শ্রীমঙ্গলে শত বছরের কালীঘাট ডাকঘর
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
‘চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও/ নইলে, থাকতে পারব না/ চিঠি দিও’…কিংবা ‘সে আমায় চিঠি দিয়েছে/ সে আমার খবর নিয়েছে…।’ বাংলা সিনেমার গান। এ রকম গান দুই-আড়াই দশক আগেও সিনেমা হলে, ঘরে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় রেডিও, টেপরেকর্ডার অথবা টেলিভিশনে বেজেছে। এ রকম গানের কথাগুলো আবেগ আর ভালোবাসায় নানা রং তৈরি করেছে। মনকে রাঙিয়েছে।
শুধু তরুণ-তরুণীর আকুলতা চিঠিতে জড়ানো ছিল, সে রকম নয়। ওখানে বিষয়-আশয়, সংসারের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখের কত কিছু জমা থাকত। একটি চিঠি কখনো একরাশ আনন্দের উচ্ছ্বাস তৈরি করেছে, কখনো মন খারাপেরও বার্তাবাহক হয়েছে। তবু চিঠির অপেক্ষা ছিল। দূরত্বকে কাছে নিয়ে আসার উপায় ছিল চিঠি। গোটা অক্ষরে, কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা চিঠির কোনো বিকল্প ছিল না। এই সময়টা কত দ্রুতই পাল্টে গেছে। এখন আর চিঠি দিও, চিঠি এসেছে—এই আকুলতা নিয়ে কেউ অপেক্ষায় নেই, উচ্ছ্বাস নেই।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের কালীঘাট চা-বাগানের প্রবীণ মানুষ সুশেন নায়েকও এ রকমই বলেন, ছোটবেলায় তিনি বড়দের কাছে চিঠি লেখা শিখতেন। কোনো খবর কোথাও পৌঁছাতে ডাক বিভাগের খামে ভরে সেই চিঠি পোস্ট অফিসের ডাকবাক্সে ফেলে আসতেন। যখন ডাকপিয়ন চিঠি নিয়ে আসতেন, পাড়ার সবাই তাঁকে ঘিরে ধরতেন। একটি চিঠি একটি পরিবারের বর্তমানকে পাল্টে দিয়েছে। কখনো হাসিতে, কখনো বিষাদে।
সুশেন নায়েক বলেন, ‘আগে মোবাইল, টেলিফোন, ইন্টারনেট কিছুই হাতের কাছে ছিল না। চিঠিতেই ছিল যোগাযোগ। এখন কেউ চিঠি লেখে না। প্রয়োজনও নেই। এখন সবকিছু হাতের মুঠোয়।’
এই কথাগুলো মূলত একটি ডাকঘরকে ঘিরে। সেই কবে, শত বছর আগে দূরদেশে থাকা প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হতে স্থাপিত হয়েছিল শ্রীমঙ্গলের কালীঘাটে, কালীঘাট ডাকঘর। শুধু কালীঘাট চা-বাগানই নয়, পাশের এলাকার অনেকেই এই ডাকঘরের সেবা নিয়েছেন দীর্ঘ সময় ধরে। এ বছর ডাকঘরটি শত বছরে পদার্পণ করেছে। যদিও পুরোনো ব্যস্ততা, জৌলুশ, মানুষের আনাগোনা এখন আর নেই। তবু শত বছরের স্মৃতি হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে ডাকঘরটি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় এটি প্রথম ডাকঘর। অনেকের মতে, বাংলাদেশের চা-শিল্পাঞ্চলের প্রথম ডাকঘর এটি। সেই সময় এ অঞ্চলের চা-বাগানের মালিক ছিল ব্রিটিশ কোম্পানি। বাগান ব্যবস্থাপনায় ছিলেন ব্রিটিশরাই। তাঁরা থাকতেন বাগানের বাংলোতে। চা-বাগানে শ্রমিকের কাজ করানোর জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে মানুষ আনা হয়েছিল। সেই সময় এই পোস্ট অফিস ছিল চা-বাগানে পত্র-যোগাযোগের একমাত্র ভরসা। মূলত চা-বাগানকে কেন্দ্র করেই এই পোস্ট অফিস করা হয়েছিল। তখন এই পোস্ট অফিস থেকে এক আনা, দুই আনা দিয়ে পোস্টকার্ডে লিখে টেলিগ্রাম পাঠানো হতো। প্রথম প্রথম ইংরেজরাই তাঁদের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতেন। পরে আস্তে আস্তে এই পোস্ট অফিসের সুবিধা ভোগ করতে থাকেন বাগানে বসবাস করা অন্যরাও। তখন এই পোস্ট অফিসে পোস্টমাস্টার ছিলেন একজন বিহারি। তবে ১৯৬০ সালে মজুমদার নামের একজন বাঙালি পোস্টমাস্টার দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর এ অঞ্চলে মানুষজনের বসতি বেড়ে যাওয়ায় এই পোস্ট অফিসের কার্যক্রমও বেড়ে যায়।
কালীঘাট ডাকঘরের পোস্টমাস্টার তুষার কান্তি দত্ত পুরকায়স্থ বলেন, বর্তমানে চা-বাগানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট, চিঠি, সরকারি বিভিন্ন চিঠিপত্র নিয়মিত আসে। ব্যক্তিগত চিঠি একবারেই কম। এখানে পোস্টমাস্টার, একজন পোস্টম্যান ও একজন রানার রয়েছেন। সময়-সময় টিনের তৈরি পোস্ট অফিসটি লাল রং করে রাখা হয়। এই পোস্ট অফিস শত বছরে পদার্পণ করেছে। প্রচার হওয়ার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এখানে আসছেন, ছবি তুলছেন। ডাকঘরের ইতিহাস জানতে চাইছেন।
শ্রীমঙ্গলের বাসিন্দা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিভাগের সাবেক পরিচালক চিকিৎসক সত্যকাম চক্রবর্তী। তাঁর মতে, এই ডাকঘর প্রমাণ করে, এখানে শত বছর আগেও একটি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত ছিল এই ডাকঘরকে ঘিরে। এই ডাকঘর শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্যের একটি অংশ। এটি যেহেতু ১০০ বছর হয়ে গেছে, ডাক বিভাগ ও এর সঙ্গে যাঁরা সংশ্লিষ্ট, তাঁদের উচিত এটিকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, স্থানীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য টিকিয়ে রাখা। সুত্র: প্রথম আলো