কনকনে শীতে সিলেটে পর্যটন বাণিজ্যে ধস
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
শীতে রূপের রাণী সিলেটে বরাবরই পর্যটক ঢল নামে। তবে এবার ঘটলো ব্যতিক্রম। শীতের এই সময়ে এসে অনেকেটা কমে গেছে দর্শনার্থীর চাপ।জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুল, সাদাপাথর, শ্রীমঙ্গলসহ সিলেটের জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থানগুলো মূলত পানি নির্ভর। ফলে এরা বর্ষায় রূপের ঢালি মেলে ধরলেও শীতে তা ধারণ করে ভিন্নরূপ। এই ভিন্ন রূপের মোহে আর অবসর সময়ের সুযোগে এসময় সিলেটে প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড় জমে। তবে এবার তার বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। হোটেল মোটেলেও বুকিং নেমে এসেছে অর্ধেকে।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও নতুন বছরের শুরু থেকেই পর্যটক কমতে শুরু করেছে। প্রচ- শীতে মানুষ প্রয়োজন ছাড়া তেমন ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। গত এক সপ্তাহের টানা হিমেল হাওয়া ও কনকনে শীতের কারণে পর্যটন কেন্দ্রে কমেছে পর্যটকের উপস্থিতি। খাবার দোকান, রেস্টুরেন্ট ও দোকানপাটে নেই ক্রেতার চাপ। গত প্রায় তিনমাস থেকেই পর্যটন নির্ভর ব্যবসায় এই ভাটার টান বলে জানান তারা।
জনপ্রিয় পর্যটন স্পট সাদাপাথরে দেখা যায় অনেকটা শুনসান পরিবেশ। নেই দর্শনার্থীর চাপ। দশ নম্বর ঘাটে যে দোকানগুলোতে ভিড় লেগে থাকতো সেগুলো খাঁ খাঁ করছে। হোটেল রেস্টুরেন্টে নেই লোকজন।
সাদাপাথরের হোটেল আল বেলার কর্ণধার লিটন মিয়া জানান, শীতের সময় স্কুল কলেজ ছুটি থাকে এবং শুকনো মৌসুমের ফলে রাস্তাঘাট ভালো থাকে। ফলে এসময় দর্শনার্থীদের ভিড় বেশি থাকে। বিশেষকরে যাতায়াত সুবিধা ও মেঘ বৃষ্টি না থাকায় এসময় পরিবার পরিজন নিয়ে লোকজন বেশি আসেন। নারী ও ছোটো বাচ্চাকাচ্চা সাথে থাকায় অনেকেই রাতে স্থানীয় হোটেল মোটেলে অবস্থান করে পরদিন ফিরে যান। তাই এসময় পর্যটন স্পটে দোকানের ব্যবসার সাথে হোটেল মোটেল ব্যবসাও ভালো জমে ওঠে। তবে গত এক সপ্তাহ ধরে তীব্র শীতের কারণে দর্শনার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। ঠান্ডার ভয়ে অনেকে বাচ্চা নিয়ে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকায় এমনটা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
লিটন জানান, শুরুতে হরতাল অবরোধ, এরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এরপর এখন এসে তীব্র শীতের দাপট। সব মিলিয়ে গত প্রায় তিনমাস থেকেই পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় ভাটার টান দেখা যাচ্ছে। ফলে এই ভরা মৌসুমেও পর্যটক খরা চলছে। এতে গড়ে ব্যবসায়ীদের লক্ষাধিক টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, পর্যটক থাকুক আর না থাকুক হোটেল দোকান খুলতে হয়, আর খুললেই স্টাফ খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ বা মেন্টেন খরচ তো করতেই হয়। এতে লাভের চেয়ে লোকসানই হচ্ছে বেশি।
সাদাপাথর পর্যটন ব্যসায়ী সমিতির আহ্বায়ক মো. সফাত উল্লাহ বলেন, দীর্ঘ পর্যটক খরার কারণে সাদাপাথরের ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। অনেকেই ছুটির দিন ব্যাতীত দোকানপাট খুলছেন না। সাদাপাথর এখনো নতুন একটি পর্যটন কেন্দ্র। এখনো নতুন নতুন ব্যবসায়ীরা এখানে আসছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।
পর্যটন স্পট জাফলংয়ে দেখা যায়, ভরা মৌসুমে পর্যটকের সংখ্যা কম হওয়ায় বিক্রি ও ভিড় কমেছে স্থানীয় হোটেল ও পর্যটক নির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। জাফলং টুরিস্ট গাইড ক্লাবের সহ-সভাপতি আব্দুর শুকুর মিয়া বলেন, শীতের জন্য পর্যটক উপস্থিতি কম। তবে সরকারি ছুটির দিনে পর্যটক বাড়লেও এ সপ্তাহে শীতের কারণে তেমন পর্যটক নেই। তবে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সল্প মূল্যে আকর্ষণীয় ট্যুর প্যাকেজ আছে।
পর্যটক খরার একই অবস্থা চায়ের রাজধানী খ্যাত শ্রীমঙ্গলেরও। এমনিতেই দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড এই জনপদের অনেক পুরনো বিষয়। সম্প্রতি টানা সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ডের জন্য তা আরও প্রচার পেয়েছে। সারাদেশ থেকে এই শীত মৌসুমে পর্যটকরা শ্রীমঙ্গলে ভিড় করেন। চা বাগানের সবুজ বুকে কুয়াশাভেজা সতেজ পরশ বুলাতে ছুটে আসেন পরিবার পরিজন নিয়ে। তবে এবার শীতের জন্য দর্শনার্থীদের সেই জোয়ার অনেক কমে গেছে।
শ্রীমঙ্গলের সমাজকর্মী সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) টিআইবি সদস্য সৈয়দ ছায়েদ আহমদ বলেন, শ্রীমঙ্গলে শীতের সময় সবচেয়ে বেশি পর্যটকের ঢল নামে। আবহাওয়া শুকনো এবং অনুকূল থাকায় এসময় পরিবার পরিজন নিয়ে লোকজন সারাদেশ থেকে এখানে বেড়াতে আসেন। তবে এবার শীত বেশি থাকায় অন্যবারের চেয়ে শ্রীমঙ্গলে পর্যটকদের সংখ্যা অনেক কম। অনেক হোটেল রিসোর্ট মালিক এজন্য শীতের অতিরিক্ত প্রচারণাকেও দায়ী করছেন বলে তিনি জানান।
ছায়েদ জানান, হোটেল রিসোর্ট মালিকদের সাথে আমাদের কথা হয়েছে, তারা জানিয়েছেন শ্রীমঙ্গলে শীত মৌসুমে শীত উপভোগ করতেই বেশি দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। শীতের বিষয় মাথায় রেখে বিভিন্ন হোটেল মোটেলে বাড়তি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গরম পানি ও হিটারের ব্যবস্থা আছে। তাই শীত যতই হোক পর্যটকদের হোটেলে এজন্য খুব বেশি অনুবিধা হবে না।
শ্রীমঙ্গলের হোটেল স্কাই পার্কের কর্ণধার ইকরামুল ইসলাম ইমন জানান, শ্রীমঙ্গলে বর্তমানে দর্শনার্থীদের সংখ্যা খুব কম। নির্বাচনের সময় থেকেই লোকজন কম আসছেন, কিন্তু এটা কেনো হচ্ছে বলা যাচ্ছে না। তবে কয়েকদিন থেকে তীব্র শীতের জন্য হোটেল বুকিং কমে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। যা এই মৌসুমের জন্য খুব কম। ইমন জানান, শীতে আমাদের হোটেলগুলোতে আগতদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা আছে। তাই যারা আসবেন তাদের আমরা পর্যপ্ত সেবা দিতে পারবো বলে আশারাখি।
এ ব্যাপারে সিলেট হোটেল অ্যান্ড গেস্ট হাউস ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নওশাদ আল মুক্তাদির জানান, নির্বাচনের সময় থেকেই সিলেটে হোটেল ব্যবসায় গতি খুব স্লো। দর্শনার্থীদের আগমন কম ঘটছে। নির্বাচনের পর শীতের তীব্রতা সব মিলিয়ে এখন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ লোকজন হোটেলে মোটেলে উঠছেন। এমনিতে এই সময় ৬০ থেকে ৮০ শতাংশের মতো বুকিং হয়ে থাকে। ছুটির দিনগুলো যা আরেকটু বেড়ে যায়। তবে এবার তা হচ্ছে না।