রাস্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাই দূর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারেন
ড. এ, কে, আব্দুল মোমেন
অনেক দিন আগে যখন চীনে গিয়েছিলাম তখন হোটেলের চারিদিকে দেখলাম বড় বড় ক্রেন উচু উচু ইমারত তৈরি করছে। রাতারাতি বড় বড় শহর গড়ে উঠছে।
আর বর্তমানে আমি যখন বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় চলাফেরা করি তখন প্রায়ই বড় বড় বাড়িঘর বা অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে দেখে হৃদয়ে পুলক অনুভব করি। দেশের আনাচে কানাচে উন্নয়নের কাজ হচ্ছে, গ্রামে-গন্জে ইলেকট্রিক বাতি জ্বল জ্বল করছে, মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দেখে যারপরনাই আনন্দিত হই। তবে কিছু সংখ্যক দূর্নীতিপরায়ণ সরকারি আমলা ও টাউটদের জন্য দেশটা বদনামের ভাগী হচ্ছে। এরফলে বিদেশীরা আমাদের উপদেশ দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এটা জাতির জন্য লজ্জাজনক।
সরকারের অনেকগুলো বড় বড় প্রজেক্ট এদের কারণে যথা সময়ে শেষ হচ্ছে না তাতে জনগণের হয়রানি যেমন বাড়ছে, সরকারের খরচও বাড়ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ অবশ্যই প্রয়োজন।
এবারের বাজেটের শতকরা ২৩% ভাগ খরচ হবে ঝৃণবাবদ সুদ মেটাতে, ২২% ভাগ খরচ হবে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাবদ (যা আগামীতে ২৮% ভাগ হবে বলে শোনা যাচ্ছে), অর্থাৎ বাজেটের অর্ধেকই খরচ হবে অনুন্নোয়ন খাতে। একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য এমনটি হওয়া মোটেই কাম্য নয়। বরং ব্যাঙ্কঝৃণ যাতে সরকারকে অধিকতর নিতে না হয় তারজন্য রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। এটা বৃদ্ধি করতে হলে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে এ বাজেটে তার কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। গতানোগতিক নিয়মে এটা বৃদ্ধি করা সম্ভব কিনা তাতে সন্দেহ আছে। বরং কালো টাকাকে ১৫% কর দিয়ে সাদা করার যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা সৎভাবে যারা আয় করে ৩০% আয়কর দেন তাদের জন্য হতাশার এবং নৈতিক ভাবে অগ্রহণযোগ্য। এমন নীতি অসৎ উপায়ে উপার্জন করতে উৎসাহ দিতে পারে।
কালো টাকা বা অদৃশ্য আয়ের একটি বড় কারণ হচ্ছে মার্কেট মেকানিজমের উপর খবরদারি করা। কি অদৃশ্য কারণে এক কোটি টাকার বাড়ি বা ফ্লেট বিক্রি করে বলতে হয় মাত্র ২৫ লাখ টাকা পেয়েছি এবং এই ২৫ লাখের উপর ছড়াধরে টেক্স দিতে হয়। এরফলে ৭৫ লাখ টাকা অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা হয়ে পড়ে। মার্কেট মেকানিজমের উপর এমন খবরদারির প্রয়োজন আছে কি? সুতরাং কালো টাকাকে সাদা করার জন্য এক কোটিকে এক কোটি বলতে হবে এবং এই এক কোটি টাকার উপর টেক্স দিতে হবে, ২৫ লাখের উপর নয়। টেক্সের পরিমাণ ছড়াধরে না রেখে সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসলে সরকারের আয়ও বাড়বে আর জনগণকে কালো বা অদৃশ্য টাকার ঝকমারি থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব।
দ্বিতীয়ত আমাদের আমলাতন্ত্র অনেক ব্যাপক ও মাথাভারি হয়ে উঠেছে এবং এদের ক্ষমতাও আকাশচুম্বী। আমি পররাস্ট্র মন্ত্রী থাকাবস্থায় একজন ডিসি সাহেবকে একটি কমিটি করতে বলেছিলেন, কয়েক মাস পার হবার পরও কমিটি যখন হয়নি তখন ডিসি সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম ঐ কমিটিটি দিতে এত দেরী করছেন কেন? তিনি বল্লেন, “স্যার, সরকার আমাকে শত শত কমিটির দায়িত্ব দিয়েছে, তাছাড়া প্রটোকল ডিউটিও আছে। কখন যে কোন মিটিং ঢাকবো আর কমিটি করবো, সেই সময় তো আমার নেই। বস্তূত একজন ডিসি সাহেবের উপর শত শত দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। দিনে দিনে তার উপর দায়িত্ব আরো বাড়ছে। তাই তারা সঠিকভাবে দেখভাল করার সময় পান না।
অপর পক্ষে, নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্ব নেই। তাদের একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে “তদবির” করা। তদবির ছাড়া তাদের উপর কোনো দায়িত্ব নেই যদিও এলাকার উন্নয়ন এবং নিজ এলাকায় সুশাসনের ব্যত্যায় হলে জন প্রতিনিধিকে দোষী সাবস্থ করা হয়। সরকারি অফিসাররা সব নাটের গুরু হওয়া সত্বেও তারা জবাবদিহিতা বাইরে। যদি কোনো জনপ্রতিনিধি দূর্নীতি করতে চান, তিনি একা তা করতে পারবেন না। তাকে অবশ্যই সরকারি কর্মচারী বা অফিসারের সহায়তা নিয়ে জনগণের সম্পদ লুট করতে হবে। বিভিন্ন তথ্যমতে দেখা গেছে যে, বিদেশে সরকারি কর্মচারীদের বাড়িঘর বেশী, এবং লুটের টাকা পাচারে তারা অনেক দক্ষ। রাজনীতিবিদরা তাদের কাছে নৎসি। ব্যবসায়ীবৃন্দকে সরকারি কর্মচারীরাই ঘুষ দিতে বাধ্য করেন। স্পীডমানি না দিলে কাজ সহজে অগ্রসর হয় না।
সিলেটের এক প্রবাসী আমাদের অনেক অনুরোধে এবং সরকারের মন্ত্রী মিনিস্টাদের আহ্বানে বাংলাদেশে কিছু বিনিয়োগ করেন। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অনেকের চাকরি হয়েছে এবং তিনি সরকার নির্ধারিত আয়কর রীতিমত দিয়ে যাচ্ছেন। তবে আয়কর বিভাগের কোনো কোনো অফিসাররা তাতে অসন্তুষ্ট। তারা তাকে ঘুষ দিতে পীড়াপিড়ি করেন। তিনি ঘুষ দিতে অস্বীকার করলে তার বিরোদ্ধে বানোয়াট রিপোর্ট তৈরি হয় এবং তাকে ধমক দেয়া হয় এই বলে যে, আপনি যদি আমাদের দেশের এই অলিখিত নিয়ম না মানেন, তাহলে আপনি আপনার ব্যবসা বিদেশে নিয়ে যান। ঐ অফিসারের বিরোদ্ধে অভিযোগ করার পরও তিনি এখনও দিব্য সরকারি চাকরিতে বহাল আছেন।
টেক্সপেয়ারদের টাকা খরচ করতে সরকারি অফিসারদের গায়ে লাগে না । গরীবের টেক্সের পয়সা দিয়ে ঈদ কিংবা পহেলা বৈশাখে বড় সাহেবদের দামী গিফট দেয়া এখন একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। তারা অযথা খরচ করেন বেশী। এটা কমানোর জন্য সরকারের অনেকগুলো দপ্তর বা অফিস বন্ধ করে দেওয়া যায় কিনা সেটা বিবেচনা করার জন্য সংসদীয় কমিটি কাজ করতে পারে যাতে we must not suck the blood of the poor people. তাতে সরকারের খরচ যেমন কমবে, মানুষের হয়রানিও কমবে এবং কাজগুলো একাধিক দপ্তরের মাত্রাতিরিক্ত মাতববরির ফলে দীর্ঘায়িত হবে না।
মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে প্রেসিডেন্ট রিগান প্রেসিডেন্ট হিসাবে খুব নাম করেন। তিনি সিনেমার নায়ক ছিলেন। তিনি সরকারি নিয়মকানুন খুব বুজতেন না। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় যে কাজকর্ম দীর্ঘায়িত হয় তা তিনি টের পান। তাই তিনি দুটো কাজ করে জনগণের হৃদয়ে চিরন্জীব হয়ে আছেন। একটি হচ্ছে ইস্ট ও ওয়েস্ট জার্মানীর মধ্যকার প্রচীর ভেংগে ফেলা— “tear down the walls”, বার্লিন ওয়াল এবং অন্যটি হচ্ছে মার্কিন আমলাতন্ত্রকে তিনি কেটেচেঠে ছোট করেন । যে সমস্ত দপ্তর প্রয়োজন নেই তা তিনি শক্ত হাতে বন্ধ করে টেক্সের টাকা বাঁচান। তিনি আজও তাই নমষ্য। কর্মচারীর এবং আইন কানুনের আধিক্য কমলে দূর্নীতির প্রতিযোগিতা ও মহোৎসব হয়তো কমতে পারে।
তৃতীয়তঃ দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানো খুউবই দরকার। হাজার হাজার ছেলেমেয়েরা বৈধ ও অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে চাকরির অন্বেষণে। তাই কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য বহুবিধ উদ্যোগ নেয়া একান্ত দরকার। সরকার যদি কম ব্যাঙ্কঝৃণ নেয়, তাহলে প্রাইভেট সেক্টর অধিকতর ব্যাঙ্কঝৃণ নেয়ার সুযোগ পাবে এবং যেহেতু অধিকাংশ কর্মসংস্থান প্রাইভেট সেক্টরে সৃষ্টি হয়, সুতরাং ক্রাউডিং আউট (crowding-out) করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে যে সুদের হার অতিরঞ্জিত থাকলে বিনিয়োগ কম হবে।
আওয়ামীলীগ দল সব সময়ই জনগণের মঙ্গল চায় এবং তারা জনগণের ইচ্ছাকেই প্রতিস্টিত করে। এদেশের যত বড় বড় অর্জন যেমন স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি, একে শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত করা, একে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনে, এদেশকে দারিদ্রমুক্ত করা, এদেশের কালো আইন ইনডেমনিটির স্থলে– আইনের ক্ষেত্রে সকল মানুষের সম অধিকার নিশ্চিত করা বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, এদেশকে জঙ্গীবাদ বা সন্ত্রাসবাদ মুক্ত করা, এদেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে সমুন্নত করা এবং অর্থনৈতিক মুক্তি বা জীবনমানের উন্নয়ন সবাই আওয়ামীলীগ সরকারের সম্ভব হয়েছে। সুতরাং আওয়ামীলীগ সরকারকেই দূর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে মূল ভূমিকা নিতে হবে। এবং একই সাথে আমলাতন্ত্রের দৌরাত্বকে লাগাম টেনে জনগণের সেবক বা বন্ধু হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এগুলোর দায়িত্ব দেশের সবচেয়ে বড় ও পুরাতন রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগকেই নিতে হবে।
রাস্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় পরিচয় যে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা যিনি সব সময় অকোতভয়, নির্ভীক, এবং জনমণপন। তাঁর ধমনীতে, তাঁর প্রতিটি শিরায় শিরায় ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় মানব কল্যাণ, জনগণের মঙ্গল। সুতরাং তিনিই পারবেন এই অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে। – শোষন মুক্ত, দূর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ শেখ হাসিনার হাতেই সম্ভব। শেখ হাসিনার জয় হোক। দেশের জনগণ আপনার সাথে আছে।
লেখক: প্রাক্তন পররাস্ট্র মন্ত্রী