নির্বাচন পরবর্তীতে থমথমে কোম্পানীগঞ্জ
![](https://dainiksylhet.com/images/icon.jpg)
কোম্পানীগঞ্জ প্রতিনিধি
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী মজির উদ্দিন ও পরাজিত প্রার্থী শামীম আহমদ শামীম এর সমর্থকদের মধ্যে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
২১ এপ্রিল নমিনেশন দাখিলের পরদিন থেকেই প্রচার প্রচারণায় নামেন সকল প্রার্থী। তাদের মধ্যে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ শামীম এবং সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক মো. মজির উদ্দিনের সমর্থক বেশি ছিলেন৷ তাদের দুজনের মধ্যে শুরু হয় জয়ের লড়াই। কোম্পানীগঞ্জের ইতিহাসে এইবারই প্রথম প্রচারণার সময় এক প্রার্থী অন্য প্রার্থীকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও বানিয়ে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা অপকর্মের কথা প্রকাশ্যে বলেন ও হুমকি ধামকি দেন।
যার ফলশ্রুতিতে নির্বাচনের দিন ২১মে অনেকে প্রার্থীই তার নিজ আয়ত্বের ভিতরে থাকা ভোট কেন্দ্রে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা করেন। প্রশাসন কঠোর থাকায় তা সম্ভব হয়নি। বিকালবেলায় ফলাফলে আনারস মার্কা প্রতীকের মো. মজির উদ্দিন ২৮ হাজার ২শ ৭৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন৷
শামীম আহমদ শামীম সাহেবের সমর্থনকারী ৩নং তেলিখাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী আব্দুল অদুদ আলফু মিয়ার নির্বাচনী প্রচারণার সময় চাটিবহর গ্রামে বক্তব্য দিয়ে জাতীগত একটি বিভেদ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। শামীম আহমদ শামীম চেয়ারম্যানও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব নজিবুর রহমান, সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, সিলেট জেলা পরিষদের সদস্য আফতাব আলী কালা মিয়া এবং চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক মো. মজির উদ্দিনকে বিভিন্ন অকথ্য ভাষায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পরে মনের ভিতরে কষ্ট পুষিয়ে রাখা মজির উদ্দিন সমর্থকেরা কাজী আব্দুল অদুদ আলফু চেয়ারম্যানকে নিয়ে স্লোগান দিয়েছিলো হৈ হৈ রৈ রৈ আলফু গেলো কই…।
এসব স্লোগানের পরেই আলফু চেয়ারম্যান ও শামীম চেয়ারম্যান সমর্থকেরা মো.মজির উদ্দিনের সমর্থকদের বিভিন্ন ভিডিও বার্তা, ফেইসবুক পোস্ট, মেসেঞ্জারে মেসেজ ও মজির উদ্দিনের মোবাইলেও কল দিয়ে হুমকি দেন।
ফলাফল প্রকাশের পরের দিন ২২ এপ্রিল বুধবার আলফু চেয়ারম্যান সমর্থকেরা উপজেলার থানা বাজারে মো. মজির উদ্দিন সমর্থকদের দোকানপাটে গিয়ে হুমকি দিয়ে মারধর করেন। পাড়ুয়া শামীম আহমদ শামীম চেয়ারম্যান এর এলাকায় মজির উদ্দিনের সমর্থনকারীদের ক্রাশার মিল থেকে পাথর ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে যান এবং উপজেলার টুকের বাজার থেকে তেলিখাল আসার সময় মজির উদ্দিন সমর্থনকারী লামাডিস্কীবাড়ির একজন ও তেলিখাল গ্রামের একজনকে লাচুখাল নামক স্থানে আলফু চেয়ারম্যান সমর্থকেরা মটরসাইকেলসহ আটক করে মারধর করেন। এ নিয়ে মজির উদ্দিন সমর্থকেরা মেইন রোডে দুপুর ২টায় শান্তিপ্রিয়ভাবে রাস্তা অবরোধ করে রাখেন। প্রশাসনের কাছে তাদের দাবী ছিলো ব্যবসায়ীরা যেনো নির্বিঘ্নে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন, কাউকে যেনো হয়রানি না করা হয় রাস্তা অবরোধ করে তাদের দাবী যানান।
এর পর দুপক্ষের লোকজনের মাঝে খবর ছড়িয়ে পড়লে জড়ো হতে থাকেন তাদের সমর্থকরা। তেলিখালে মজির উদ্দিনের বাড়ির সামনে জড়ো হন তাঁর সমর্থকরা। অপরদিকে তেলিখাল ইউনিয়ন পরিষদের সামনে আলফু চেয়ারম্যান সমর্থকেরা ও পাড়ুয়া গ্রাম থেকে শামীম আহমদের সমর্থকরা একত্রে জড়ো হন। এসময় দু’পক্ষের মাঝে টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে বিকাল ৪টায় উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও বিজিবি দুপক্ষকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
পপরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরবর্তী সময়ে শামীম আহমদ শামীম নামীয় ফেইসবকু আইডি থেকে লাইভে এসে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খান ও জেলা পরিষদের সদস্য আফতাব আলী কালা মিয়া ও সদ্য বিজয়ী চেয়ারম্যান মো. মজির উদ্দিনকে গালাগালি করেন। সেই ভিডিওটি মুহুর্তেই নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়।
তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডির লাইভে এসে বলেন, ‘আজকে মজির উদ্দিন (বিজয়ী চেয়ারম্যান) ও তাঁর ভাই রমিজসহ যেভাবে আমাদের আলফু চেয়ারম্যানের (তেলিখাল ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি) ভাই আলী হোসেনকে হুমকি দিয়েছে, এই হুমকির জবাব কোম্পানীগঞ্জবাসী দেবে। আমরা যদি হেরেও যাই, তাইলে আমাদের মনোবল আরও শক্ত আছে। আমাদের কাউকে মারলে আমরাও এর সঠিক জবাব দেব। আলফু চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমরা থানাবাসী আছি।’
এ সময় বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘আপ্তাব আলী কালা মিয়ারে বইলা দিলাম এই উত্তরাঞ্চলের মানুষ ঐক্যবদ্ধ আছে। এই উত্তরবঙ্গে তোমারে আমরা ল্যাংটা কইরা দিমু । আপ্তাব আলী কালা মিয়া তুমি শুনিয়া রাখো, তোমারে আমরা এই পশ্চিম ইসলামপুর থাকি তোমার প্যান্ট-শার্ট খুলিয়া ছাড়মু। আইজ আমরা প্রতিজ্ঞা করছি আপ্তাব আলী কালা মিয়া, তুমি বলেছ মটকা ঠান্ডা হয়ে গেছে। মটকা ঠান্ডা হয় নাই। এতদিন আছলাম চেয়ারম্যান, ওখন চেয়ারম্যান নায়। ওখন আগর শামীম লুঙ্গী ফিন্দিয়া আর প্রতিজ্ঞা করেছি তোমাকে ল্যাংটা কইরা এই উত্তরাঞ্চল থাকি ছাড়মু, ইনশাআল্লাহ। তুমি জানিয়া রাখিয়ো তোমার দোকানো ওখন নায় দেখো, শেষ দেখো। দেখেন হাবির দোকানে আমাদের মানুষ অবস্থান করেছে। তোমারে আমরা ল্যাংটা করিয়া কোম্পানীগঞ্জবাসী ইনশাআল্লাহ ছাড়মু। আলফু চেয়ারম্যান আর আমরা যদি জীবিত থাকি, তোমারে ল্যাংটা কইরা উদলা ছাড়মু।’
লাইভ ভিডিওতে শামীম আরও বলেন, ‘আমরার ইলেকশন নষ্ট হইবো করি তোমারে জুতাদি পিঠাইছি না। আমি নীরব আসলাম, নাইলে তোমারে জুতা দি ফিটলো ওনে মাইনষে। আপ্তাব আলী কালা মিয়া তুমি হুঁশিয়ার থাকো। ইনশাআল্লাহ আমাদের যে যে কর্মী যে যে জায়গায় আছইন, কোনো ধরনের ভয়ভীতি করবেন না। প্রশাসনরে কইরাম যেকোনো পরিস্থিতি আমরা রাজপথে মোকাবিলা করবো।’
শামীম আহমদ বলেন, ‘আর নাসির খান (সিলেট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) তোমারে হুঁশিয়ার করি দিরাম, তুমি সাবধান হইয়াও। আমরার কোম্পানীগঞ্জবাসীরে তুমি অশান্ত কইরো না। আইজ কোম্পানীগঞ্জবাসী আনোয়ারুজ্জামানের (সিলেট সিটি মেয়র) নেতৃত্বে, হাবিব (সিলেট-৩ আসনের এমপি) ভাইয়ের নেতৃত্বে, নাদেল (মৌলভীবাজার-২ আসনের এমপি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক) ভাইয়ের নেতৃত্বে, রনজিত সরকারের (সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি) নেতৃত্বে আমরা বিশাল সমাবেশ করবো। আমরা কোম্পানীগঞ্জবাসী দেখিয়ে দিবো কোম্পানীগঞ্জের মাটি, আনোয়ারুজ্জামানের ঘাটি। হাবিব সাবের ঘাঁটি, কোম্পানীগঞ্জের মাটি, নাদেল ভাইয়ের ঘাঁটি কোম্পানীগঞ্জের মাটি, রনজিত সরকারের ঘাঁটি কোম্পানীগঞ্জের মাটি। ইনশাআল্লাহ এই সবতার জবাব দিবো জনগণ লইয়া। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সঙ্গে সঙ্গে আপনারা অস্ত্র সহকারে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।’
লাইভ ভিডিওটি ঘণ্টা দেড়েক পরে নিজের ফেসবুক আইডি থেকে সরিয়ে ফেলেন শামীম। তবে এরমধ্যে অনেকেই সংগ্রহ করে পোস্ট করতে থাকেন। ভাইরাল হয়ে গেলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। এই ভিডিওর পরে উপজেলার ছনবাড়ী গ্রামের একজনকে গাছে লটকে পিটানোর হুমকি দেওয়ার একটি অডিও কল রেকর্ড ভাইরাল হয় শামীম আহমদ শামীমের।
আফতাব আলী কালা মিয়াকে গালাগালির কারনে আফতাব আলী কালা মিয়ার সমর্থকেরা পরাজিত প্রার্থী শামীম আহমদ শামীমকে পাল্টা জবাব দিয়ে আরেকটি লাইভ ভিডিও করে শামীম আহমদ শামীমকে হাবীর দোকানে আমন্ত্রণ জানায়৷
এসকল ঘটনার পরে কোম্পানীগঞ্জে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি গোলাম দস্তগীর আহমদ বলেন, খবর পেয়ে আমরা সাথে সাথে ঘটনাস্থলে যাই এবং যান চলাচল স্বাভাবিক করি। কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই পুলিশ উপজেলা প্রশাসন ও বিজি দু’পক্ষকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এরপরে পুলিশের একাধিক টহল টীম ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়। অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করে আইনী পদক্ষেপ নেওয়া হবে৷