্ছে , যা রাস্তার বুকে এক অনিন্দ্য চাকচিক্য, ঝিকমিক আলোকরশ্মি সৃষ্টি করে। সব মিলিয়ে আলোছায়ার সুন্দর চিত্র রচিত হয় এই রাস্তায়। বলছিলাম সৌন্দর্যের প্রতিমা হয়ে যুগের পর যুগ ধরে বিছিয়ে থাকা ‘কিলোরোড’ এর কথা।
দুধারে সুউচ্চ বৃক্ষের মায়াময় শীতল ছায়ায় প্লাবিত পিচঢালা রোডটি রয়েছে দেশসেরা অন্যতম বিদ্যাপীঠ সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থেকে গোল চত্বর পর্যন্ত বিস্তৃত। বলা হয়, মূল ফটক থেকে গোল চত্বর পর্যন্ত রোডটির দূরত্ব ১ কিলোমিটার দূরত্ব বলে এর নাম করণ করা হয়েছে “কিলোরোড”।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেট দিয়ে প্রবেশমুখে চোখে পড়ে দীর্ঘ দূরত্বের দুটি রাস্তা। বাম রাস্তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যানবাহন গুলো প্রবেশ করে, আর ডান রাস্তা দিয়ে যানবাহন গুলে বের হয়।
রাস্তার দুধারে সুউচ্চ ডানামেলা গাছগুলো যেন কিলোরোডটিকে মায়ার পরশে আলিঙ্গন করে আছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট শাখার সূত্রে জানা যায়, ১৯৯১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক ড. সদরুদ্দীন আহমেদ চৌধুরীর আমলে মো. সালিকুল রহমান চৌধুরী তত্বাবধানে এ গাছগুলো লাগানো হয়।
আজ বড় হওয়া সে গাছগুলো দেখলে যেন মনে হয়, গাছ আর রাস্তার মাঝে রূপকথা ভালবাসার কথোপকথন চলছে। সেই কথোপকথনের সুর-পথচারীর প্রতিটি পরতে কর্ণকুহরে বেজে ওঠে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে দুইপাশে দীর্ঘ লেক দুটি প্রবাহিত হয়েছে। এই লেকের বুকে গাছের ঝরা পাতা দ্বারা সৃষ্ট তরঙ্গ লেককে সুমিষ্ট হাসি হাসাচ্ছে।
দুই রাস্তার মাঝখানে দীর্ঘ সারিবদ্ধ ল্যামপোস্টের বাতির আলোক বর্ষণে গোধূলি থেকে সারা রাত অনন্য রূপ ধারণ করে মায়াময় এই “কিলোরোড”।
রাস্তার ছাউনি হয়ে থাকা বৃক্ষের ঝরা পাতার বৃষ্টি যখন পথচারীর গায়ে আলতো ছুঁয়ে দেয়,তখন মনে হয় এই বুঝি প্রকৃতির শরীরী খেলা। সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বিষয় হচ্ছে, গাছের চিরচিরে ঘন পাতা রাস্তায় মেলে ধরেছে এক লম্বা শামিয়ানা।
কিলোরোডের এতসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে কৃত্রিম সৌন্দর্য হয়ে স্থান করে নিয়েছে এক কিলোমিটার ওয়াকওয়ে। যেটি কিলোরোডের বাম পাশে দীর্ঘ এক কিলোমিটার লেকের তীর হয়ে মূল ফটক থেকে গোল চত্বর পর্যন্ত নির্মিত।
মূল ফটক থেকে ৮-১০ মিনিট হাঁটতেই চোখে পড়ে ডান দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনবদ্য সুবিশাল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। ঠিক তার বিপরীত পাশে ভিসির বাস ভবন ও গেস্ট হাউজ। আর একটু সামনে এগোলে দৃষ্টি পড়ে বৃহত্তর আইআইসিটি ভবন এবং সারিবদ্ধ নারিকেল বাগান। যেখানে শিক্ষার্থীদের আড্ডার জন্য পার্কের ন্যায় গুটিকয়েক বসার স্থাপনা রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ-আন্দোলন যেমন কিলো রোড ছাড়া প্রাণ পায় না, তেমনি ক্যাম্পাসের ভালোবাসাও প্রাণ পায় না কিলো রোড ব্যতীত। বন্ধু-বান্ধবীদের প্রণয় যুগল এই কিলো রোডের হাঁটার মাঝে যেন প্রাণ ফিরে পায়।কতই না বন্ধুত্বের রসায়ন ভাগাভাগি হয় আড্ডার চলে কিলো রোডের বুক মাঝারে। তেমনি আবার বিরহ-বিচ্ছেদের যন্ত্রণাও ভাগাভাগি করতে চায় রাতের নির্জন কিলো রোডের শূন্যতার মাঝে। সকল চাওয়া-পাওয়া গুলো যেন কিলোরোড ব্যতীত পূর্ণতায় পায় না।এই কিলো রোড হল বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ইতিহাস, ঐতিহ্য, সকল দাবি-দাওয়ার চাক্ষুষ সাক্ষী। এই কিলো রোড হাজারো প্রতিবাদী মিছিল, পুলিশের লাঠিচার্জ, নানা হক কথার হুংকারের স্মৃতি বিজড়িত মূহুর্তের জলন্ত মূর্তিমান প্রতীক।
এই নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আফসারা হোসাইন হিমা বলেন, এ সেই রাস্তা, যেটির দু-পাশের গাছ গুলো সকল সাস্টিয়ানদের সুখ,দুঃখকে ধারণ করে আছে। ধারণ করে আছে সাস্টের সকল রিক্সাওয়ালা,অটোওয়ালা মামাদের সোনালী অতীত। তাই আপনি একলা হাঁটেন বা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হাঁটেন, মনের আনন্দে হাঁটেন বা প্রেমিক যুগল হয়ে হাঁটেন। এই রাস্তা আপনাকে তার সৌন্দর্য ও অতীতে মন হারাতে বাধ্য করবে।
একই বিভাগের আরেক কিলোরোড প্রেমিক মোঃ সোলাইমান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, গাঢ় নীল আকাশ হারায় তার বিশালতায়
সমুদ্রের জলরাশি কলকল শব্দে হারায় দিগন্তে পাহাড় বুক উঁচু করে ছুঁতে চায় অন্তরীক্ষ প্রেমিক হৃদয় ভালোবাসায় হয় উদগ্রীব। তেমনি আমরা
সাস্টিয়ানরাও হারিয়ে যায় কিলোরোডের অপরূপ সৌন্দর্য্যের মাঝে। রৌদ্র কিংবা বৃষ্টি, গরম কিংবা শীত,জীবনের আনন্দঘন মুহূর্ত কিংবা থাকুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাজের চাপ। যখনি কিলোরোডে আসি, তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংস্পর্শে দূর হয় আমার যতসব গ্লানি। সবুজঘন পাতার নিচে এ যেনো ছোট্ট আরেক টুকরো আকাশ। দীর্ঘ এই কিলোরোড হাঁটতে হাঁটতে কখনো কখনো ক্লান্ত হয় আমার এ দেহ। কিন্তু, কখনও ক্লান্ত হয় না আমার এই মন।
দিনশেষে কিলোরোড নিয়ে কবির মন বলে, যেখানে প্রিয়জনের হাতের আঙুল ধরে হাঁটলে মনের আয়নায় ভেসে ওঠে স্বর্নালি কোন অতীত, গম্ভীর মনে জেগে ওঠে প্রেম, নিবার্ক শ্রোতা গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে গান। যেখানে বন্ধুদের সাথে হাঁটলে মনে হয়, ‘এই পথ যদি শেষ না হয়/ তবে কেমন হতো!