ফেসবুক আসক্তি মাদকের মতোই ভয়ংকর
দৈনিকসিলেটডেস্ক
বিশ্বের অন্যতম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। মেটার মালিকানাধীন এই জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির ব্যবহারকারীর দিক থেকে শীর্ষ ৩ দেশের একটি হলো বাংলাদেশ। সম্প্রতি মেটার প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে। বিশ্বব্যাপী ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সম্প্রতি ২০০ কোটি ছাড়িয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ তিন দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান প্রথম। ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ফিলিপাইন এবং তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশে কত সংখ্যক ব্যবহারকারী রয়েছে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেয়নি মেটা।
ফেসবুক দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘লাইক’ ফিচারটি চালু হওয়ার পর। লাইক পাওয়ার জন্যে উসকানিমূলক মন্তব্য বা ছবি পোস্ট করার ঘটনাও কম নয়। মজার বিষয়, লাইকের উদ্ভাবক জাস্টিন রোজেনস্টাইন নিজের ফোন থেকে এই ফিচারটি সরিয়ে ফেলেছেন।
শুধু তা-ই নয়। অন্যান্য সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপও তিনি ফোন থেকে মুছে দিয়েছেন।
একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এসব অ্যাপ মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং মানুষকে আসক্ত করে তোলে।’ অ্যাপের নির্মাতারা সাবধানতা অবলম্বন করলেও অধিকাংশ ব্যবহারকারীই এ ব্যাপারে মোটেই সচেতন নন।
ফেসবুক যেহেতু নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগের বারোটা বাজায়, তাই কোনো বিষয়ে মনোনিবেশ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যক্তির চিন্তাশক্তি ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা এবং আইকিউ লেভেলও কমতে থাকে ধীরে ধীরে। তাই সহজে আহাম্মক হতে চাইলে দীর্ঘসময় ফেসবুক ব্যবহার করে যে-কেউ পেতে পারে চমৎকার ফল।
২০১৫-তে মাইক্রোসফটের সমীক্ষা অনুযায়ী, স্মার্টফোন-বিপ্লব ঘটার আগে মানুষের মনোযোগের স্প্যান ছিল ১২ সেকেন্ড। এখন তা দাঁড়িয়েছে মাত্র আট সেকেন্ডে। আর সবচেয়ে কম মনোযোগের খেতাবধারী গোল্ডফিশের স্প্যান? নয় সেকেন্ড! সাড়ে সর্বনাশ ঘটার আগেই সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন পাশ্চাত্যের সমাজবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা।
সম্প্রতি একই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন আমাদের দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল—‘আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়াই তারা সবাই একটা বিষয় লক্ষ করেছি। গত কয়েক বছর থেকে ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে আসছে। অনেক সময়েই মনে হয় পড়ানোর সময় আমি যেটা বলছি ছাত্রছাত্রীরা সেটা শুনছে, কিন্তু বোঝার জন্যে মস্তিষ্কটি ব্যবহার করতে তাদের ভেতর এক ধরনের অনীহা, এক ধরনের আলস্য।
এ নিয়ে কোনো গবেষণা হয় নি। আমার কাছে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। কিন্তু আমার মনে হয়, এটি ফেসবুক জাতীয় সামাজিক নেটওয়ার্কে বাড়াবাড়ি আসক্তির ফল। এটি নিশ্চয়ই শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয়, সারা পৃথিবীর সমস্যা।
দাম্পত্য সম্পর্ক ভাঙতেও ইদানীং দারুণ ভূমিকা রাখছে ফেসবুক। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচটি ডিভোর্সের অন্তত একটির পেছনে ফেসবুক ভূমিকা রাখছে বলে একটি জরিপে জানা গেছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেসবুকের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের অজান্তে এমন সব নারী-পুরুষের সঙ্গে একান্ত সম্পর্ক গড়ে তুলছেন যাকে অবিশ্বস্ততা বলা যায়। যার ক্রমবর্ধমান বলি হয়ে উঠছে দাম্পত্য সম্পর্কগুলো।
আমেরিকান একাডেমি অব ম্যাট্রিমনিয়াল লইয়ার্স দেশটিতে সংঘটিত সাম্প্রতিক কিছু ডিভোর্সের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। দেখা গেছে, ফেসবুক ব্যবহার করে স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে পরস্পরকে প্রতারণা করার হার দিন দিন বাড়ছে। ফেসবুকের মাধ্যমে তারা অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলছেন। মার্কিন আদালতে ডিভোর্স আবেদনে বাদীর পক্ষের শতকরা ৬৬ জন আইনজীবী অনৈতিক সম্পর্কের প্রমাণ হিসেবে ফেসবুক থেকে নেয়া তথ্য ব্যবহার করছেন! ব্রিটেনেও প্রতি একশ-র মধ্যে ২০টি ডিভোর্সের ঘটনায় ভূমিকা রাখছে ফেসবুক।
নিজের সন্তানদের প্রযুক্তিপণ্য থেকে ঠিকই দূরে রেখেছেন মাইক্রোসফট-এর প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ও অ্যাপল-এর প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস। তাদের কল্যাণে স্মার্টফোন, আইপ্যাড ও কম্পিউটার গেমস পৌঁছে গেছে কোটি মানুষের দুয়ারে। অথচ এই প্রযুক্তিবিদরা নিজেদের সন্তানদের ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে শুরু থেকেই জারি করে রেখেছিলেন কঠোর নিষেধাজ্ঞা। বিল গেটস তার সন্তানদের বয়স ১৪ হওয়ার আগে মোবাইল ফোন কিনে দেন নি, কম্পিউটারও ব্যবহার করতে দিতেন দিনে মোটে ৪৫ মিনিটের জন্যে। আর স্টিভ জবস তো নিজের উদ্ভাবিত আইপ্যাডই কখনো ব্যবহার করতে দেন নি সন্তানদের।
এ সতর্কতা অবলম্বনের কারণ হলো তারা ঠিক জানেন, আইপ্যাড-আইফোন জাতীয় প্রযুক্তিপণ্যগুলো মানুষকে অতিমাত্রায় আসক্ত করে তোলে। তাই মুনাফার লোভে অপরের ঘরে অশান্তির কাঁচামাল জোগান দিলেও নিজের ঘর তারা সাধ্যমতো আগলে রেখেছেন ঠিকই।
তাই নিত্যনতুন প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করার ক্ষেত্রে নিজে সচেতন হোন। এবং সেইসাথে সন্তানদের হাতে স্মার্টফোন-আইপ্যাডরূপী এসব আসক্তি-উপকরণ তুলে দেয়ার আগে আরেকবার ভাবুন।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের অর্থায়নে ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ স্কুল অব মেডিসিন একটি গবেষণা চালায়। ১,৭৮৭ জন মার্কিন তরুণের জীবনাভ্যাস পর্যালোচনা করে গবেষকরা রায় দেন, একজন তরুণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যত বেশি সময় কাটাবে, তত সে হতাশ একাকী ও বিষণ্ন হয়ে পড়বে। গবেষকরা তাই ফেসবুককে আখ্যায়িত করেছেন ‘অবসাদগ্রস্ত মানুষের আখড়া’ হিসেবে।
গত কয়েক বছরে মার্কিন টিনএজারদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ার পেছনেও স্মার্টফোনের বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করছেন সে-দেশের মনোবিজ্ঞানীরা।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান