হেফাজতের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হচ্ছে, বাদ পড়ছেন মামুনুল-আজিজুল

দৈনিকসিলেটডেস্ক
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নতুন ও ‘পূর্ণাঙ্গ’ কমিটি সেপ্টেম্বরে ঘোষণা করা হচ্ছে। পরপর দুজন আমির ও দুজন মহাসচিবের মৃত্যু এবং সরকারের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী বিরোধের পর অনেকটা সরকারের পছন্দেরই নতুন এই কমিটি হবে। তাই নিশ্চিতভাবে বাদ যাচ্ছেন সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী। সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
তবে মামুনুল হক ও আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে সংগঠনের নির্বাহী কমিটি থেকে বাদ দিলে হেফাজতের ভেতরে অসন্তোষ তৈরি হওয়ার আশঙ্কার কথা বলেছেন একাধিক নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংগঠনের অন্তত দুজন নেতা বলেন, সরকার যতই নিয়ন্ত্রণমূলক কৌশল নিক না কেনো, দীর্ঘদিন ধরে কারা নির্যাতিত হেফাজতের নেতা ও কর্মীরা সরকারের পক্ষে না থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। কারা নির্যাতিত নেতা ও কর্মীদের প্রতি সাধারণ কর্মীর ভাবনাটা আবেগের।
হেফাজতে ইসলাম এমন সময় নতুন কমিটির ঘোষণা দিচ্ছে, যখন পরবর্তী সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত। ২০১৩ সালেও শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচিকে পরবর্তীকালে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বিরোধী দলগুলো। ফলে সরকার তখন কঠোর অবস্থানে যায়। সারাদেশে হেফাজতের যে হাজার হাজার একনিষ্ঠ কর্মী আছেন, বিরোধী দল তাদের বারবার কৌশলে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। তবে সরকার রাজনৈতিক নানা কৌশল ব্যবহার করে তাদের বাগে আনলেও একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
শাপলা চত্বরে জমায়েত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমন ঠেকাতে মাঠে নামা এবং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে বাধাসহ কয়েকটি সংবেদনশীল ইস্যুতে বর্তমান সরকারের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নীতিগত দূরত্ব রয়েছে। শুরু থেকে নানা কৌশলে হেফাজতে ইসলামকে বশে আনার চেষ্টা করলেও দিন শেষে তাদের কর্মসূচিগুলো সরকারের বিপক্ষেই গেছে। হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির ও হাটহাজারী দারুল উলুম মুঈনুল ইসলামের (হাটহাজারী বড় মাদ্রাসা) সাবেক মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী সরকার ও দলের মধ্যে একটা সদ্ভাব রেখে চলার চেষ্টা করলেও সাবেক মহাসচিব হাফেজ বাবুনগরী ছিলেন প্রচণ্ড আওয়ামীবিরোধী। স্বল্প সময়ে এই দুই নেতাসহ সাবেক দুই মহাসচিব নুর হোসাইন কাশেমী ও নুরুল ইসলাম জেহাদীর মৃত্যুর পর বর্তমানে হেফাজতের যে কমিটি আছে, সেটি অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। তবে আমিরসহ নেতাদের একটি অংশ ভেতর থেকে প্রচণ্ডভাবে সরকারবিরোধী। এর মধ্যেও গত কয়েক মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা হেফাজতের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হাটহাজারী বড় মাদ্রাসা পরিদর্শন করেছেন। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেশির ভাগ নেতাকর্মী জেল থেকে জামিনে ছাড়াও পেয়েছেন।
হেফাজত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আল্লামা শাহ আহমদ শফী ও হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যু এবং পরবর্তী নানা প্রক্রিয়ার পর হেফাজতে ইসলামের ওপর হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রভাব কিছুটা কমেছে। বর্তমানে হেফাজতে ইসলামের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী হলেন ফটিকছড়ির বাবুনগর মাদ্রাসার মহাপরিচালক। আর মহাসচিব সাজিদুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। হাটহাজারী মাদ্রাসায় বর্তমানে হেফাজতের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতার অভাব রয়েছে বলে সংগঠনটির একাধিক নেতা দাবি করেছেন। তবে তারা পরিচয় প্রকাশ করতে চান না।
সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর গঠিত ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল রাতে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। চলতি মাসের ৫ আগস্ট হেফাজতের আমিরের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির এক বৈঠকে বিলুপ্ত কমিটির সব সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ ছাড়া বিলুপ্ত কমিটির সদস্যদের ফেরাতে সংগঠনের মহাসচিবকে আহ্বায়ক করে ১২ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাব কমিটিও গঠন করা হয়। এরপর থেকে ইসলামি রাজনৈতিক দলের পদধারী নেতারা তথা বিলুপ্ত কমিটির সদস্যরা জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক মাঠে মূল্যায়িত হওয়ার আশায় কেন্দ্রীয় কমিটির পদ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এসব রাজনৈতিক দলের বেশির ভাগই বিএনপির জোটভুক্ত।
এর মধ্যে গত ১৬ আগস্ট রাজধানীর ঢাকার ফুলবাড়িয়া জামে মসজিদের খতিবের কার্যালয়ে মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমানের সভাপতিত্বে এক বৈঠক হয়। বৈঠকে বিলুপ্ত কমিটির আলোচিত-সমালোচিত নেতাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ফেরাতে হেফাজতের দুঃসময়ের নেতৃত্বদানকারী নেতাদের বর্তমান পদ থেকে সরিয়ে পদ-পদবি চূড়ান্ত করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, বিলুপ্ত কমিটির সদস্যরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে ফেরার খবরের সঙ্গে বাদ পড়াদের ব্যাপারেও অনেক কথা ফাঁস হয়েছে। এতে হেফাজতের দুঃসময়ের নেতৃত্বদানকারী ত্যাগী ও পরিচ্ছন্ন নেতারা হতাশ। এমন কিছু হলে হেফাজত নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
দুই বছর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে সংঘাতের পর আমিরের দায়িত্বে থাকা প্রয়াত হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরীর ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এরপর নতুন আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। নানা ঘটনার মুখে কমিটি বিলুপ্তির দেড় মাসের মধ্যে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করে হেফাজতে ইসলাম। ওই কমিটিতে জুনাইদ বাবুনগরীকে আমির পদে রেখে ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০২১ সালের ৭ জুন ঢাকার আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া মাখজানুল উলুম খিলগাঁওয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী কমিটি ঘোষণা করেন। এতে বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব আলোচিত মাওলানা মামুনুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীসহ যারা সহিংসতার মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাদের কমিটিতে রাখা হয়নি।
পরবর্তীকালে ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী মারা গেলে এর পরের দিন সাজিদুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এবং ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি মহাসচিব করা হয়।
নতুন কমিটি ঘোষণার বিষয়ে বক্তব্য জানতে বর্তমান মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে সাব কমিটির সদস্য ও হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির এবং হাটহাজারী মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালক মুফতি জসীমুদ্দীন বলেন, সম্প্রতি ঢাকায় সাব কমিটির বৈঠকে উপস্থিত কমিটির সদস্যরা বিলুপ্ত কমিটির অনেক নেতার নাম পদ-পদবির বিষয়ে প্রস্তাব করেছে। আমরা ওই প্রস্তাবিত নেতাদের নাম এবং পদবি যাচাই-বাছাই করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে উপস্থাপন করব। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।
জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, হেফাজতে ইসলাম এদেশের সর্বশ্রেণির মানুষের ইমান আকিদার সংগঠন। নতুন কমিটি কার্যক্রম শুরু করলে সারাদেশে হেফাজতে ইসলাম পুনরায় সগৌরবে ফিরে আসবে।
সূত্র: আমাদেরসময়