বঙ্গবন্ধুর ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতিই বাংলাদেশের উন্নয়নের চালিকা শক্তি
![](https://dainiksylhet.com/files/uploads/2024/06/e5-1.jpg)
ড. এ কে আব্দুল মোমেন এমপি
দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় শেখ মুজিব ছিলেন কলকাতা ইসলামীয়া কলেজের ছাত্র। তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নির্মমতা প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেন। খুব কাছ থেকে অনুভব করেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট। আর পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের প্রতি জুলুম নির্যাতনের প্রতিরোধের আন্দোলনে তিনি তো সম্মুখ যোদ্ধা। এমন অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ আইনানুগ সমাধানের নীতি গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর ঘোষণা করলেন স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রনীতি। বঙ্গবন্ধু সারাজীবনই ছিলেন অহিংস, মানবপ্রেমী, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আর শান্তিপ্রিয়। তাই তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতেও প্রাধান্য পেলো, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ প্রতিপাদ্য। তিনি চেয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতির কোনো জোট নয়, বাংলাদেশ হবে শান্তিপূর্ণ, হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড।
সকলের সঙ্গে আন্তরিক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে স্বাধীন জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ, অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সমতা, ভৌগলিক অখন্ডতা, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, পৃথিবীর নানাপ্রান্তে, বিভিন্ন সীমানার প্রত্যেকটি দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এ কাজটি খুব সহজ ছিল না। কারণ, আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে প্রতিবেশী ভারত সর্বোতভাবে সাহায্য করে। ভারতের বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের জন্য বারবার ভেটো দিয়েছে। অপরপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাদের বিরোধিতা করে পাকিস্তানকে অস্ত্র-শস্ত্র গোলাবারুদ দিয়ে গণহত্যায় সাহায্য করে। সুতরাং অনেকের ধারণা ছিল সদ্য স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সোভিয়েত ব্লকের অনুসারী হবে। তবে বঙ্গবন্ধুর সুদূর প্রসারী জ্ঞান, ধীশক্তি ও স্বাধীনচেতা হৃদয়ের প্রতিফলন ঘটে বাংলাদেশের ‘‘জোট নিরপেক্ষ’’ জোটে সদস্য পদ অর্জন এবং ‘‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’’ – এমন পররাষ্ট্রনীতিতে। যা আজও বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির মূল চালিকা শক্তি ও মূলমন্ত্র।
বাংলাদেশের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির নির্দেশনা রয়েছে। এই নির্দেশনাসমূহ সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে:
(ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন;
(খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং
(গ) সা¤্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশে^র সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।
তাঁর কূটনৈতিক দর্শন ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ম ও প্রখর। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টনের ফর্মুলা নির্ধারণে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ভাটির দেশ হিসেবে গঙ্গার পানি ৪৪ হাজার কিউসেক হিস্যা পাওয়ার সম্মতি তিনি আদায় করেন বাংলাদেশের পক্ষে। পানি বন্টনের এই উদ্যোগের ফলে ১৯৬৮-৬৯ সালের ১১ হাজার শক্তিচালিত পাম্পের স্থলে ১৯৭৪-৭৫ সালে পাম্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজারে। এর ফলে সেচের আওতাধীণ জমির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ লাখ একরে উন্নীত হয়। গঙ্গা নদীর পানি প্রবাহ থেকে অধিক পানি প্রাপ্তি, সেচ ব্যবস্থার প্রসার, ভর্তুকি দিয়ে অধিক হারে উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত খাস জমি প্রাপ্তি ২৫ বিঘার জমির ওপর দেয় কর মাপ এবং মূল্য সমর্থণমূলক সচেতন ও কৃষকবান্ধব নীতির ফলে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সময়ে, তার ফলস্বরূপ আজও এদেশে কৃষিক্ষেত্রে শক্তিশালী ধারা বজায় রয়েছে। তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই ধারাকে আরও বেগবান করেছেন।
ভারসাম্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ
ভারতের সাথে বাংলাদেশের স্বকীয়তার সম্পর্ক
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে প্রত্যাশিত সহযোগিতা মিলেনি চীনের কাছ থেকে। আবার, মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে ভারত। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, শরণার্থীদের আশ্রয়দানসহ সম্মুখ সমরে ভারতের অবদান সবসময় মনে রাখার মতো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও পুনর্গঠনে ভারতের কাছ থেকে সবধরণের সহযোগিতা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এদিকে ভারত ও চীনের বৈরী সম্পর্কের কথাও কারো অজানা নয়। তা সত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ দুটির সঙ্গে সমানতালে চমৎকার সম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। এটি সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির সফল অনুকরণের মাধ্যমে।
স্বাধীনতার সময় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের অনুকূলে ছিল তা ঠিক বলা যাবে না। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব- এই দুই বলয়ে বিভক্ত ছিল পুরো বিশ^। এর ফলে অহেতুক অনেক দেশ নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়তো। আবার, আন্তর্জাতিক মহলের কেউ কেউ আমাদের টিপ্পনিও কাটতো। তাদের দৃষ্টিতে আমরা ছিলাম বেপরোয়া। কেননা, সে সময়ে পাকিস্তানের মতো দেশ থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। তাদের ধারণা ছিল, এতে আমাদের কপালে আমরা কুঠোর মারলাম, ভবিষ্যতে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো না। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোরও কেউ কেউ ব্যথিত ছিল। তাদের মতে, বাংলাদেশ হয়তো মুসলিম বিশে^ বিভক্তি সৃষ্টি করবে। কেননা, পাকিস্তানের মতো বড় মুসলিম দেশ থেকে বের হয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দাঁড়ানো মুসলিম উম্মাহর একতাবদ্ধতার বিপরীত। এ কারণে স্বাধীনতা পাওয়ার পরও পরিচিত ও সুসম্পর্ক থাকা অনেক দেশের স্বীকৃতি পেতে বাংলাদেশকে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বুদ্ধিমত্তার সাথে দূরদর্শী ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করেন। যার ফলে বাংলাদেশ সবগুলো দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে সক্ষম হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের প্রতি বরাবরই শ্রদ্ধাশীল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে দিল্লীতে ফিরে বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন ভারতের শক্তিশালী অবদানের কথা। বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ও ভারতের ভ্রাতৃত্ববন্ধন চিরকাল অটুট থাকবে।’’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নীতির মিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এটা হচ্ছে আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের মিল।’’ তবে এর মানে এই নয় যে, তিনি অন্ধভাবে ভারতের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। তা বোঝা যায়, লন্ডন থেকে বাংলাদেশে তাঁর প্রথম যাত্রায় তিনি বিনয়ের সাথে ভারতীয় বিমান ব্যবহারের আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে ব্রিটিশ বিমান ব্যবহার করেন।
স্বাধীনতা পাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রতিশোধপরায়ণতা নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিলেন অনেকে। তবে, সব ধারণার অপনোদন করে শান্তির ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় এক নাগরিক সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘‘আমরা শান্তিকামী বলে এই উপমহাদেশে আমরা আপস-মীমাংসানীতির অনুসারী।’’
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বঙ্গবন্ধু প্রথম সরকারি সফরে যান। ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর সম্মানে দেওয়া এক নাগরিক সংবর্ধনায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সুস্পষ্ট প্রশ্ন করে জিজ্ঞাসা করে বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় যেসব সৈন্য বাংলাদেশের প্রয়োজনে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল, তারা কবে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহৃত হবে।’’ এর প্রত্যুত্তরে সমালোচকরা আশা করেছিল, ভারত হয়তো বাংলাদেশের ওপর নাখোশ হবে, সৈন্যদের অবস্থান দীর্ঘায়িত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইবে ভারত। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী স্বভাবসুলভ চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যেই বঙ্গবন্ধুর এমন আহবানকে স্বাগত জানান। পরবর্তীতে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আগেই ভারতীয় সেনাদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহৃত করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম দেশই আছে যেখানে ৬০ দিনের মাথায় বিদেশী বিজিত সৈন্য বিদায় নেয় এবং এ সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের জন্য। আর ইন্দিরা গান্ধী ১৭-১৯ মার্চ বাংলাদেশ সফর করেন। ১৯ মার্চ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক মৈত্রী চুক্তি সাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা আর সার্বভৌমত্ব অটুট রাখার বিষয়ে দুই দেশের একমত হওয়ার ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের বড় সাফল্য। এতে বলা হয়, এক দেশ আরেক দেশের স্বাধীনতা আর আঞ্চলিক অখন্ডতার প্রতি সম্মানপ্রদর্শন করবে। কোনো দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। কোনো দেশই কারও প্রতি আক্রমণ বা এ ধরণের অভিযান পরিচালনা করবে না। নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বা সামরিক কোনো অভিযান পরিচালনার মতো পদক্ষেপ থেকে দেশগুলো বিরত থাকবে।
এই চুক্তি যখন গ্রহণ করা হয়, তখন বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের অনেকেই এর কঠোর সমালোচনা করে একে নতজানু নীতি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কথিত সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকরাও এর সমালোচনায় গলা চড়ান। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘‘অনেকে ভারতীয় চক্রান্তের কথা বলে থাকেন। যারা আমাদের দুর্দিনে সাহায্য করেছে তারা নাকি আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের পকেটে ফেলে রাখবার চেষ্টা করছে। এ ধরণের কথা বলা কি সাংবাদিকতার স্বাধীনতা? এর নাম কি গণতন্ত্র?’’ পরবর্তীতে দেখা যায়, ক্ষমতার পালাবদলে যখন বিরোধী পক্ষের কেউ কেউ ক্ষমতায় আসীন হয়, তখন তারা নিজেদের আগের মত থেকে সরে গিয়ে এই চুক্তিতেই অটল থাকে। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী প্রজ্ঞার পরিষ্ফুটন দেখা যায়। এ যেন ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার নাগরিক সংবর্ধনার সেই বক্তব্যেরই প্রতিফলন। বঙ্গবন্ধুর সে সময়ের উক্তি ছিল, ‘‘আমার একান্ত কামনা, উপমহাদেশে অবশেষে শান্তি ও সুস্থিরত আসবে। প্রতিবেশীদের মধ্যে পারস্পারিক বিরোধিতার বন্ধ্যা নীতির অবসান হোক। আমাদের জাতীয় সম্পদের অপচয় না করে আমরা যেন তা আমাদের দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানউন্নয়নে ব্যবহার করি। দক্ষিণ এশিয়াকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করায় আমরা সচেষ্ট রইব, যেখানে আমরা সুপ্রতিবেশী হিসেবে পাশাপাশি বাস করতে পারি এবং যেখানে আমাদের মানুষের মঙ্গলার্থে আমরা গঠনমূলক নীতিমালা অনুসরণ করতে পারি। যদি আমরা সেই দায়িত্বে ব্যর্থ হই, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।’’
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমানা চুক্তি স্বাক্ষর হয় ১৯৭৪ সালে। সে সময় ভারত সরকার বাংলাদেশকে কিছু ভূখন্ড ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। সেই চুক্তি সাক্ষরের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘ডব সঁংঃ নব ধনংড়ষঁঃবষু ংঁৎব ঃযধঃ, ঃযবৎব ধিং হড় ঢ়ৎড়ংঢ়বপঃ ড়ভ মধং ড়ৎ ড়রষ রহ ঃযব ংবপঃড়ৎং বি যধফ ধমৎববফ ঃড় ফবসধৎপধঃব’’.
২৫ বছর মেয়াদী এই মৈত্রী চুক্তির ভীত রচিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনেই। ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো চীনে অনুষ্ঠিত বিশ^শান্তি সম্মেলনে অংশ নেন। এর কয়েকবছর পর ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয়বার শান্তিসম্মেলনে অংশ নেন। এই সম্মেলনের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে। বইয়ের ১১৯ নং পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, ‘‘… আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়। ’’
সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারসাম্য
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২ থেকে ৬ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সফর বাংলাদেশের উদীয়মান পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অপরিসীম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এই সফরে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বড়ধরণের কয়েকটি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়, যা বাণিজ্যক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তবে, সহযোগিতা গ্রহণ কিংবা পারস্পারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সংযমী ছিলেন বঙ্গবন্ধু, গাম্ভীর্য্যপূর্ণ ছিল তাঁর পররাষ্ট্রনীতি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সারাদেশে অনেক মাইন পোতা ছিল। বিশেষ করে বন্দর, বাসস্ট্যান্ড ও রেল স্টেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধুকে প্রস্তাব দেয়, চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দরের মাইনমুক্ত করতে দেশটি সহযোগিতা করতে চায়। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় এসে রুশ নৌসেনারা টহল দিবে, বিষয়টি সংযতভাবেই দেখেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাদের কেবল চট্টগ্রাম বন্দর মুক্ত করার দায়িত্ব দেন। আর চালনা বন্দরের দায়িত্ব পায় জাতিসংঘ। আসলে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ক্ষমতার বলিয়ান বলেই সে সময় তিনি বিচক্ষণতার সাথে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
বরফ গলতে শুরু করে চীনের সঙ্গে
স্বাধীন হবার পরও বাংলাদেশের প্রতি চীনের বিদ্বেষী নীতি কার্যকর থাকে। ১৯৭২ সালের ৮ আগস্ট জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভের জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। কিন্তু চীনের বিরোধিতায় ১০ আগস্ট তা নাকচ হয়ে যায়। এনিয়ে ক্ষোভও ঝরে পড়ে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক অধিবেশনে ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেন, ‘‘ইতিহাস বড় তাৎপর্যপূর্ণ। যখন চীনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ভেটো দেওয়া হতো তখন এই বাংলার মানুষই বিক্ষোভ করতো। আমি নিজে ওই ভেটোর বিরুদ্ধে বহুবার কথা বলেছি। যে ভেটোর জন্য চীন ২৫ বৎসর জাতিসংঘে যেতে পারে নাই, দু:খের বিষয়, সেই চীন ভেটো ‘পাওয়ার’ পেয়ে প্রথম ভেটো দিলো আমার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তবুও আমি কামনা করি তাদের বন্ধুত্ব। অনেক বড় দেশ। দুশমনি করতে চাই না। বন্ধুত্ব কামনা করি। কারণ আমি সকলের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু জানি না, আমার এই কামনায়, আমার এই প্রার্থনায় তাঁরা সাড়া দিবেন কি না। যদি না দেন কিছু আসে যায় না। ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা এত ছোট দেশ নই। বাংলাদেশ এতটুকু নয়। পপুলেশনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ দুনিয়ার অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র।’’ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা পররাষ্ট্রনীতি ফুটে উঠে। তবে আরও কৌশলী ও সতর্ক হয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সময়েই চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়ে যায়। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে চীনা রেড ক্রসের একটি দল সফর করে বাংলাদেশের বন্যার্ত অঞ্চল। তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় এক মিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা। আর স্বীকৃতি না দিলেও পঁচাত্তরের মে মাসে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ।
এখানে সে সময়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ১৯৭৪ সালে আমি সে সময়কার বাণিজ্যপ্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর একান্ত সচিব হিসাবে কাজ করি। কয়লা, লবণসহ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদানের বেশিরভাগই আমরা সে সময় ভারত থেকে আমদানি করতাম। সেবার কয়লা ও লবণ কেলেঙ্কারি হলো। এর ফলে ভারত থেকে কয়লা আমদানি অনিশ্চিত হয়ে পড়লো। যথাসময়ে জ¦ালানি সরবরাহের লক্ষ্যে আমরা কয়লা সরবরাহে আন্তর্জাতিক একটা টেন্ডার আহবান করি। এতে চীনও অংশ নেয়। যদিও চীন তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। চীন বললো, গুণগত মানের কয়লা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তারা সরবরাহ করতে পারবে। কিন্তু বেঁকে বসলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাদের যুক্তি, পরিবহণ খরচ বেশি হবে। বিষয়টির সুরাহার জন্য আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। বঙ্গবন্ধু দাম বেশি হওয়া সত্বেও চীন থেকে কয়লা আমদানির বিষয়টি অনুমোদন করে দিয়ে বললেন, ‘‘ব্যবসা হলে সম্পর্কও হবে’’। এর কিছুদিন পরে ভারতের নয়াদিল্লীতে ঊঝঈঅচ সম্মেলন হয় এবং ওই সম্মেলনের সময়ে চীনের মন্ত্রী ও আমাদের মন্ত্রীর বৈঠক হয়। যা মন্ত্রী পর্যায়ে চীনের সাথে প্রথম আলোচনা। এর ফলে বরফ গলতে থাকে। ১৯৭৪ সালের জুনে জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভের সময় সরাসরি বিরোধিতা থেকে বিরত থাকে চীন, ভেটো প্রদান থেকে বিরত থাকে।
আমেরিকার লুকোচুরি
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমেরিকার ভূূমিকা আমাদের স্বপক্ষে ছিল না। যদিও সেদেশের বহু হৃদয়প্রাণ ব্যক্তিত্ব অনেক আইন-প্রণেতা ও বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের যুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগ্রহ করেছেন, যুদ্ধাগ্রস্ত দেশের মানুষের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেছেন। আমেরিকান কবি এলেন গিন্সবার্গ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই তো লিখে ফিললেন বিখ্যাত ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সেই মার্কিন মুল্লুকের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিলেন। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে আমেরিকা সফরে যান বঙ্গবন্ধু, প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড আর ফোর্ডের সঙ্গে ১ অক্টোবর হোয়াইট হাউজে মিটিং করেন। ফোর্ড বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানালেও খানিকটা রক্ষণশীল ভঙ্গিতে বলেন, ‘‘আপনাদের স্বাধীনতা লাভ ও জাতিসংঘের সদস্য পদ অর্জনের জন্য আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই।’’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘‘আমরা একটি দরিদ্র দেশ কিন্তু আমরা আপনাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই।’’ এই সফর দীর্ঘ মেয়াদে সুসম্পর্কের বীজ যে রোপিত হয়।
মুসলিম দেশসমুহের সঙ্গে ভ্রাত্বের বন্ধন
স্বাধীনতা লাভের মাত্র তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশ ১২৬টা দেশের স্বীকৃতি অর্জন করে। এত অল্প সময়ে এতগুলো দেশের স্বীকৃতি পাওয়া মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। স্বীকৃতির মানে হলো ওইসব দেশ বাংলাদেশকে পূর্ণ সার্বভৌম দেশ হিসেবে পরিগণিত করে।
শুরুর দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে আরব ও মুসলিম দেশগুলো খানিকা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। কারণ, পাকিস্তানের মতো বড় মুসলিম দেশ থেকে বের হয়ে গিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা ভৌগলিক আয়তনের ছোট্ট এই দেশটির ভবিষ্যত কীই বা হতে পারে- এমন দোলাচল ছিল তাদের। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও অল্প সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক যোগাযোগ তাদের আশ্বস্ত করতে সক্ষম হয়। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সের জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে ইসরায়েলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ মতামত তুলে ধরেন যা তাঁকে সম্ভাব্য বিশ্ব মুসলিম নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। আরবদের সমর্থন করায় বাংলাদেশের প্রতি আরবদেশগুলোর অগাধ আস্থা তৈরি হয়। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় আরবদের প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসাবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি মেডিকেল টিম পাঠানো হয়। প্রায় কাছাকাছি সময়ে যুদ্ধরত মিসরীয় সেনাবাহিনীর জন্য এক লাখ পাউন্ড চাও পাঠানো হয়। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া এক বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, ‘‘আমরা আজ গর্বিত যে, মধ্যপ্রাচ্যে আমরা আরব ভাইদের এবং প্যালেস্টাইনবাসীদের পাশে রয়েছি। ইসরাইলীরা তাদের ন্যায্য অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে। ইসরাইলীরা জাতিসংঘের প্রস্তাব মানে নাই। তারা দখল করে বসে আছে আরবদের জমি। আমি আরব ভাইদের একথা বলে দেবার চাই এবং তারা প্রমাণ পেয়েছে যে, বাংলার মানুষ তাদের পেছনে রয়েছে। আরব ভাইদের ন্যায্য দাবীর পক্ষে রয়েছে। আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সাহায্য করবো।’’
১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ৩২তম দেশ হিসাবে ইসলামি সম্মেলন সংস্থা-ওআইসির সদস্যপদ লাভ করার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি পরিণত মর্যাদা লাভ করে। এই সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ করে। এটি ছিল ওআইসির দ্বিতীয় সম্মেলন। এই সম্মেলনটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। কেননা, বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দেন যে, পাকিস্তান আগে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে বাংলাদেশ এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবে না। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ওপর ওআইসিভুক্ত দেশগুলো থেকে প্রচ- চাপ পড়ে। পাকিস্তান রাজি হলেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর বিচার প্রক্রিয়া। এবং কয়েক হাজার পাকিস্তানে আটকে পড়া বাংলাদেশী নাগরিকদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। পরে সোমালিয়ার মধ্যস্থতায় বিষয়টির সমাধান হয়। এছাড়া প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতও কোনোভাবেই চাচ্ছিল না যে, লাহোরের ওই সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করুক। এই ইস্যুতে কয়েকবার ভারতীয় হাইকমিশনার আমার মন্ত্রীর সঙ্গে এসে দেখা করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কাউকে কিছু না বলে নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেন। এটি ছিল তাঁর দৃঢ় ও স্বাধীনচেতা নেতৃত্বের বহি:প্রকাশ। ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে রাজী হওয়ায় পর কয়েকজন ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে তাদের উড়োজাহাজে করেই বঙ্গবন্ধুকে লাহোর নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে লাহোর বিমানবন্দরে যথাযথ অভ্যর্থনা জানানো হয়, মর্যাদা ও গুরুত্ব দেয়া হয়। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আঞ্চলিক সহযোগিতার আহবান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু আগেই বলেছিলেন, ‘‘আমরা শান্তিকামী বলে এই উপমহাদেশে আমরা আপস-মীমাংসানীতির অনুসারী। আমাদের দৃঢ় বিশ^াস, বাংলাদেশের অভ্যূদয় উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার সহায়ক হয়েছে এবং অতীতের সংঘাত ও বিরোধের বদলে আমাদের তিনটি দেশের জনগণের মধ্যে কল্যাণকর সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। অতীত থেকে মুখ ফিরিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছি।’’ স্বাধীনতার পরপরই এমন ঘোষণা একজন পরিপক্ক ও দূরদৃষ্টি রাষ্ট্রনায়কেরই প্রতিচ্ছবি। বিশেষ করে, তখনও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা অসুস্থ শরীর নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন, যখন স্বামীহারা বধুর কপালের সিঁদুর তখনও মুছেনি; ফুরোয়নি ছেলে হারা মায়ের কান্নাও। এমন বাস্তবতার মধ্যেই শান্তিু প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর এমন বক্তব্য বিশ^ ইতিহাসে অনন্য। আর এই বক্তব্যের মধ্যেই নিহিত আঞ্চলিক সহযোগিতার অনন্য নিদর্শন। এর ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে সার্ক প্রতিষ্ঠা হয়।
উদীয়মান বিশ^ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় অল্প সময়েই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক দরবারে শান্তির মডেল হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে চিলির রাজধানী সান্তিনিয়াগোতে বিশ^ পরিষদের প্রেসিডেনসিয়াল কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধুকে ‘‘জুলিও কুরি’’ পদক দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। ১৯৭৩ সালের মে মাসে বিশ^ শান্তি পরিষদ ঢাকায় দুদিন ব্যাপী সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় বঙ্গবন্ধুকে ‘‘জুলিও কুরি’’ পদক পড়িয়ে দেওয়া হয়। পদক পড়িয়ে দেওয়ার সময় বিশ^ শান্তি পরিষদের সে সময়ের মহাসচিব রমেশ চন্দ বলেন, ‘‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ^ বন্ধুও বটে।’’ বঙ্গবন্ধুও তাঁর ভাষণে বলেন, ‘‘বিশ^শান্তি আমার জীবনদর্শনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত, শান্তি ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যে কোন স্থানেই হোক না কেন, তাঁদের সাথে আমি রয়েছি। আমরা চাই, বিশে^র সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এই শান্তি স্থাপনের অগ্রদূত। আজকে জাতিসংঘের দদটঘ চবধপশববঢ়রহম’’ এ বাংলাদেশ একটি ব্র্যান্ড। বিশ^জুড়ে স্থিতিশীল শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ হাসিনার ‘শান্তির সংস্কৃতি’ বা দদঈঁষঃঁৎব ড়ভ চবধপব’’ বিশে^র সবগুলো দেশ ও সংস্থা গ্রহণ করেছে।
১৯৭৩ সালের গ্রীষ্মকালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত হয় জোটরিপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) শীর্ষ সম্মেলন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই সম্মেলনে দু’দফা বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু। ৮ সেপ্টেম্বর স্বাগত ভাষণে সারা বিশে^র মুক্তিকামী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আজও অব্যাহত ভিয়েতনাম, এঙ্গোলা, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, গিনি বিসাওসহ ল্যাতিন আমেরিকা ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। তাই একটি বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়তে আমাদের সবাইকে এক হয়ে শোষিতের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।’ সম্মেলনের ফাঁকে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী বিশ^নেতার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু। এই সম্মেলনের সময় সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল, প্রেসিডেন্ট টিটো, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফিসহ অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠক করেন।
পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর বিদায়ী ভাষণেও বঙ্গবন্ধু বিশ^শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘উপমহাদেশকে শান্তিপূূর্ণ রাখতে হলে, যে কোন সমস্যার মানবিক সমাধান খুঁজতে হবে। একটি সমৃদ্ধ বিশে^র জন্য আমাদের পরমাণু নিরস্ত্রি¿করণের ওপর জোর দিতে হবে। আমি আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই এখানে এক হওয়ার জন্য। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সদস্য দেশগুলোর পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার প্রত্যয় দেশগুলোর সামাজিক সমৃদ্ধি আনতে পারে।’ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দিতে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর জোর সমর্থনের কথা অন্তর্ভূক্ত করা হয়। পরের বছর ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। ২০২১ সালের জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে আমি অংশগ্রহণ করি। আমি অভিভূত হই, সেখানকার সেই অডিটোরিয়ামের পাশের দেয়ালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ন্যাম সম্মেলনে উপস্থিতির উপর বড়সড় সাইজের ছবিসহ বক্তব্য স্থাপন করা হয়েছে। কিউবার প্রতিনিধি (যিনি ১৯৭৩ সালের সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন) বললেন, আমি যে চেয়ারে বসে কথা বলছি, সেখানে বসেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে ন্যাম সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছিলেন। আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, বহু রাষ্ট্রনায়ক এই সম্মেলনে যোগদান করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এতই বড় মাপের নেতা ছিলেন যে, তাঁর স্মৃতি ধারণ করে আমরা এই দেয়ালে তার প্রতিকৃতি তুলে ধরেছি। দুদিন পর আমাদের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী এই সম্মেলন কক্ষে এলে তাকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সম্বলিত এই দেয়াল আমি দেখাই এবং গর্ববোধ করি।
জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু
১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে বালাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম স্বাধীন দেশ হিসেবে সদস্য পদ লাভ করে পরিচিতি পায় বিশ্বজুড়ে। ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বিশদ আকারে তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘‘চূড়ান্ত বিজয়ে ইতিহাস যে জনগণ ও ন্যায়ের পক্ষেই যায়, এইসব বিজয় এই কথাই প্রমাণ করিয়াছে। কিন্তু বিশে^র বহু অংশে এখনো অবিচার ও নিপীড়ন চলিতেছে। অবৈধ দখলকৃত ভূখন্ড পুরোপুরি মুক্ত করার জন্য আমাদের আরব ভাইদের সংগ্রাম অব্যাহত রহিয়াছে এবং প্যালেস্টাইনি জনগণের বৈধ জাতীয় অধিকার এখনো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয় নাই। উপনিবেশ বিলোপ প্রক্রিয়ার যদিও অগ্রগতি হইয়াছে কিন্তু এই প্রক্রিয়া এখনো চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছায় নাই, বিশেষ করিয়া আফ্রিকার ক্ষেত্রে এই সত্যটি স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। এই অঞ্চলের জিম্বাবুয়ে (দক্ষিণ রোডেশিয়া) এবং নামিবিয়ার জনগণ জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়তার সাথে লড়াই করিয়া যাইতেছে। বর্ণবৈষম্যবাদ, যা হোক মানবতার বিরোধী বলিয়া বার বার আখ্যায়িত করা হইয়াছে তাহা এখানে আমাদের বিবেককে দংশন করা অব্যাহত রাখিয়াছে।’’
বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় বঙ্গবন্ধুর পদচারণা
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায়ই বলতেন, ‘বিশ্বটা দুইভাগে বিভক্ত। এক দিকে রয়েছে শোষক, অন্যভাগে শোষিত। আমি শোষিতদের দলে।’ বিশ্বের যেকোন প্রান্তের যে কোন ধর্ম বা বর্ণের মানুষের ওপর শোষণ বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে তিনি কখনো দ্বিধা করেননি। তাঁকে তুলনা করা হতো হিমালয়ের সঙ্গে। তিনি আফ্রিকার বর্র্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন; অবসান চেয়েছেন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিক্য়া বিদেশি শাসনের। বঙ্গবন্ধু যেমন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাতœা প্রকাশ করেছেন, তেমনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সাইপ্রাস সরকারকে উৎখাতের নিন্দাও করেছেন। ভিয়েতনামে আমেরিকার বোমাবাজি বন্ধের দাবিও জানায় বাংলাদেশ তাঁর আমলেই। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার আগের পুরোটা সময় তিনি উল্কার মতো ছুটে চলেছেন বিশ্বজুড়ে। নিজে যেমন বাংলাদেশের উন্নয়নের মিশন নিয়ে ভ্রমন করেছেন বিভিন্ন দেশ, তেমনই বাংলাদেশেও এসেছে বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, সরকার প্রধানগণ।
বঙ্গবন্ধু সরকারের সফল কূটনৈতিক পদচারনা ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের ক্যারিশমায় স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মধ্যেই ১৯৭২ সালের ১৭ মে বাংলাদেশ আইএমএফের সদস্যপদ লাভ করে। একই বছরের ২২ জুন আইএলও, ২০ সেপ্টেম্বর আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়ন, ১৯ অক্টোবর ইউনেস্কো, ৬ নভেম্বর কলম্বো প্ল্যান, ৯ নভেম্বর গ্যাটোর সদস্য পদ লাভ করে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মুক্তি আন্দোলনে অনবদ্য ভূমিকা পালন করায় ১৯৭২ সালের ২৩ নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্যাট্রিস লুলুম্বা বিশ^বিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুকে শান্তিপদক প্রদানের ঘোষণা দেয়। পরের বছর ১৯৭৩ সালের ৯ ফেব্রুযারি জাতিসংঘের মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়ার্ল্ডহেইম গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেন ২৫ মার্চ। বঙ্গবন্ধু ২৬-৩১ জুলাই প্রেসিডেন্ট জোসিপ ব্রোজ টিটোর আমন্ত্রণে যুগোস্লাভিয়া সফর করেন। সফরকালে প্রেসিডেন্ট টিটো ন্যাম ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থণ জানান। বঙ্গবন্ধু অটোয়ায় ২-১০ আগস্ট অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে কানাডা সফর করেন। ১৮ অক্টোবর সাত দিনের এক সফরে টোকিও গমন করেন বঙ্গবন্ধু। ওই বছরে তিনি স্বল্প সময়ের জন্য মালয়েশিয়া সফরেও গিয়েছিলেন। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রনায়ক তুন আব্দুর রহমান তাঁেক অকুন্ঠ সমর্থন দেন।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নরম্যান এরিক কার্ক বাংলাদেশ সফর করেন ১৯৭৪ সালের শুরুর দিকেই। আর ২৯ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসিপ ব্রোজ টিটো। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন। মার্চ মাসে বাংলাদেশে এক সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতিকালে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মার্চ মাসে চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু মস্কো যান। এপ্রিলের শেষে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ইউ নে উইন বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমানা চুক্তি সাক্ষর হয় ১৯৭৪ সালের ১২ মে’র ওই সফরে। সেনেগালের প্রেসিডেন্ট লিওপোল্ড সেংঘর ২৬-২৯ মে বাংলাদেশ সফর করেন। ১ জুন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ভুটানের রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুকের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ১৫ জুন পাঁচ দিনের সফরে ঢাকা আসেন। ওই মাসেই বাংলাদেশ সফর করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট নগুয়েন হু থু ঢাকায় এক সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেন। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু ইরাক সফরে যান। ওই মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার ঢাকা সফরে আসেন। বঙ্গবন্ধু ৫ নভেম্বর মিসর ও ১০ নভেম্বর কুয়েত সফরে যান। একই মাসে পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় আসেন। ৩ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার রাজা ঢাকা সফরে আসেন। ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে যান। ডিসেম্বর মাসে ঢাকা সফরে আসেন ভুটানের রাজা এবং এফএও-এর মহাপরিচালক। ১৯ জুলাই বাংলাদেশ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আর্চবিশপ মাকারিয়সের নেতৃত্বে সাইপ্রাস সরকারকে উৎখাতের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। বাংলাদেশ ২২ অক্টোবর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রথম অংশগ্রহণ করেই জাতিসংঘ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহিষ্কারের দাবি জানায়। বাংলাদেশ আগস্ট মাসে ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়। নভেম্বরে জাপান ও বাংলাদেশ যমুনা নদীর ওপর একটি তিন মাইল দীর্ঘ সেতু নির্মাণের স্থান চূড়ান্ত করে। ১৯ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে নামিবিয়া বিষয়ক কমিশনে মনোনয়ন দেয়। এর সবই ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের কূটনৈতিক মিশনের ফল এমনকি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি ও বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা তাঁর কারণেই সম্ভব হয়।
একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন নির্ভর করে দেশটির নেতৃত্বের রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ওই দেশের সম্পর্কের সমীকরণের ওপর। পররাষ্ট্রনীতির সফলতার জন্য শুধু শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করলেই চলবে না, এর সফল বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী নেতৃত্ব থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন শক্তিশালী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর দিক নির্দেশনায় আজকে বিশে^র প্রায় সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এর ভিত্তিও রচনা করে গেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
শেষ হইয়াও যা হইলো না শেষ
জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে জুলাই ১৯৭৫, মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০ টির মতো রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের সফরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক সফর অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু সরকারের সফল কূটনৈতিক তৎপরতায়। ওই স্বল্প সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতার নানা বিষয়ে ৭০ টির বেশি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। অনেক দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশকে কোটি কোটি ডলারের ঋণ, সাহায্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করে এবং স্বীকৃতি প্রদান করে আরো বিভিন্নমুখী সহযোগীতার। এ সময় বাংলাদেশ এডিবি, আইসিএও, ইকাফ, এবং ফাও এর সদস্য পদ লাভ করে। সবার সাথে বন্ধুত্ব রক্ষার যে মিশন নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন, কয়েক বছরের মধ্যেই তার শতভাগ সুফল ভোগ করতে থাকে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতেই সৌদি আরব, সুদান, ওমান ও চীন ছাড়া বিশ্বের সব রাষ্ট্রই বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের জনসভায় প্রদত্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘‘আমি দুনিয়ার প্রত্যেক রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই, কারো সঙ্গে দুশমনি করতে চাই না। সকলের সাথে বন্ধুত্ব করে আমরা শান্তি চাই।’’
বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই বাংলাদেশ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মজিবুর রহমান ছিলেন এদেশের মানুষের সকল আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক। তাঁর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে যে অর্জন, যে পদচারণা, যে দীপ্ত পদভার তিনি রেখে গেছেন, তা সবই স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে বাঙালি জাতির ইতিহাসে। তাঁর প্রণীত পররাষ্ট্রনীতি আজও এদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক নিরুপণের আলোকবর্তিকা। জাতিসংঘে তিনিই সর্বপ্রথম ‘বাংলা ভাষায়’ বক্তৃতা করেন এবং তাঁর বক্তৃতায় যে ২৫টি বিষয় তিনি তুলে ধরেন সেগুলো আজো বিশে^র বিবেচ্য বিষয়। তাঁর দেখানো মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই উন্নয়নের পথে এদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা, বিশ^দরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বলকারী এদেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও জাতিসংঘে ‘বাংলায়’ বক্তৃতা করে বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ববোধ, মানুষের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান এবং বিশ^শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ-প্রদর্শক হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ‘‘উবাবষড়ঢ়সবহঃ রং ধ ঐঁসধহ জরমযঃং’’, ‘‘জনগণের ক্ষমতায়ন উন্নয়নের সোপান’’, দদচবড়ঢ়ষবং ঊসঢ়ড়বিৎসবহঃ: অ চবধপব পবহঃৎরপ সড়ফবষ’’, এবং দদঈষরসধঃব ঈযধহমব এর ভয়াবহতা উন্নয়নের প্রতিবন্ধক’’ প্রস্তাবগুলো জাতিসংঘে গৃহিত হয়। তাছাড়া চবধপব শববঢ়রহম এ মেয়েদের সম্পৃক্তকরণের জন্য নিরাপত্তা পরিষদে জবংড়ষধঃরড়হ ১৩২৫ গৃহিত হওয়ার ফলে মেয়েদের ক্ষমতায়ন বাড়ে। উন্নয়নের মহাসড়ক থেকে কেউ বাদ পড়বে না দদঘড় ড়হব রং ষবভঃ নবযরহফ’’ এবং অক্ষম, বধির ও অটিস্টিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মহাসড়কে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়ে বিশে^র অন্যতম শ্রেষ্ঠ আসনে বাংলাদেশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় শেখ হাসিনার অঙ্গীকার
বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ অনুসরণ করে, নিজস্ব সৃজনশীলতা আর দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার আমুল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বপরিম-লে এক সময়ে ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশ বলে পরিচিত বাংলাদেশ আজ আর্বিভূত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচন নিশ্চিত করে একটি উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্র হওয়ার পথে জোরেসোরে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির দুটো ফোকাসিং পয়েন্ট হলো ইকোনোমিক ডিপ্লোমেসি এবং পাবলিক ডিপ্লোমেসি। এর সাথে যোগ হয়েছে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা। উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্থিতিশীলতার পাশাপাশি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও ব্যাপকভাবে প্রয়োজন। আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক ও শান্তি বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ এই বিষয়টাকে প্রাধান্য দিয়েই অগ্রসর হচ্ছে সামনে।
ইকোনোমিক ডিপ্লোমেসির সাফল্য
শেখ হাসিনার বর্তমান শাসনামলে অর্থনৈতিক কূটনীতির সাফল্যেও বড় প্রমাণ হচ্ছে, গত এক বছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশের সমকক্ষ দেশগুলোর কেউই সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণে এমন সাফল্য পায়নি। এদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতির মূল লক্ষ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া ‘ভিশন-২০২১’ ও ‘ভিশন-২০৪১’ অর্জনে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, প্রবাসীদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করা, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করা এবং বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতিকে আরও গতিময় করা গুণগত উৎকর্ষ সেবা দানের মাধ্যমে সকলের আস্থা অর্জন করা। এই সবগুলো লক্ষ্যকে সামনে রেখে পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতি।
অন্যদিকে পাবলিক ডিপ্লোমেসির উদ্দেশ্য হলো, সামাজিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর সন্ত্রাস দমনে সরকারের অভাবনীয় সাফাল্য এবং বঙ্গবন্ধুর আতœত্যাগ ও শেখ হাসিনার ভিশনসমূহকে বিশ^বাসীর কাছে তুলে ধরা। যাতে বহির্বিশে^ বাংলাদেশের ইমেজ পরিবর্তিত হয় এবং বিশ^বাসী জানে যে বাংলাদেশ আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয় বরং বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট গন্তব্য। কারণ, বাংলাদেশের রয়েছে গতিশীল ও সমৃদ্ধিময় অর্থনীতি। অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিনিয়োগের পর রিটার্ন আসে দ্রুত। অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশের রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট তুলনামূলক খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশীদের নিয়ে, বিদেশের বিভিন্ন নামী-দামী বিশ^বিদ্যালয় ও কলেজকে সম্পৃক্ত করে, সে দেশের সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে বাংলাদেশের সাফল্যের কাহিনী প্রচার করে উন্নত ভাবমূর্তি অর্জন জনকৌটনীতির মূল লক্ষ্য। একাজটি করার জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি মিশনে “বঙ্গবন্ধু কর্ণার” চালু হয়েছে। যেমন এক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেকে জানা ও বুঝার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশনের বাইরে “ইউএসআইএস” প্রতিষ্ঠান ছিল, যারা মার্কিন জীবনধারা, তাদের ইতিহাস, তাদের অর্জন এবং তাদের গুণাবলীগুলো তুলে ধরতো। “বঙ্গবন্ধু কর্ণার” একইভাবে বাংলাদেশের অর্জন, বঙ্গবন্ধুর আতœত্যাগ, গণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রাম, ন্যায় বিচার ও মানবধিকার অর্জনের জন্যে ত্যাগ, ধর্মীয় সহিন্সনুতা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগের সুযোগ ও পরিবেশ, উন্নত অবকাঠামো, বিশাল কর্মক্ষম ও দক্ষ যুব সমাজ, আইটি ক্ষেত্রে স্বক্ষমতা, ইত্যাদি অর্থাৎ বাংলাদেশকে সম্ভাবনার অর্থনীতি হিসেবে বহির্বিশে^ জানান দেয়া। নাগরিকদের সৃষ্টিশীলতা ব্যবহার করে দেশের কাজে লাগানো। প্রবাসীরা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন বৈকি।
এর সাথে জরুরি বিষয়টি হলো আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা। দেশের অভ্যন্তরীণ অথবা বাইরের যে কোনো বৈরিতা মোকাবেলা করে দেশ এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা। কারণ কোনো অঞ্চল একবার অস্থির হয়ে উঠলে সেই এলাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হয়, সেই সমাজের শান্তি নষ্ট হয়। যার প্রভাব পড়ে অন্য সমাজ ও অন্য দেশেও। একটি শান্তিপূর্ণ দেশের স্থিতিশীল অবস্থাও নষ্ট হতে পারে পাশের দেশের অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে। আঞ্চলিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহযোগীতার মানসিকতা না থাকলে কোনো দেশের একার পক্ষে উন্নয়নের সুফল ভোগ করা সম্ভব না। তাছাড়া আমাদের উন্নয়নের অর্জনগুলোকে ধরে রাখতে এবং টেকসই করতে প্রয়োজন আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা। এ কারণে সব সময়ই বাংলাদেশ বৈরীতার নীতি পরিহার করে চলছে। বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত সকলের সাথে সুসম্পর্কের নীতিই এখনো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল বক্তব্য। এর ওপর ভর করেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক অঙ্গনে অর্জিত হয়েছে অভূতপূর্ব সব সাফল্য। এর সুফল হিসেবেই ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত স্থলসীমানা ও সমুদ্রসীমা শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পন্ন হয়েছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও ভারত স্থলসীমানা চুক্তি ১৯৭৪-এর প্রটোকল স্বাক্ষর এবং ২০১৫ সালে স্থলসীমানা চুক্তির অনুসমর্থন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদীর্ঘ প্রচেষ্টারই সুফল। ইন্সট্রুমেন্ট অব রেটিফিকেশন এবং লেটার অব মোডালিটিস স্বাক্ষরের মাধ্যমে তৎকালীন ১১১টি ভারতের ছিটমহল বাংলাদেশের এবং আমাদের ৫১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যায়। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে এর আগে নাগরিকত্বহীন ৫০,০০০ এর বেশি মানুষ তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নাগরিকত্ব লাভ করে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দিয়ে অনুসরণ করছে দেশের পররাষ্ট্রনীতি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট ভিশন নির্ধারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নতবিশ্বের তালিকায় উন্নীত করার লক্ষ্যে রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এর আলোকে কার্যকর ও যুগোপযোগী নীতি গ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকারের নীতি ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপসমূহ বিদেশি কূটনৈতিক মিশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম, সভা ও সেমিনারে তুলে ধরছে। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দা থাকা সত্ত্বেও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদারের কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান সরকারের দক্ষ নেতৃত্বে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৫ গুণেরও বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১১ বিলিয়ন থেকে ৫৫.৫৬ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে।
শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্ব ও সফল কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি হয়। ঐতিহাসিক এই নিষ্পত্তিতে বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র-এলাকার ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বিরোধ নিরসনে বিরল এ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানে উপনীত হওয়ার এ নীতি আন্তর্জাতিক আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রশংসিত করেছে। এ রায়ের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় সম্ভাবনাময় সকল সম্পদ আহরণের সক্ষমতাবৃদ্ধিতে ২০১৮ সালে ভারত ও চীনের সাথে ‘ব্লু ইকোনমি’ এবং ‘মেরিটাইম খাতের মান উন্নয়নে সহযোগিতা’ বিষয়ে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেই সাথে এই বিশাল জলরাশিতে যে সমস্ত সম্পদ রয়েছে তার সঠিক ব্যবহারের জন্য (উবষঃধ-২১০০) ১০০ বছরের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।
০২
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম কারণ হলো দেশের বর্তমান স্থিতিশীল রাজনীতি। সুদীর্ঘ ১৫ বছর ধরে সব ঝড়-ঝঞ্ঝা মোকাবেলা করে শক্ত হাতে দেশ চালাচ্ছেন শেখ হাসিনা। তার যোগ্য ও সুকৌশলী নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। অস্থিতিশীলতা একটা জাতিকে কতটুকু পিছিয়ে দিতে পারে, তার বর্তমান উদাহরণ হচ্ছে, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইয়ামেন কিংবা লেবানন। এদেশ গুলোর জনজীবন ও উন্নয়ন এখন বাধাগ্রস্থ। শান্তি ও স্থিতিশীলতায় ভাটা পড়লে উন্নয়ন ব্যাহত হয়। আমাদের দেশেও এর প্রমান রয়েছে। ’৭৫-এর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কারণে বাংলাদেশ ৩০ বছরের জন্য পিছিয়ে পড়ে। বাংলাদেশ যে ৪টি মূল স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই দর্শনের অন্যতম একটি হলো গণতন্ত্র, যা ধ্বংস হয়ে গেল ১৫ আগস্টের ভোররাতে। গণতন্ত্র হয়ে গেল সামরিক গণতন্ত্র। তার সাথে মানুষের দৌরগড়ায় গুনগত উন্নত সেবা পৌছিয়ে দেয়ার জন্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার যে “জেলায় জেলায় জেলা সরকার” প্রবর্তন করেন, তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে কাক্সিক্ষত সুফলটা পাওয়া যায় নি। ফলে জনগণের সবধরণের সেবা পাওয়ার জন্য এখনো মানুষকে কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। যদিও বর্তমান সরকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে আন্তরিক হয়ে কাজ করছে। সামরিক শাসন একা চলতে পারে না। যখনই তার সঙ্গে প্রহসনের নির্বাচনের মতো গণতন্ত্রের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়, তখন তা এতই বিপজ্জনক হয় যে, একটা রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। ১৯৭৫ এর পরে বাংলাদেশের অবস্থাও হয়ে পড়েছিল সেইরকম। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বহু বাধা পেরিয়ে আজ বর্তমান অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। যে কোনো সংগঠন, প্রতিষ্ঠান- এমনকি রাষ্ট্রের উন্নয়নের মূল ভিত্তি হল স্থিতিশীলতা। সেই স্থিতিশীলতা আসে জনগণের মৌলিক শিক্ষা, দেশপ্রেম, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন জরুরি চিকিৎসাসেবা এবং ক্ষুধা নিবারণের মাধ্যমে। শেখ হাসিনার সরকার এর প্রত্যেকটি বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন সামনে।
স্থিতিশীল রাজনীতি একটি দেশকে কেমন করে উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো এশিয়ার অন্যতম দেশ মালয়েশিয়া। ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে দেশটি। মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশ। যার মোট আয়তন ৩,৩০,০০০ বর্গকিলোমিটার। মোট ১৩ টি প্রদেশ এবং তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চল নিয়ে গঠিত এ দেশের জনসংখ্যা ৩২.৭ মিলিয়ন। মাথা পিছু আয় ১২,১৫০ মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে উন্নত রাষ্ট্র ঘোষণা করার টার্গেট অর্জন করতে সক্ষম না হলেও ২০৩০ সালে উন্নত রাষ্ট্র ঘোষণা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। চীন, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ড এর জল ও স্থল সীমান্ত ঘেরা মালয়েশিয়ার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রয়েছে শক্তিশালী অবস্থান।
মাহাথির মোহাম্মদ যেদিন মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, সেদিন দেশটি ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র রাষ্ট্র। তখন তার মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১৩০ ডলার। জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ২৫ শতাংশ। শিক্ষিতের হার ছিল ২০ শতাংশ। জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ ছিল শহরবাসী ও শিল্পনির্ভর। কিন্তু দীর্ঘ ২২ বছরের শাসন শেষে মাহাথির যেদিন স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়েন, সেদিন দেশটির মাথাপিছু আয় ছিল ৩ হাজার ৩৩০ ডলার। শিক্ষিতের হার ৯৯ শতাংশ। পুরুষদের গড় আয়ু ৭১ বছর, নারীদের ৭৬ বছর। ১৯৮১ সালের ১৬ জুলাই ৫৫ বছর বয়সে ডা. মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একটানা ২২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ৭৭ বছর বয়সে ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ও রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। একটি পক্ষ সব দেশেই থাকে, যাদের কাজ হলো শুধু সমালোচনা করা। কিন্তু উন্নয়নের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সব সময় সব সমালোচনা গায়ে মাখলে চলবে না। নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক রেখে দৃঢ়ভাবে পথ চলতে হবে, মাহাথিরের দীর্ঘ শাসন মূলত সেই জিনিসটাই দেখিয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে।
স্থিতিশীল রাজনীতির সুফল ভোগকারী আরেকটি ছোট্ট দেশ হলো সিঙ্গাপুর। এশিয়ার ‘চার বাঘ’ খ্যাত ছোট দেশগুলোর একটি হলো সিঙ্গাপুর। বাকি তিন দেশ হচ্ছে হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান। সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অর্থনীতির র্যাঙ্কিংয়ে সিঙ্গাপুর যুক্তরাষ্ট্র ও হংকংকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করা সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিজনেস স্কুল আইএমডির র্যাঙ্কিং এমনটা জানাচ্ছে। একেকটি দেশ টেকসই প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং নাগরিকদের কল্যাণ কর্মসূচি বৃদ্ধির পরিবেশ কতটা নিশ্চিত করতে পারছে, তা বিশ্লেষণ করে এ ক্রম সাজানো হয়ে থাকে। র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে সিঙ্গাপুরের উঠে আসার পেছনে দেশটির সরকারের স্থিতিশীলতা, উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক অবকাঠামো, দক্ষ শ্রমিকের প্রাপ্যতা, অনুকূল অভিবাসন আইন এবং নতুন নতুন ব্যবসার সুপরিকল্পিত উদ্যোগ কাজ করেছে। প্রশ্ন হলো সিঙ্গাপুরের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি অতি ক্ষুদ্র দেশ যেখানে কাঁদা আর সমুদ্রের খোলা আকাশ ছাড়া কিছুই ছিল না সেটা অর্থনৈতিকভাবে এত উচ্চতায় উঠে এল কীভাবে?
সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় দলটি হলো পিপলস অ্যাকশন পার্টি। ১৯৫৪ সালে একটি ছাত্রসংগঠন থেকে স্বাধীনতাপন্থী এ দলের জন্ম হয়েছিল। দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি টানা তিন দশক সরকারপ্রধান ছিলেন। দীর্ঘ তিন দশকের শাসনামলে নিজের প্রচেষ্টা ও যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে এক প্রজন্মেই সিঙ্গাপুরকে তৃতীয় বিশ্ব থেকে প্রথম বিশ্বে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এ কারণে তাঁকে জাতির স্থপতি বলা হয়। লি কঠোরভাবে ও সুশৃঙ্খলভাবে একদলীয় শাসন ধরে রেখেছিলেন। স্থিতিশীল একদলীয় শাসন দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মসৃণভাবে এগিয়ে নিতে পেরেছিলেন। যেভাবে লি একক হাতে দেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করেছেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন, তা যদি বারবার হাত বদল হতো, তা কখনোই সম্ভব হতো না হয়তো। এখনো তাঁর ছেলে শক্ত হাতে দেশকে বিশে^র অভাবনীয় সাফল্যের দেশে পরিনিত করে চলেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম উন্নত দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির মানুষের বর্তমান মাথাপিছু আয় ৩৭,৪৯৭ মার্কিন ডলার। জিডিপির আকার ৪২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আধুনিক এ আরব আমিরাতের রূপকার ছিলেন শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। বর্তমান সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সামাজিক উন্নয়নের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি তার সুদীর্ঘ ১৮ বছরের শাসনামলে। ২০০৪ সালে দেশটির প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণ করে ২০২২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এ দীর্ঘ সময়ে দেশকে ঢেলে সাজিয়েছেন ইচ্ছে মতো।
স্থিতিশীল রাজনীতির সুফল ভোগকারী অপর দুটি দেশ হলো কম্বোডিয়া ও রুয়ান্ডা। রুয়ান্ডাকে বর্তমানে বলা হয় সিঙ্গাপুর অব আফ্রিকা। বিগত দুই দশকে রুয়ান্ডার অর্থনীতি ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। বিশেষ করে দেশটি শিল্পায়নের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। এক সময় যে রুয়ান্ডার মানুষ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সাথে নিয়মিত লড়াই করতো, উপনৈশিকদের সৃষ্টি জাতিগত বিভেদ; হোটি ও টুসসির আতœঘাতি ‘‘আত্মহত্যা’র কারণে ভবিষ্যত ছিল অন্ধকার, তারা এখন স্বপ্ন দেখছে উন্নত ও আধুনিক জীবনের। রুয়ান্ডার মানুষকে এ স্বপ্ন দেখিয়েছন দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট পল কাগামী বস্তুত ১৯৯৬ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে এখনো দেশটি শাসন করছেন । তার এ দীর্ঘ ২৬ বছরের শাসনে (উপরাষ্ট্রপতি ও রাষ্ট্রপতি) পুরো চেহারাই বদলে গেছে রুয়ান্ডার অর্থনীতির। মানুষের আয় যেমন বেড়েছে, বেড়েছে জীবন যাত্রার মানও। অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত মান অর্জনের পথে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে রুয়ান্ডা। কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে একইরকম চিত্র। দেশটির প্রধানমন্ত্রী হুন সেন ১৯৯৮ সাল থেকে এখনো দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। কম্বোয়িার অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। তার দীর্ঘ ও স্থিতিশীল শাসনামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে কম্বোডিয়ার অর্থনীতি।
০৩
পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আর সুষম উন্নয়নের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা একান্ত জরুরি। তবে শুধু একটি দেশের স্থিতিশীলতা নয়, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও থাকতে হবে। কেননা, এক দেশের অশান্তি অন্য দেশকে আক্রান্ত করে। সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বরাবরই স্বক্রিয় ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুও গভীরভাবে অনুধাবন করতেন, উন্নয়নের জন্য শান্তি অপরিহার্য। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আমলে যে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে, তার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে হাতে হাতে। বিগত ১৫ বছরের ধারাবাহিক শাসনামলে শেখ হাসিনা সরকার দেশকে উন্নতির চরম শিখরের দিকে নিয়ে চলেছেন। এক সময় যা অকল্পনীয় ছিল এ দেশে, তা এখন পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের ঘরের দোরগোড়ায়। স্বাধীনতার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৫৫ শতাংশ। বতর্মানে দারিদ্র্যর হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। বতর্মান সরকার কর্তৃক দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য বিভিন্ন ভাতা চালু, তাঁদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি – যেমন আশ্রয়ণ প্রকল্প, ঘরে ফেরা, কম্যুনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মত কর্মসূচি দারিদ্র্য বিমোচন এবং প্রান্তিক মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। কৃষক ও কৃষি-বান্ধব নীতি গ্রহণের ফলে দেশ দ্রুত খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে শেখ হাসিনার সরকার বিএনপি-জামায়াত এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২ বছরের আর্থিক ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা কাটিয়ে এবং সেই সময়কার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় এক নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে একটি সুপরিচিত নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার অর্জনের পাশাপাশি নানা সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ, শিক্ষার হার ও গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ তার দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশিদেরই শুধু নয়, অনেক উন্নত দেশকেও ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। মাথাপিছু আয় ১২০০ মার্কিন ডলার অতিক্রম করায় বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে নি¤œ-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার, ২০২১ সালে তা ২ হাজার ৮১৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র্যহারের ব্যাপক অগ্রগতি সূচিত হয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ। বর্তমানে সেই দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮.৭ শতাংশে এবং অতি দরিদ্রের হার ৫.৬%। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসেব মতে ২০১০ সালে দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসরত কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ছিল ৭৩.৫ শতাংশ। ২০১৮ সালে তা ১০.৪ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে স্থান দিয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশের প্রমাণ মেলে তার বার্ষিক আর্থিক পরিকল্পনায়। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বিএনপি সরকারের শেষ বছরে বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৬১ হাজার কোটি টাকা। শেখ হাসিনা সরকারের ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটের আকার দাড়িয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা রয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয়। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছে। পদ্মা সেতুর মত দেশের বৃহত্তর ব্রীজ নিজের টাকায় করে আতœবিশ^াস অনেক উর্দ্ধে নিয়ে গেছে, পাবনার রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন অর্জনের জন্য ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ নামে শতবর্ষের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলো সম্পৃক্ত করে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজও শুরু হয়েছে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ একটি গতিময় ও দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্বেও দরবাওে মর্যাদা লাভ করেছে। এই সময়ের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৭ শতাংশের বেশি ছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬০ টাকা। মোট দেশজ উৎপাদনের মানদন্ডে ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ৩৩তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।
০৪
একসময় প্রবল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের চাপে পিষ্ট হতে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ছোটোখাটো অভিঘাত এই অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি এখন বাংলাদেশ। আইএমএফ-এর হিসেব অনুযায়ী পিপিপি’র ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থান ৩০তম। প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারস-এর প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৪০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বে ২৩তম স্থান দখল করবে। এইচ.বি.এস.সি’র প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভারতসহ এশিয়ার দেশগুলো থেকে এগিয়ে থাকবে।
১৫ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে বিরাট ব্যবধান। সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে সর্বস্তরের মানুষের। দেশের পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে হয়েছে প্রভূত উন্নয়ন। প্রমত্তা পদ্মা নদীর উপর সেতু দিয়ে গাড়িতে করে মানুষ দক্ষিণাঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে সহজেই। এর ফলে অর্থনীতির প্রসার ঘটছে দ্রুত। বৈদেশিক কোনো সহায়তা ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। রাজধানীর যানজট নিরসনে দেশের প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। পাতালরেল নির্মাণের সম্ভ্যাবতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চন্দ্রা মহাসড়ক চার-লেনে উন্নীত করার পর চন্দ্রা-বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশন, বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম স্টেশন-রংপুর এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ছয়লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। নূতন রেলপথ নির্মাণ, নূতন কোচ ও ইঞ্জিন সংযুক্তি, ই-টিকেটিং এবং নূতন নূতন ট্রেন চালুর ফলে রেলপথ যোগাযোগে নব দিগন্তের সূচনা হয়েছে। দেশের সকল জেলাকে রেল যোগাযোগের আওতায় আনা হচ্ছে। বিমান বহরে ৬টি নতুন ড্রিম লাইনার যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সক্ষমতা আরো বেড়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। দেশের প্রতিটি গ্রামে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। টেকসই বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য রামপাল, মাতারবাড়ি, পায়রা ও মহেশখালিতে মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিশোর ও যুব সম্প্রদায়ের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রতিটি উপজেলায় মিনি স্টেডিয়াম এবং অডিটোরিয়াম নির্মাণ করা হচ্ছে। দেশজুড়ে স্থাপিত সাড়ে আঠার হাজার কম্যুনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থসেবা আজ সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে সুযোগ সুবিধা। খাদ্যশস্য, মাছ এবং মাংস উৎপাদনে স্বয়ং-সম্পূর্ণতা এসেছে। চাল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ৪র্থ এবং মাছ ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। সকলের জন্য সুশিক্ষা নিশ্চিতকরণের জন্য প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত প্রতি বছর ২ কোটি ৩ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি, উপ-বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর শতবার্ষিকী উদযাপনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রত্যেক লোককে যাদের নিজস্ব বাড়ীঘর নেই, তাদের বাসাবাড়ী দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন-কেউ গৃহহীন থাকবে না এবং ইতিমধ্যে ১৪ লক্ষের অধিক জনকে বাড়ী দেয়া হয়েছে।
০৫
উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হলো দেশে স্থিতিশীলতা থাকা। প্রতিবেশীদের সাথে ভালো সম্পর্কের ফলে বাংলাদেশের উন্œয়ন হচ্ছে। আমরা শান্তি চাই, যুদ্ধ চাই না। বিশৃঙ্খলা চাই না। উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। শান্তির জন্য, উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা চাই। গণতন্ত্রের নামে কথিত হরতাল, জ¦ালাও- পোড়াও কর্মসূচি, হাঙ্গামা, আন্দোলন মূলত দেশের উন্নয়ন ধারাবাহিকতা নষ্ট করে। আন্দোলন করলে করতে হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, শান্তিপূর্ণভাবে। সব রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশের উন্নয়ন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জ¦ালাও-পোড়াও গণতন্ত্রের হাতিয়ার নয়। ইয়ামেন, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া এসব দেশ এখন অস্থিতিশীল পরিস্থিতির চূড়ান্ত ফল ভোগ করছে। তাদের পুরো অর্থনীতি বলা চলে ভেঙে পড়েছে। মাথাপিছু আয় কমে গেছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বেড়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকারত্ব বরণ করেছে। শিল্প বাণিজ্য সব মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। ২০১৭ সালে লিবিয়াতে দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর তাদের মাথাপিছু আয় প্রায় ৬০ ভাগ কমে গেছে। ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত তাদের প্রায় ৭৮৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে কেবল আভ্যন্তরিণ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে। আফগানিস্তানের অবস্থাও হয়েছে তাই। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার ফলে লক্ষ লক্ষ আফগানি কর্মহারা হয়ে বেকারত্ব বরণ করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসার মতো অতি জরুরি পরিষেবা ব্যবস্থা এক প্রকার ভেঙে পড়েছে। আফগানিস্তানে জিডিপির মোটামুটি ৪০ ভাগই বৈদেশিক সাহায্য। কিন্তু তালিবানদের ক্ষমতাগ্রহণের পর সব রকম বৈদেশিক সাহায্য-সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে দেশটির সাধারণ মানুষ স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ সময় অতিক্রম করছে। ইরাকের ক্ষেত্রেও আমরা একইরকম চিত্র দেখেছি। যুদ্ধ এবং আভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এক সময়ের বিপুল সম্ভাবনাময় ইরাকের অর্থনীতিকে একেবারে বসিয়ে দিয়েছে। আমরা সেই অবস্থা কখনো কামনা করি না আমাদের দেশে। এ কারণেই আমরা সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে চাই। সবার সাথে বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলতে চাই। যেকোনো মূল্যে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। তাহলে খুব সহজেই এক দেশের স্থিতিশীলতার সুফল পাবে পাশর্^বর্তী দেশসমূহ।
সম্প্রতি আসামের মূখ্যমন্ত্রীও দ্যর্থহীন কণ্ঠে সেই কথাই বলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা আছে বলেই তার ছোঁয়া লেগেছে আসামেও। সম্প্রতি আমি আসামের মূখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করি। তখন মূখ্যমন্ত্রী বললেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তার কারণে আমরা নানাদিক থেকে লাভবান হয়েছি। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর যেভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন, কোনো প্রকারের সন্ত্রাস তিনি সহ্য করবেন না মর্মে যে নীতি গ্রহণ করেছেন, তা আমাদের মুগ্ধ করেছে”। তার কারণে বাংলাদশ কখনোই সন্ত্রাসীদের আবাসস্থলে পরিণত হবে না। সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থানের কারণে। তার এই বক্তব্য ও নীতির কারণে আমরাও লাভবান হয়েছি। এখন বাংলাদেশের মতো আসাম, মেঘালয়েও আর তেমন কোনো সন্ত্রাসী তৎপরতা নাই। আঞ্চলিক সন্ত্রাসী কার্যক্রম একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। সন্ত্রাসী তৎপরতা না থাকায় বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি এখন আসামের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, বিনিয়োগের জন্য আসছে। আগে যেখানে একটা দুইটা হাসপতাল ছিল, এখন সেখানে ১৭টা নতুন হাসপাতাল গড়ে উঠছে, তাও আবার প্রাইভেট সেক্টরে। অনেক উন্নয়ন হয়েছে এখানে। এ জন্যে আমরা শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আগে বাংলাদেশ রুট ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা সেখানে হামলা করতো- এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে।
আসামের মূখ্যমন্ত্রী বলেছেন উন্নয়নের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা খুব দরকার। এই স্থিতিশীলতা যেন আমরা বজায় রাখতে পারি পুরো দক্ষিণ এশিয়াতে, ভারত, বাংলাদেশ সব জায়গায়, সেটা আমাদের একটি মূখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কারণ স্থিতিশীলতা থাকলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে না। স্থিতিশীলতা থাকলে শুধু একটি দেশের না, প্রতিবেশী রাষ্ট্রেরও উন্নয়ন হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে বলেই সাম্প্রতিক সময়ে বছরে প্রায় ২৮ লাখ মানুষ ভারতে সফর করছে, তাতে ভারতের পর্যটন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগ লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশ আজ উন্নত হয়েছে বলেই ভারতের অনেক মানুষ বাংলাদেশে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। স্থিতিশীলতার কারণেই এগুলো সম্ভব হয়েছে। এ কারণেই স্থিতিশীলতাটা জরুরি।
০৬
বাংলাদেশ সব সময় স্থিতিশীলতার পক্ষে সোচ্চার ও সরব অবস্থানে রয়েছে। কারণ আমাদের এখানে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার মতো দেশী বিদেশী নানা চক্র যেমন আছে, তেমনই আছে ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা। রোহিঙ্গা হলো হতাশাগ্রস্ত স্টেটলেস জাতি। তারা যেকোনো সময় অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে ফেলতে পারে। দেশের বাইরে থেকে তাদের ইন্ধন দেওয়া হতে পারে। আন্তর্জাতিক শক্তিও তাতে জড়িত থাকতে পারে। এর আগে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি বাইরের শত্রুদের ইন্ধনে কী ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। শ্রীলংকায় এক প্রকার লঙ্কাকা- বাঁধিয়ে ফেলেছিল তামিলরা। বিভিন্ন বিদেশী শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে লিবারেশন টাইগার অব তালিম ইলমের সদস্যরা দেশব্যাপী ব্যাপক নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। দেশজুড়ে গুপ্ত হত্যা, জ্বালাও- পোড়াও, হামলা-হাঙ্গামা বাধানোই ছিল তাদের কাজ। দেশের অভ্যন্তরে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে তারা শ্রীলংকার ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে সে সময়। বর্তমানে যদিও তাদের কার্যক্রম অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু একেবারে নির্মুল হয়ে গেছে তা বলা যাবে না। আমরা সব সময়ই সোচ্চার আছি তামিলদের মতো রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে কোনো পক্ষ যেন দেশের অভ্যন্তরে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে। আগামীর পৃথিবী হবে এশিয়ার। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশ ও গৌষ্ঠি এশিয়া প্যাসিফিকের দিকে অধিকতর নজর দিচ্ছে। চীনের ‘‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’’ উদ্যোগ ছাড়াও মার্কিন সরকারের “ঊধংঃ ছঁধফ”, “ডবংঃ ছঁধফ” এবং ১৪টি দেশের সমন্বয়ে ওহফড় চধপরভরপ ঊপড়হড়সরপ ঋড়ৎঁস (ওচঊঋ) তৈরী হয়েছে। তাছাড়া অঝঊঅঘ ও ঈড়ষড়সনড় ঝবপবৎরঃু ঈড়হপধাব ও তৈরী হয়েছে। ইউরোপিয়ান-চাইনিজ-মার্কিনীরা বহুবিধ উদ্যোগ নিচ্ছে। চাইনিজরা “এষড়নধষ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ওহরঃরধঃরাব” (এউও) চালু করেছে। এইসব বিভিন্ন তৎপরতায় বাংলাদেশকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অগ্রসর হতে হবে। বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে এসবের টিপিং পয়েন্টে রয়েছে। সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ে দেখা গেছে যে, বড় বড় শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। যার ফলে এষড়নধষ ঝঁঢ়ঢ়ষু ঈযধরহ ধহফ এষড়নধষ ঋরহধহপরধষ ঞৎধহংধপঃরড়হ বাধাগ্রস্থ হয়। এসব থেকে মুক্ত থাকার জন্যে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা (জবমরড়হধষ চবধপব ধহফ ঝঃধনরষরঃু) রক্ষা করা অতীব প্রয়োজন।
বাংলাদেশ কোনো আইজোলেটেড আইল্যান্ড নয়। অন্যদেশে যখন সাধারণ জনগণ নির্যাতিত হয়, বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতবর্ষে, তখন এখানেও তার প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশ ও ভারতে উভয় দেশেই কিছু উগ্রপন্থী লোক আছে যারা কখনো কখনো কোনো কোনো বিছিন্ন ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাফায়ে তিলকে তাল বানিয়ে প্রচার করে। জনমনে আতঙ্ক ও বিশৃংখলা বা অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়Ñ এদের থেকে সাবধান। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য যা যা করা দরকার, তা উভয় দেশের করা উচিত বৈকি। শেখ হাসিনা প্রমান করেছেন যে, তিনি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ^াস করেন, তিনি শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতীক। সুতরাং তাঁকে কিংবা তাঁর আদর্শকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার তা আমাদের করতে হবে।
আমাদের ভুললে চলবে না যে ২০০১-২০০৬ বাংলাদেশে বোমাবাজি ও সন্ত্রসীর যে তৎপরতা আমরা অবলোকন করেছি, “বাংলা ভাই” এর উত্থান,“জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ” (জে.এম.জে.বি) “হরকোতুল জিহাদ ইসলামী বাংলাদেশ” (হোজি.বি) ইত্যাদির উত্থান আমরা কি ভুলতে পারি? ২০০১ সালের নির্বাচনের পর পরই হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ্য হয় তাকি ভুলা যায়? একই দিনে দেশের ৬৪ জেলার ৬৩টিতে ৪৯৫টি বোমাবাজি হয়। ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী সিলেটের মাজারে গেলে তাঁর উপর বোমাবাজি হয়, যার ফলে তিনি আহত হন এবং দুজন মারা যান। জননন্দিত নেতা আহসান উল্লাহ মাষ্টার, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী এ এ এম শামসুল কিবরিয়া, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ ইউনূসকে হত্যা, ফাহিমা-সাবরিনা-মাহিমার উপর অত্যাচার, এমন কি আদালতের এজলাসে বোমাবাজি এবং সর্বোপরি তৎকালীন মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা যখন সন্ত্রাস, দূর্নীতি ও বোমাবাজির বিরুদ্ধে জনসভার আয়োজন করেন, তখন ২০০৪ সালের ২১শে আগষ্টে সেই র্যালীতে গ্রেনেড হামলা ও বোমাবাজির ফলে ২৪ জন সহকর্মী মারা যান, ৩৭০ জন আহত হন। যাদের অনেকেই এখনো জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। আমরা শেখ হাসিনার সরকারের আমলে সেই সব অসহনীয় নির্মম ও দুঃস্বপ্নের দিন থেকে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখনো সময় সময় সংখ্যালগু সম্প্রদায়ের উপর বাড়ীঘর ভাঁঙ্গার বিছিন্ন ঘটনা ঘটে। এগুলো যাতে আর কখনো না হয়, তার জন্য সরকার বদ্ধ পরিকর । তবে সরকারের হাতকে এবং বিশেষ করে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজন সকল শ্রেনী পেশার জনগণের সমর্থন ও সাহায্য। তাহলেই আমরা এসব কলঙ্ক দূর করে একটি শান্তিময় ও স্থিতিশীল দেশ গড়ে তুলতে পারবো।
তবে এটাও সত্য যে, বাংলাদেশের একার পক্ষে পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। অন্যান্য দেশের সহযোগীতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ প্রয়োজন। এ কারণেই আমরা অভ্যন্তরীন স্থিতিশীলতার পাশাপাশি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আঞ্চলিক দেশগুলোকে এক সাথে কাজ করতে হবে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের স্বার্থেই। বাংলাদেশের উন্নয়নে গতি ধারা ও অভাবনীয় অর্জন গুলোকে ধরে রাখতে এবং টেকসই করতে বাংলাদেশসহ প্রতিটি দেশের উন্নয়ন ও আঞ্চলিক শান্তির জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।
প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য অর্জনে সহযোগী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
বিগত কয়েক বছরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষত যে সমস্ত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ সদর দপ্তরসহ বিদেশস্থ সকল মিশনে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপন, গণহত্যা কেন্দ্র (জেনোসাইড সেন্টার) স্থাপন, জনকূটনীতির পদক্ষেপসমূহ, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দশদিনব্যাপী ‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠান আয়োজনে সক্রিয় অবদান, বঙ্গবন্ধু রিসার্চ সেন্টার ফর ফরেন পলিসি এন্ড ডিপ্লোম্যাসি স্থাপন, বঙ্গবন্ধু লেকচার সিরিজ প্রবর্তন, বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমেটিক এ্যাওয়ার্ড অফ এক্সসেলেন্স প্রবর্তন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ প্রবর্তন ও বঙ্গবন্ধু চেয়ার স্থাপন, বঙ্গবন্ধু-ইউনেস্কো এ্যাওয়ার্ড ফর ক্রিয়েটিভ ইকনমি, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে গত ডিসেম্বরে ঢাকায় ‘বিশ্ব শান্তি সম্মেলন’ আয়োজন, জাতিসংঘ এবং ছয়টি দেশের সাথে বঙ্গবন্ধু স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ, একাধিক বিদেশি ভাষায় বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশ এবং বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার জীবন, দর্শন ও বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতিতে অবদানের উপরে বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রকাশনা। এসব উদ্যোগের সমন্বিত প্রভাবে দেশের অভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনার বিস্তার ঘটানোর সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনই আর্ন্তজাতিক পরিম-লে বাংলাদেশকে আরো শক্তভাবে তুলে ধরবার পথ সুগম হয়েছে।
বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ আজ বাংলাদেশকে আরো গভীরভাবে জানার সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ভাষায় অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন, তার মতবাদ, তার ত্যাগ ও সংগ্রামের কথা পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের কাছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহুবিধ উদ্যোগের ফলে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম, বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ-তিতিক্ষা, বাংলাদেশের নীতি ও মূল্যবোধ এবং সেই সাথে এদেশের সর্বকালের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতির ধারাবাহিকতায় স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন কূটনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধসমৃদ্ধ বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতির অনুসরণে দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিবিড়করণসহ দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেখানে বড় পরিবর্তন ঘটেছে। কারণ বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক যে গুরুত্ব, সে গুরুত্বটি আমরা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পেরেছি। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে নতুন ধরনের ভূ-রাজনৈতিক লড়াই বা প্রতিযোগিতা চলছে। সে প্রতিযোগিতার ফলে এবং বাংলাদেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ফলে বাংলাদেশ এ অঞ্চলে একটি নতুন পরিচিতি লাভ করতে পেরেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশকে গৌরবের সাথে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পেরে আজ গর্বিত।