সিলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক
৩১৯ কোটি টাকার বিনিয়োগ পড়ে গেছে অর্থনৈতিক শঙ্কায়
সিলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কের নির্মাণ কাজ শুরুর পর প্রত্যাশা করা হয়েছিল ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের। দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করলে দেশের অর্থনীতিতে রাখত বড় অবদান। তবে চার বছরে ৩১৯ কোটি টাকা খরচের পরও শুরু হয়নি মূল কার্যক্রম। পার্কে বরাদ্দ পাওয়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এখনও স্থাপনা নির্মাণই শুরু করেনি। ১৮টি প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির মধ্যে কয়েকটি মাত্র স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেছে।
বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরখানেক আগে পার্কে স্থাপনা নির্মাণের পরিবেশ তৈরি হলেও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং বিনিয়োগের অর্থ ওঠা নিয়ে আশঙ্কায় অনেকে কাজ শুরু করছেন না। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে তাকিয়ে আছে। নানা শঙ্কায় একাধিক প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ স্থানও ছেড়ে দিয়েছে। অন্যরা আছেন দোটানায়। ঋণসহ অন্য সুবিধা না থাকায় আগ্রহ হারাচ্ছে তারা।
সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়কের বর্ণি এলাকায় ১৬২.৮৩ একর জমিতে ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছিল হাইটেক পার্কটির। ২০২২ সালে নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। তবে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও উৎপাদনে যেতে ২০২৬ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত লাগতে পারে। মাটি ভরাটসহ এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৩১৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি উদ্বোধন করার পর ১২টি প্রতিষ্ঠান ৭১.৩৯৯ একর জমি এবং ছয়টি প্রতিষ্ঠান ১৪ হাজার ৭৬০ বর্গফুট স্পেস ভাড়া নিয়েছে। তবে স্পেস ভাড়া দেওয়া ভবনগুলোর কাজই শুরু হয়নি। ৪০ বছরের জন্য স্পেস বা জমির বরাদ্দের জন্য ১০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ দেড় কোটি টাকার মতো জামানত রেখেছেন বিনিয়োগকারীরা।
সরেজমিন দেখা যায়, পার্কে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনিক ভবন, শেখ কামাল আইটি সেন্টারসহ ৯টি স্থাপনা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আনসার সদস্যদের ব্যারাক, বিদ্যুতের সাবস্টেশন, গ্যাস স্টেশন, সেতু, কালভার্ট কাম স্লুইসগেট, গভীর নলকূপ। ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ সড়ক ও একটি কালভার্টের কাজও শেষ হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে স্থাপনা নির্মাণ শুরু করছে ৩২ একর জমি বরাদ্দ পাওয়া র্যাংগস ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি। তবে কাজ শেষ করতে সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সাইট ইঞ্জিনিয়ার নাইম ইসলাম। ১ একর ১৩ শতক জায়গা বরাদ্দ পাওয়া রহমানিয়া সুপার মার্কেট নামে একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করছে রেস্টুরেন্ট কাম বুট ক্লাব। এর ঠিকাদার বাবুল হোসেন জানান, তিনি সীমানা প্রাচীরের কাজ করছেন। নির্মাণসামগ্রীর দাম অস্বাভাবিক বাড়ায় পুরোনো দরপত্রের ভিত্তিতে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। দামের কারণে কাজে ধীরগতি বলে জানান তিনি।
বরাদ্দ পাওয়া একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রধান জানিয়েছেন, এখন বিনিয়োগে ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অর্থনীতি অস্থিতিশীল। যারা জমি বরাদ্দ নিয়েছে তাদের ঋণ সুবিধা নেই। বিনিয়োগ করলে তা উঠবে কিনা তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। সংশয়ের কথা উল্লেখ করে বুট ক্লাব ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক সৈয়দ মহসিন হোসেন জানান, অনেকে জমি নিয়ে রাখলেও কাজ শুরু করছে না। বরাদ্দ পাওয়ার পরও সম্প্রতি জায়গা ছেড়ে দিয়েছে নুহা অ্যান্ড সোহান এন্টারপ্রাইজ, সিমেড হেলথ লিমিটেডসহ আরও দুটি প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে নুহা অ্যান্ড সোহান এন্টারপ্রাইজের মালিক উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ বলেন, আমি পাঁচতারকা হোটেলের জন্য জায়গা বরাদ্দ নিয়েছিলাম। ১২০ কোটি টাকা লাগে। ঋণের ব্যবস্থা না থাকায় অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে ছেড়ে দিয়েছি। সিমেড হেলথ লিমিটেডের পরিচালক অধ্যাপক খন্দকার এ মামুন জানান, সমস্যার কারণে তিনি জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। বরাদ্দ পাওয়ার দীর্ঘদিন পরও কাজ শুরু না করার বিষয়ে আরএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরএন পাল জানান, বৈশ্বিক মন্দার কারণে তারা কাজ শুরু করতে দেরি করছেন।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক গোলাম সরওয়ার ভুঁইয়া জানান, বরাদ্দের সময় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলে দেওয়া হয় কত দিনের মধ্যে কী করতে হবে। কেউ চুক্তি লঙ্ঘন করলে বরাদ্দ বাতিল হয়ে যাবে। রাশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানসহ কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান এখানে গাড়ি উৎপাদনসহ নানা পণ্য উৎপাদনে আগ্রহ দেখিয়েছে উল্লেখ করে বলেন, ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেছে।
সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি তাহমিন আহমদ বলেন, পার্কে বরাদ্দ নেওয়া জায়গার ওপর ঋণের সুবিধা না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান আগ্রহ হারাচ্ছে। সুযোগসুবিধা না থাকলে কে সেখানে যাবে? তিনি আরও বলেন, শুরুতে দেশ-বিদেশে সিলেটের মানুষকে পার্কে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু সরকার বিনিয়োগকারীদের বিষয়টি নজর দিচ্ছে না। বিনিয়োগকারীরা শুধু বিনিয়োগ করবে, তা হয় না। সরকারকে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। পার্ক করে বসে থাকলে হবে না।
সুত্র: সমকাল