ওসমানী বিমানবন্দরে ৯ বছরে ১৩৭ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাই থেকে আসছে একের পর এক স্বর্ণের চোরাচালান। ৯ বছরে শুধুমাত্র এই ওসমানী বিমানবন্দর থেকেই আটক করা হয়েছে ১৩৭ কেজি বা সাড়ে ৩ মণ স্বর্ণ। এর মধ্যে গত শুক্রবার এক চালানেই ৩৪ কেজি স্বর্ণ আটক করে কাস্টমস। ওসমানী বিমানবন্দরে এর আগে এত বড় চোরাচালান ইতোপূর্বে কখনো ধরা পড়েনি। কাস্টমস কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বর্ণ বহনকারীকে গ্রেফতার করতে পারলেও স্বর্ণ চোরাচালানীদের কখনো গ্রেফতার করতে পারেনি। মূল হোতারা সবসময়ই ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর জোন) আজবাহার আলী শেখ বলেন, বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালানের সবকটি ঘটনার তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। যাদের কাছে স্বর্ণ পাওয়া যায়; তারাই চোরাচালানি। তদন্তে বহনকারীদের বাইরেও নেপথ্যে থাকা অনেককে পুলিশ শনাক্ত করে অভিযোগপত্রে আসামি করে বিচারের মুখোমুখি করেছে।
ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টমসের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদুল করিম বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় এয়ারপোর্ট থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিমানবন্দরে চোরাচালান প্রতিরোধে কাস্টমস কঠোর অবস্থানে রয়েছে। চোরাচালান প্রতিরোধে সকলের সহযোগিতা চান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওসমানী বিমানবন্দরকে টার্গেট করে শক্তিশালী চোরাচালানি চক্র দুবাই, আবুধাবীসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে স্বর্ণের চালান নিয়ে আসছে। এর বাইরে সৌদি আরব থেকেও মাঝে মধ্যে স্বর্ণের ছোট ছোট চালান আসে। তবে, আটক হওয়া চোরাচালানের মধ্যে বেশিরভাগ চালান দুবাই থেকে নিয়ে আসা হয়। যাত্রী বেশে স্বর্ণের চোরাচালান নিয়ে আসলেও মূলত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে নিয়ে আসা হয়। আর এক্ষেত্রে স্বর্ণ চোরাচালানিদের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে গেল শুক্রবার পর্যন্ত ৯ বছরে ১৩৭ কেজি স্বর্ণ আটক করা হয়। এই সময়ে অন্ততঃ ২৫টি স্বর্ণ চোরাচালান আটক করা হয়। এর মধ্যে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত কেবল ৫ বছরেই ১৮টি চালান আটক করা হয়। এসময়ে উদ্ধার করা হয় ৫৯ কেজি ১৮ গ্রাম স্বর্ণ।
সর্বশেষ গত শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-২৪৮ নম্বর ফ্লাইটের চার যাত্রী ও বিমানের টয়লেট থেকে ৩২ কেজি ৬৫ গ্রাম ওজনের ২৮০টি বার ও দেড় কেজি ওজনের ৬টি লিকুইড গোল্ড জব্দ করে কাস্টমস। এ ঘটনায় সম্পৃক্ত বিমানের চার যাত্রী হাবিবুর রহমান (৩৮), মো. সানু মিয়া (৩৫), মো. আক্তারুজ্জামান (৪০) ও মিসফা মিয়াকে (৪৯) গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে এয়ারপোর্ট থানায় চোরাচালান আইনে মামলা দায়ের করা হয়। পরে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
গেল বছর ২০২২ সালের জুন মাসে মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে দুটি চোরাচালান ধরা পড়ে। ২ জুন দুবাই ফেরত যাত্রী ময়নুল ইসলাম শাকিলের কাছ থেকে ১ কেজি ১৬০ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ২৭ মে আলী আহমদ নামের আরেক যাত্রীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় সমপরিমাণ স্বর্ণ।
২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ৭ কোটি টাকা মূল্যের ১১ কেজি ২২০ গ্রাম স্বর্ণসহ দুবাই থেকে আসা চার যাত্রীকে আটক করে কাস্টমস। এই চার যাত্রী ব্লান্ডার মেশিন ও আয়রন মেশিনের ভেতরে কৌশলে এই স্বর্ণ নিয়ে আসেন।
ওই বছরের ৮ নভেম্বর দুবাই ফেরত যাত্রী নরেন্দ্র নাথের কাছ থেকে ৬ কেজি ১৪৮ গ্রাম ওজনের ৩৮ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের দাম প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পরে নরেন্দ্র নাথকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
২০২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা জামিল আহমদ (২৮) নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ১৪টি স্বর্ণের বার ও কিছু স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন প্রায় দুই কেজি। যার দাম প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ১২টি বার বিশেষ ব্যবস্থায় জামিলের উরুতে আটকানো ছিল।
২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবী থেকে আসা জাহিদ হোসেন নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ৪ কেজি ৬৪ গ্রাম ওজনের ৪০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া স্বর্ণের দাম প্রায় ২ কোটি টাকা।
ওই বছরের ৩ জানুয়ারি ফ্লাই দুবাই দিয়ে আসা একটি ফ্লাইটে তল্লাশী চালিয়ে ৬০ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন প্রায় ৭ কেজি। যার দাম প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানের মেকানিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট কারিমুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়।
২০১৭ সালের ২৩ জুলাই আবুধাবি থেকে আসা বিমানের লাগেজ হোল্ডে অভিযান চালিয়ে ৩ কেজি ৫০০ গ্রাম ওজনের ৩০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। বিমানের ওই ফ্লাইটটি সিলেট হয়ে ঢাকায় ফিরছিল। স্বর্ণের এই চালান আটক করা হলেও এর সাথে জড়িত কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।
২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা বিমানে তল্লাশি চালিয়ে ১৬টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন ১ কেজি ৮৭২ গ্রাম। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা যায়নি। একই বছরের ১৬ নভেম্বর ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ৯ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের ৮০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের দাম প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিমানের আসনের নিচে তল্লাশী চালিয়ে এসব স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। দুবাই থেকে আসা ওই বিমানের দুটি সীটের নীচ থেকে কাগজে মোড়ানো অবস্থায় স্বর্ণের বারগুলো উদ্ধার করা হয়। তবে, এ ঘটনায় কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।
ওই বছরের ১৭ মার্চ ৫৮০ গ্রাম ওজনের ৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায়ও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। ২৪ এপ্রিল এক লন্ডন প্রবাসীর কাছ থেকে ৪৩২ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস। পরে ব্যাগেজ রুলস মোতাবেক বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়।
২০১৪ ও ২০১৫ সালে ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ১৯ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস। এছাড়াও, ১০০ ও ২০০ গ্রাম স্বর্ণ আটক, শুল্কায়ন, ন্যায় নির্ণয়নের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে বলে সূত্র জানিয়েছে।