অন্ধ রহিমকে ভিক্ষাবৃত্তি ফিরিয়ে শিশু নাঈমাকে স্কুলে ভর্তি
নুর উদ্দিন সুমন, হবিগঞ্জ :
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার কালিশিরি গ্রামে নানার সাথে ভিক্ষাবৃত্তি করা শিশু নাইমা(৯) কে খাতা,কলম, স্কুল ব্যাগ ও নতুন জামাকাপড় কিনে দিয়ে নিজ গাড়িতে করে স্কুলে ভর্তি করে মহানুভবতার পরিচয় দিলেন চুনারুঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রাশেদুল হক । ভর্তির কার্যক্রম শেষে নিজ গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দেয়া হয়। সেইসঙ্গে শিশুটির নানা আব্দুর রহিমকে নগদ অর্থ, একটি নতুন পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছেন এবং ভিক্ষাবৃত্তি থেকে ফেরাতে সমাজ সেবার মাধ্যমে একটি টংদোকানের ব্যবস্থা করেছেন ওসি ।
কিছুদিনের মধ্যে সমাজ সেবা থেকে তিনি টংদোকান পাচ্ছেন বলে সমাজ সেবা অফিসার বারেন্দ্র রায় জানিয়েছেন। অসহায় শিশু নাইমা জানায়, আমি এই প্রথম স্কুলে ভর্তি হয়ে নতুন বই পেয়েছি। আমি কোনদিন ভাবিনি স্কুলে যেতে পারবো। নানার সাথে ভিক্ষাবৃত্তি করতে গিয়ে ওসি স্যারের দেখা হলে ওসি স্যার আমাকে কথা দিয়েছিলেন স্কুলে ভর্তি করে দিবেন। সেই কথা অনুযায়ী ওসি স্যার আমাকে দুটি নতুন জামা,জুতা, স্কুল ব্যাগ, খাতা কলম সহ শিক্ষা সামগ্রী কিনে দেন এবং স্কুলে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দেন। আমি আজ প্রথম ক্লাস করেছি। স্কুলের স্যাররাও আমাকে ভর্তিতে সহযোগিতা করেছেন। আমি স্কুলে গিয়ে ক্লাস করতে পেরে খুবই খুশি। অসহায় জন্মান্ধ নানা আব্দুর রহিম জানান, আমি জন্মের পর থেকেই দু-চোখে দেখিনা। মানুষের সাহায্য সহযোগীতা নিয়ে অনেকদিন চলেছি। আমার দুই ছেলে ৫ মেয়ের মধ্যে আমার খোঁজ খবর কেউ রাখেনি। নাঈমার মা হালিমা খাতুন আমার খষ্ট বুঝে তার মেয়েকে আমার বাড়িতে দিয়েছে। বিনিময়ে আমি তাকে মাস শেষে ১ হাজার টাকা দেই। আমি দীর্ঘ ৪ বছর ধরে আমার নাতনীকে নিয়ে হাটবাজার ও গ্রাম গঞ্জে ভিক্ষাবৃত্তি করে আসছি। হঠাৎ ওসি স্যার আমাকে রাস্তায় পেয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করতে মানা করেন এবং নাতনিকে স্কুলে ভর্তি করতে বলেন।
পরে স্যার নিজেই আমাকে সাথে নিয়ে নাতনীকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। আমার কিছুটা কষ্ট হলেও স্যার আমার নাতনীকে জামাকাপড় কিনে দিয়ে স্কুলে ভর্তি করেছেন। এতে আমার সব দুঃখ কষ্ট চলে গেছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি ও কালিশিড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মুজিবুর রহমান, প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমান, স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুস ছাত্তার মোল্লা। আব্দুর রহিম আরও বলেন আমি ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমাকে আর কেউ ভিক্ষুক বলবেনা । স্কুল কমিটির সভাপতি মুজিবুর রহমান জানান, এখন বছর শেষের দিকে ভর্তির কোন নিয়ম নেই। কিন্তু ওসি মহোদয়ের অনুরোধে নাঈমাকে আপাতত নতুন বই দিয়ে লেখাপড়া সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। আগামী নতুন বছরে তার নাম এন্ট্রি করা হবে। কালিশিরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিক মতিউর রহমান বলেন, আমার শিক্ষকতার জীবনে এমন মানবিক ওসি দেখিনি। তিনি অসহায় নাঈমাকে নতুন জামাকাপড় পরিধান করিয়ে আমাদের হাতে তুলে দেন। আমরা চেষ্টা করবো তাকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে।
একই সাথে নাঈমাকে উপবৃত্তি সহ সরকারি সকল সেবা প্রদান করা হবে। স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুস ছাত্তার মোল্লা ওসির এ মানবিক উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ওসি মহোদয়ের পাশাপাশি নাঈমা ও তার নানাকে তিনি নগদ সহায়তা করেন এবং তিনি প্রতিমাসে ৬ হাজার টাকা দিবেন বলে ঘোষণা দেন। ওসি রাশেদুল হক জানান, সম্প্রতি চুনারুঘাটের চন্ডীছড়া অবরোধের ডিউতে যাওয়ার পথে আমার দৃষ্টিগোচর হয় নানা নাতিনের ভিক্ষাবৃত্তি। পরে তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে জানতে পারি নাইমা বড় হওয়ার পর থেকে কোনদিন স্কুলে যায়নি। এমনকী তার নিবন্ধনও হয়নি। পরবর্তীতে স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের মাধ্যমে নাইমার নিবন্ধন ও তার নানাকে একটি টংদোকান করে দিতে সমাজ সেবায় নিয়ে যাই। শিশু নাইমাকে স্কুলে ভর্তির জন্য প্রতিশ্রুতি দেই । সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নাইমাকে স্কুলে র্ভতি করে দেই। সমাজ সেবা অফিসার বারেন্দ্র রায় বলেন, আমরা চুনারুঘাট থানার ওসির মাধ্যমে জানতে পারছি অসহায় আব্দুর রহিম তার নাতনীকে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করেন। তার ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতে আমরা আব্দুর রহিমকে সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে একটি টংদোকান করে দিবো। যাতে নাতনী নাঈমা স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি অবসর সময়ে নানার সাথে দোকানে সহযোগীতা করতে পারে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চরম দারিদ্রতার কারণে পথে পথে ভিক্ষাবৃত্তি করা শুরু করেন নানা আব্দুর রহিম। হাটা চলা করতে না পেরে তার মেয়ের ঘরের নাতনী নাইমাকে সঙ্গে রাখেন। নাইমা তার লেখাপড়া বাদ দিয়ে নানাকে সহযোগিতা করছিলো।
বিনিময়ে নানা মাস শেষে যা পান এর থেকে নাঈমাকে মাসে এক হাজার টাকা দিতেন । স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন পলাশ জানান, নাঈমার বিষয়টি আমি ওসি মহোদয়ের মাধ্যমে জানার পর তার জন্ম নিবন্ধনের আবেদন করেছি এবং তাদেরকে সবধরনের সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেই। ওসি রাশেদুল হক আরও জানান, আমি মূলত শিশু নাইমার অন্ধত্ব জীবন থেকে সুস্থ জীবনে ফেরাতে আমার এ উদ্যোগ। আমার চোখের সামনে অর্থের অভাবে এক কন্যার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে তা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। নাঈমাকে মানুষের মতো হতে হলে লেখাপড়া করতে হবে। অর্থের অভাবে কিছুতেই নাঈমার জীবন ঝরে যেতে পারে না। তার লেখাপড়ার সব খরচ আমি নিজে বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এছাড়া শিশুটির দায়িত্বও নিয়েছি আমি। অর্থের অভাবে নাঈমার মতো কোনো শিশুর স্বপ্ন যেন ঝরে না যায় সেদিকে সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আসুন আমরা সবাই নাঈমার মতো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াই, নাঈমাদের দায়িত্ব নেই