ফুরির বাড়ি ইফতারি: প্রথা নাকি বোঝা
জুয়েল আহমদ, জগন্নাথপুর
সিলেটের মানুষের চাল-চলন, আতিথেয়তা, সংস্কৃতি, স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে সুদূর বিদেশেও বিস্তৃত। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তর জনপদ সিলেট। রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভাস্বর। আপন স্বকীয়তায় এখানকার মানুষ উদ্ভাসিত। বিশেষ করে সিলেটের একান্ত আপন ঐতিহ্য হচ্ছে রমজান মাসের মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ইফতারি নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ। সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ফুরির বাড়ি ইফতারি’।
আর আঞ্চলিক এ সংস্কৃতি ধরে রাখতে রমজান আসলেই সারা সিলেটের ন্যায় সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরেও ধুম পড়ে ফুরির বাড়ি ইফতারি পাঠানোর। তবে যুগ যুগান্তরের এই সংস্কৃতি নিয়ে বতর্মানে রয়েছে নানা পক্ষে বিপক্ষের আলোচনা। সুশীল সমাজের প্রশ্ন এ কি প্রথা না কি মেয়ের বাড়ি বোঝা?
প্রবীণদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অতিথি আপ্যায়নে সিলেটের মানুষের রয়েছে দারুণ সু-খ্যাতি। তেমনি অতিথি হিসেবে কারও বাড়িতে যাবার সময় নানা প্রকার মৌসুমী ফল-ফলারি, মিষ্টি-মিঠাই বা পছন্দমত যে কোনো জিনিস সঙ্গে করে নেয়ার রেওয়াজও এখানে অনেক পুরনো। বিশেষ করে সিলেটের আঞ্চলিক নিয়ম অনুযায়ী রমজান মাসে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ইফতারি নিয়ে যাওয়ার প্রথা দীর্ঘদিনের। তবে, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সিলেট অঞ্চল থেকে ফুরির বাড়ির ইফতারি দেয়ার রেওয়াজে পরিবর্তন এসেছে অনেকটাই। আগে দিনে রমজান মাস এলেই বাড়িতে বানানো ইফতারি থালা সাজিয়ে প্রথম রোজায় মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যেতেন তার অভিভাবকরা। কিন্তু আগের মতো বাড়িতে বানানো ইফতারি আর মেয়ের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় না। এখন সেই স্থান দখল করেছে হাট-বাজারে বানানো নানা রং-চংয়ের বাহারি ইফতারি। মেয়ের বাড়ি থেকে যে ইফতারি নিয়ে যাওয়া হয় তা শ্বশুর বাড়ির এবং প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে বিলি করা হয়। এ জন্য কমপক্ষে এক মণ থেকে শুরু করে ৩ থেকে ৪ মণ ইফতারি নিতে হয়। এ মধ্যে রয়েছে, মিষ্টি, জিলাপী, নিমকী, খাজা, আমির্তি, বাখরখানি, এছাড়াও মৌসুমী ও দেশি-বিদেশি ফল, চানা, পিঁয়াজু, পোলাও, চপ, বেগুনী ও শাকের তৈরি বিভিন্ন ধরনের বড়া ইত্যাদি। এসব ইফতারির দামও বেশি। ফলে, আর্থিকভাবে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে হিমশিম খেতে হয়।
এতেই শেষ নয়! প্রবীণ ব্যক্তিরা আরো জানান, রোজার শেষ দিকে আবারও যেতে হয় কনের দাদা-নানা, বাবা-চাচা, ভাই বা নিকট আত্মীয় যে কেউ। এ সময় মেয়ের শ্বশুর বাড়ির সকলকে ঈদে বেড়াতে আসার দাওয়াত দেয়া হয়। এমনকি মেয়ের বাড়ির লোকজনদের ঈদের নতুন জামা-কাপড়ও দিতে হয়। সেই আগেকার দিনের চলিত প্রথা এখনো ঠিকে আছে সিলেট অঞ্চলে। তবে, বর্তমানে তা কিছু্টা কমে আসলেও অনেক ক্ষেত্রে স্বামী বা শ্বশুর-শ্বাশুরী ‘জল্লাদ’ বা ‘খিটখিটে মেজাজে’র হলে নতুন বউ গোপনে বাবার বাড়ীতে জানায় যে, আর কিছু না হোক ইফতার সামগ্রী উন্নত ও পরিমাণে যেন বেশি হয়। কোন কোন বদ মেজাজী পেটুক বা লোভী বর কিংবা বরের পিতাকে ইফতার সামগ্রী একটু কম বা কিছুটা নিম্নমানের কারনে মেয়ের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে ঝগড়া করতেও দেখা যায়। সেই সঙ্গে ওই গৃহবধূকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
আধুনিকতার এই যুগেও অনেকে নতুন শ্বশুর বাড়ির ইফতার খাবার জন্য সুদূর প্রবাস থেকেও দেশে আসেন। আবার অনেকের মেয়ে জামাইর সঙ্গে বিদেশে থাকলেও লোক মারফত জামাইর দেশের বাড়িতে ইফতারির জন্য টাকা পাঠান অথবা ইফতারি প্রদান করতেও শুনা যায়। শুধু রমজানেই নয়! সেই সাথে জ্যৈষ্ঠ মাসে মৌসুমে ফলও পাঠাতে হয় নতুন জামাইয়ের বাড়ি। যাকে বলে “আম-কাঁঠলি”।
উপজেলার নারিকেল তলা গ্রামের প্রবীণ সালিশি ব্যক্তি আতিক উল্লাহ দৈনিক সিলেটকে বলেন, এটি আমাদের একটি সংস্কৃতি। বহু বছর ধরে চলছে। অনেক পরিবারই আনন্দদের সঙ্গে এটি করে থাকেন। তবে জুলুম করে নয়, যার যার সামর্থ্যানুযায়ী করা ভালো।
জগন্নাথপুর উপজেলা নাগরিক ফোরামের সিনিয়র সদস্য আলী আহমদ বলেন, “বর্তমান বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম। এতে ফুরির বাড়ি ইফতারি পাঠানো খুবই ব্যয়বহুল। ধনীরা দিতে পারবে, তাঁদের তো টাকার অভার নেই কিন্তু দরিদ্র পরিবারগুলোর পক্ষে এটি সম্ভব নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজ ইচ্ছায় কেউই ফুরির বাড়ি ইফতারি পাঠায় না! মেয়ের সম্মান রাখতে বা নির্যাতন থেকে বাঁচাতে এ ইফতারি পাঠানো হয়ে থাকে।”
ইকড়ছই জামেয়া ইসলামিয়া হাফিজিয়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার শিক্ষক সাইফুল ইসলাম রিপন বলেন, ‘এটি এখন প্রথার চেয়ে বোঝা হয়ে পড়েছে! বর্তমান আধুনিক যুগে এ প্রথা বন্ধ করা হোক। এটি এক ধরনের যৌতুক। যা আইন বা ইসলাম গ্রহণ করে না’।