সুনামগঞ্জ সীমান্তে অভয়ারণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে চোরাকারবারিরা
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় ছয়টি উপজেলার শেষ প্রান্ত হচ্ছে ভারতীয় সীমান্ত। ভারতীয় চিনি চোরাকাবারিদের অভয়ারণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এ সীমান্তগুলো।
বিশেষ করে দেশে চিনির দাম বৃদ্ধির পর থেকে ভারত থেকে অবৈধভাবে চিনি নিয়ে আসার পরিমাণ ব্যাপক বেড়েছে। পুলিশের প্রশ্রয়ে এসব চোরাকারবারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ঘড়ির কাটায় রাত ১২টা বাজতেই শুরু হয় একের পর এক ট্রাক ভর্তি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে চিনি পাচার।
জানা যায়, সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তগুলো রাতের বেলা চিনি পাচারের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোরাকারবারিদের সহযোগিতা করছে খোদ পুলিশ। প্রতিদিন কয়েক হাজার বস্তা চিনি বের হয় এসব রুট দিয়ে। শহরের সঙ্গে যোগাযোগের সংযোগস্থল আব্দুজ জহুর সেতু দিয়ে একযোগে সারি সারি ত্রিপলে মুড়িয়ে ছোট বড় ট্রাক দিয়ে পাচার হয় চিনি। রাত ১২টার পরই বদলে যায় সেতু এলাকার চিত্র। ভারতীয় চিনিবোঝাই ট্রাক চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সম্প্রতি সরেজমিনে রাত ১২টার পর আব্দুজ জহুর সেতু এলাকায় দেখা যায়, লাইন ধরে দ্রুত গতিতে সুনামগঞ্জ-সিলেট রোডের দিকে ছুটছে ত্রিপলে মোড়ানো চিনিভর্তি ট্রাক। সেতু থেকে সামান্য দূরে সদর উপজেলার বৈঠাখালি গ্রামের রাধানগর পয়েন্টে যেতেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের দেখা মেলে। ট্রাকের সামনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে ছবি ধারণের জন্য ক্যামেরা চালু করতেই কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখা যায়। পরে ট্রাক ড্রাইভার শিবুল জানান, পুলিশ ট্রাক আটক করেছিল টাকা নেওয়ার জন্য। কিন্তু সাংবাদিকদের দেখে পালিয়ে গেছে। গাড়িতে ভারতীয় চিনি আছে। সেগুলো জেলার জাওয়া বাজার এলাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে আনলোড হয়ে কোথায় যাবে সে জানে না।
পরে রাধানগর পয়েন্ট থেকে কিছু দূরে চালবন পয়েন্টে গিয়ে সড়কের দুপাশে পুলিশের চেকপোস্ট দেখা গেলেও কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ধনপুর, চিকারকান্দি, বাঘবেড়, চেংবিল, শরীফগঞ্জ, মতুরকান্দিসহ বেশ কয়েকটি সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে রাত ১২টার পর ৮ থেকে ১০টি ট্রাকভর্তি চিনির গাড়ি বের করে চোরাকারবারিরা। প্রতিটি গাড়িতে প্রায় ৩০০ বস্তা করে ভারতীয় চিনি থাকে। এ চক্রের সঙ্গে কতিপয় অসাধু পুলিশসহ প্রভাবশালী চক্র রয়েছে। ট্রাকগুলো সদর উপজেলার বৈঠাখালি এলাকার রাধানগর সড়কে এলে পুলিশকে নগদ টাকা দিয়ে ছাড় পায়। বিভিন্ন চেকপোস্ট পার হয় ট্রাকগুলো নির্দিষ্ট একটি টোকেন দেখিয়ে। এই টোকেন দেখানো হলে কেউ আর ট্রাক আটকায় না। পুলিশের পাশাপাশি চোরাকারবারিদের একটি চক্র মোটরসাইকেল মহড়ায় এসব ট্রাক সুনামগঞ্জ পৌর শহরের প্রবেশমুখ হাসন রাজার তোরণ পর্যন্ত পৌঁছে দেয় টাকার বিনিময়ে।
ভারতীয় চিনি চোরাকারবারের সঙ্গে যুক্ত বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার বাসিন্দা সাইফুল বলেন, ‘আমি শুধু একা না, সীমান্ত এলাকায় ২০ থেকে ২২ জন ব্যবসায়ী এভাবে ভারত থেকে চিনি আনার কাজ করে, যারা পুলিশসহ বিভিন্নজনকে ভাগ-বাটোয়ারা দিয়ে এ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।’
জেলা পুলিশের তথ্যমতে, ২০২২ সাল থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশের বিশেষ অভিযানে সুনামগঞ্জে ১৯২ দশমিক ৯ টন চিনি জব্দ করা হয়। সেই সঙ্গে ১৯৭ জন চোরাকারবারিকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ এহসান শাহ্ বলেন, ‘চোরাচালানের সঙ্গে কোনো পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখব।’