জিকির মানুষের অন্তরের মলিনতা দূর করে
ইসমাঈল সিদ্দিকী :
কখনো কখনো হৃদয় শুষ্ক ভূমির মতো রুক্ষ হয়ে যায়। কখনো হয়ে যায় পাথরের চেয়েও কঠিন। তখন ভালো কথা আর ভালো লাগে না, ভালো কাজে আর মন বসে না। কারণ হৃদয়ের কঠোরতা মানুষের মনকে পরিবর্তন করে দেয়।
মানুষের থেকে আত্মিক প্রশান্তি কেড়ে নেয়। মানসিক অস্থিরতা আর ডিপ্রেশনের দিকে ঠেলে দেয়। সত্যগ্রহণ থেকে মানুষকে বিরত রাখে। জীবনে চলার পথে মানুষ যখন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, হৃদয়ের কোমলতা ফিরিয়ে আনতে ইসলাম মানুষকে বেশি বেশি জিকির করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।
কারণ মানুষ যত বেশি আল্লাহর জিকির করবে, তত বেশি তার হৃদয় বিগলিত হবে এবং তার অশান্ত হৃদয় শান্ত হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়, জেনে রেখো, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরগুলো প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রাদ, আয়াত : ২৮)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ঈমানদার তারা এমন যে যখন তাদের সামনে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তখন তাদের অন্তর ভীত হয়ে পড়ে।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ২
জিকিরের নানাবিধ ফজিলতের কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নিচে গুরুত্বপূর্ণ ১০টি ফজিলতের বিষয়ে বর্ণনা করা হলো—
১. জিকির অন্তরের মলিনতা দূর করে
শয়তান মানুষকে পাপকাজে লিপ্ত করে।
আর পাপের কারণে মানুষের অন্তর মলিন হয়ে যায়। জিকিরের মাধ্যমে হৃদয়ের এই মলিনতা দূর হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘প্রত্যেক বস্তু পরিষ্কার করার উপকরণ আছে। আর অন্তরের ময়লা পরিষ্কার করার উপকরণ হলো আল্লাহর জিকির।’ (আত-তারগিব ওয়াত তারহিব : ২/৩২৭)
২. আল্লাহ জিকিরকারীকে স্মরণ করেন
যে আল্লাহর জিকির করে মহান আল্লাহ তার জিকিরের জবাব দেন এবং তার প্রতিদান দান করেন।
রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি বান্দার সঙ্গে এমন ব্যবহার করি, যেমন সে আমার প্রতি ধারণা রাখে। সে যখন আমাকে স্মরণ করে আমি তার সঙ্গে থাকি। সে যদি আমাকে অন্তরে স্মরণ করে আমিও তাকে অন্তরে স্মরণ করি। সে যদি কোনো মজলিসে আমার কথা আলোচনা করে তবে আমি তার চেয়ে উত্তম মজলিসে তার আলোচনা করি।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৬৭৫)
৩. জিকিরবিহীন থাকা মৃততুল্য
যে অন্তর আল্লাহর জিকির থেকে উদাসীন, তা জীবিত নয়, মৃত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার রবকে স্মরণ করে আর যে করে না, তাদের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও মৃতের মতো। (অর্থাৎ যে আল্লাহকে স্মরণ করে সে জীবিত। আর যে স্মরণ করে না সে মৃত)।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪০৭)
৪. জিকিরকারী কিয়ামতের দিন আরশের নিচে ছায়া পাবে
কিয়ামতের দিন সূর্যের উত্তাপ থেকে বাঁচতে যখন কোনো ছায়া থাকবে না, তখন আল্লাহর আরশের ছায়ায় বিশেষ মানুষকে ঠাঁই দেওয়া হবে। জিকিরকারীরা তাঁদের অন্যতম। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন ওই ব্যক্তি, যে একান্তে আল্লাহকে স্মরণ করেছে (জিকির করেছে) এবং তার চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪৭৯)
৫. জিকিরকারীকে আল্লাহর রহমত ঢেকে নেয়
জিকিরকারীকে জিকিররত থাকাকালে আল্লাহর রহমত ঢেকে নেয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন কিছু মানুষ আল্লাহকে স্মরণ (আল্লাহর জিকির) করে, তখন ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখেন, আল্লাহর রহমত তাদের ঢেকে নেয়, এবং তাদের ওপর সাকিনা (ঐশী প্রশান্তি) নেমে আসে, আর আল্লাহ তাআলা তাঁর নিকটতম ফেরেশতাদের সামনে তাদের কথা উল্লেখ করেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ৭০০)
৬. জিকির পরকালে মুক্তির অন্যতম উপায়
বেশি বেশি জিকির করলে পরকালে মুক্তি মিলবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর জিকিরের চেয়ে আজাব থেকে বেশি নাজাত দানকারী আর কোনো আমল নেই।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, হাদিস : ১৬৭৪৫)
৭. জিকিরের দ্বারা গুনাহ মাফ হয়
জিকিরের দ্বারা মহান আল্লাহ বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন এবং পাপকে পুণ্য দিয়ে পরিবর্তন করে দেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন কিছু মানুষ আল্লাহর জিকিরের জন্য একত্র হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিই একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তখন আসমান থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা করেন, তোমাদের মাফ করে দেওয়া হয়েছে এবং তোমাদের গুনাহ নেকিতে পরিণত হয়েছে।’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৫৩৪)
৮. জিকির অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল
আল্লাহর কাছে জিকির অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল। আবু দারদা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন একটি জিনিসের কথা বলব না, যা তোমাদের সব আমলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তোমাদের রবের কাছে সবচেয়ে পবিত্র, তোমাদের মর্যাদা আরো বৃদ্ধিকারী, আল্লাহর রাস্তায় সোনা-রুপা খরচ করা থেকে এবং জিহাদের ময়দানে শত্রুর প্রাণ নেওয়া ও শত্রুর হাতে প্রাণ দেওয়া থেকেও উত্তম। সাহাবারা বলেন, অবশ্যই বলুন। তিনি বলেন, তা হলো আল্লাহর জিকির।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৩৭৫)
৯. জিকিরকারীর সঙ্গে আল্লাহর রহমত থাকে
আল্লাহর রহমত জিকিরকারীর সঙ্গে থাকে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, বান্দা যতক্ষণ আমাকে স্মরণ করতে থাকে এবং আমার জিকিরের কারণে তার ঠোঁট নড়তে থাকে, ততক্ষণ আমি তার সঙ্গে থাকি। (অর্থাৎ আল্লাহর রহমত তার সঙ্গে থাকে)।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১০৯৬৮)
১০. জিকির না করার জন্য আফসোস!
দুনিয়াতে যে সময় জিকির ছাড়া অতিবাহিত হয় সে সময়ের জন্য পরকালে আফসোস করতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতে প্রবেশ করার পর জান্নাতবাসীরা দুনিয়ার কোনো জিনিসের জন্য আফসোস করবে না, শুধু ওই সময়ের জন্য আফসোস করবে, যা দুনিয়াতে আল্লাহর জিকির ছাড়া অতিবাহিত করেছে।’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৫১২)
মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।