রাজধানীজুড়ে ‘ভাড়াটে ডাকাত’ আতঙ্ক, ২৯ জন আটক
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট (সোমবার) শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত দেশের কোনো থানায় পুলিশের উপস্থিতি নেই।থানায় তালা দিয়ে পুলিশ সদস্যরা কর্মবিরতিতে এখন।
এ সুযোগে দেশে শুরু হয়েছে নৈরাজ্য, লুটপাট আর ডাকাতি। দুর্বৃত্তরা যে যার মতো বাসা-বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে হামলা করছে। লুটপাট ও ভাঙচুর চালাচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, পরিস্থিতি অশান্ত করতে, মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পরিকল্পিতভাবে এসব করা হচ্ছে। আর যারা গভীর রাতে ডাকাতি বা আতঙ্ক ছড়ানোর কাজ করছে তারা বস্তি এলাকার টোকাই তরুণ। তারা টাকার বিনিময়ে ভাড়া খাটছে।
সরকার পতনের দিন থেকেই রাত গভীর হলে আতঙ্ক বাড়ছে রাজধানীবাসীর মাঝে। শুধু ঢাকায় নয়; জেলায়-উপজেলায়ও রাত হলে ডাকাতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। মসজিদে মাইকিং করে ডাকাতের বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে। স্থানীয়রা লাঠিসোঁটা নিয়ে এলাকা পাহারা দিচ্ছেন, নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। খবর দিলেই টহলরত সেনা সদস্যরা এসে ডাকাতদের আটক করছেন।
বুধবার (০৭ আগস্ট) রাত ১২টার পর থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে।
রাতভর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আরশিনগর, আঁটিবাজার, নয়াবাজার, বসিলা, বসিলা মেট্রো হাউজিং, মোহাম্মদপুরের কাদিরাবাদ হাউজিং, শেখেরটেক, জিগাতলা, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ এলাকা, শনিরআখড়া, মিরপুরের পল্লবী, মিরপুর ১০, ইসিবি চত্বর এলাকা, উত্তরার ৮-৯, ১০-১১ নম্বর সেক্টর, গাজীপুর ও টঙ্গী কলেজ রোড এলাকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং রাজশাহী মিলে প্রায় ২৯ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
মিরপুর পল্লবী এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে আটক হয়েছেন ১৭ জন। আটক হওয়া কয়েকজন ডাকাত এলাকাবাসীর মারধরের সময় জানিয়েছেন, নাহিদ নামে এক যুবক তাদেরকে টাকা পয়সা দিয়ে নামিয়েছে এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩০০ যুবক সংগ্রহ করে এ কাজে লাগাচ্ছে নাহিদ। নাহিদ একজন ছিনতাইকারী এবং চিহ্নিত সন্ত্রাসী।
এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের এ কাজে নামিয়েছে বলে জানায় তারা।
আটকদের মধ্যে বসিলা এলাকা থেকে চারজন এবং মিরপুর থেকে ১৭ জনকে এলাকাবাসী আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ডাকাতদের এলোপাতাড়ি অস্ত্রের আঘাতে মিরপুরের ইসিবি চত্বর এলাকায় দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু তাদের নাম-পরিচয় এখনো জানা যায়নি। এছাড়া মোহাম্মদপুর এলাকায় পাঁচজনকে অস্ত্রসহ আটক করে এলাকাবাসী।
পরে তাদেরকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এছাড়া উত্তরা এলাকায় কয়েকজন আটক করেছে এলাকাবাসী।
সুমি নামে একজন জানান, বসিলা মেট্রো হাউজিং, সিটি হাউজিংয়ে ডাকাত ঢুকেছিল। এসময় তারস মেট্রোর কয়েকটা বাসা থেকে অস্ত্র ধরে নগদ টাকা ও স্বর্ণ নিয়ে যায়। এরপর সেনা সদস্যরা চলে আসায় আবার সিটি হাউজিং এ ঢুকে পড়ে। তবে সিটি হাউজিংয়ের কারো বাসায় ঢুকতে পারেনি। এর আগেই দুই জনকে ধরতে পারেন এলাকার লোকজন। বাকিরা পালিয়েছে। এলাকাবাসী সবাই নিজ নিজ বাড়ি পাহারা দিচ্ছে।
এছাড়া ঢাকার বাইরে বাইক নিয়ে ডাকাতি করতে এসে জনতার হাতে আটক হয়েছেন এক যুবক। বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী জেলার নওহাটা বাজারে এ ঘটনা ঘটে। পরে তাকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয় লোকজন। এছাড়াও গাজীপুর ও টঙ্গী এবং সাভার এলাকায় ডাকাতির খবর পাওয়া গেছে।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকার লাল খায় এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে চার যুবক এলাকাবাসীর হাতে আটক হয়েছেন। পরে তাদেরকে উত্তম মাধ্যম দেন এলাকাবাসী। কিন্তু বাকিরা পালিয়ে যায়।
ভুক্তভোগী এলাকার অধিকাংশ মানুষ জানিয়েছেন, যারা ডাকাতি করতে এসেছিল বেশিরভাগ টোকাই এবং উঠতি তরুণ। তাদেরকে অস্ত্র এবং টাকা সরবরাহ করে এসব প্ল্যান করে করা হচ্ছে। যাতে আগামীকাল দেশে কেয়ারটেকার সরকার শপথ নিতে না পারে এবং সেই সুযোগে দেশে সেনা শাসন আসে। মানুষের মাঝে আতঙ্ক তৈরিতেই সারা দেশে একযোগে এই ডাকাতি চলছে বলে মনে করছেন তারা।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, আটকরা জানিয়েছেন তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের নির্দেশে ডাকাতিতে নেমেছেন।
স্থানীয়রা জানান, এলাকায় ডাকাতি হচ্ছে খবর পেয়ে মসজিদের মাইকে সতর্ক করা হয়। পরে লোকজন লাঠিসোঁটা ও যার যা অস্ত্র ছিল তা নিয়েই রাস্তায় বেরিয়ে আসেন এবং তাদের ধাওয়া করেন। বিভিন্ন জায়গায় ডাকাত সদস্যরা আটকও হয়েছেন। তবে এই অবস্থা কতদিন ধরে চলবে তারা তা জানেন না। তবে কেউ কেউ ডাকাতির প্রমাণস্বরূপ এলাকায় ডাকাতদের ধাওয়া দেওয়া ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
তবে ফেসবুকে অনেকেই ডাকাতের এসব ঘটনাকে গুজব বলে ধারণা করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুধবার রাত নয়টার দিকে মিরপুরের ইসিবি চত্বরের একটি টাওয়ারে ঢোকে শতাধিক যুবক। তাদের হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। এসময় তারা ৭০টি ভবনে ঢুকে পড়ে ও ভবনগুলোর বাসিন্দাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ডাকাতি শুরু করে। খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে তারা এলাকার সব গেট বন্ধ করে দেন। এরপর ধাওয়া দিয়ে তাদের ধরে ফেলেন। এ সময় গণপিটুনিতে একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে তার নাম পরিচয় কেউ জানাতে পারেনি। পরে এলাকাবাসী দুজনকে আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেন। তার আগে এলাকাবাসী বেধড়ক গণপিটুনি দেয় তাদের। এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে আনে সেনাবাহিনী।
আরো জানা গেছে, তার আগে সেনাবাহিনীর কয়েক প্লাটুন সদস্য এসে ভবনগুলো ঘেরাও করে। তারা ভবনগুলোতে ঢুকে পড়া ডাকাত সদস্যদের উদ্দেশ্যে হ্যান্ডমাইক দিয়ে বলতে থাকেন তারা যদি বের না হয়ে আসে তবে তারা ভেতরে প্রবেশ করে গুলি চালাতে বাধ্য থাকবে। এমন কথা শোনার পর ডাকাত সদস্যরা চুপ করে থাকলে সেনাবাহিনী গুলি করতে বাধ্য হয়। পরে তারা আসার চেষ্টা করলে জনগণ তাদের ধরে গণধোলাই দেন এবং ১৭ জন আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেন তারা। আটকরা সবাই টোকাই বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী। প্রায় ঘণ্টা ধরে এই অভিযান চলে। তাদের ধরতে ৭০টি ভবনের প্রতিটিতে ঢুকে পড়েন সেনারা। তখন বাইরে সাইরেন বাজছিল। পরে আরো কয়েকটি গাড়ি আসে।
সেই এলাকার বাসিন্দা মেরিনা মিতু নামে একজন বলেন, আমাদের ইসিবি এলাকায় রাত নয়টার দিকে ২০০/৩০০ ডাকাত এক সাথে ৭০টি ভবনে ঢুকেছিল। ঢুকেই তারা এলোপাতাড়ি কোপ দিতে শুরু করে। পরে আমরা এলাকাবাসী তাদের ধাওয়া করে সব এক্সিট গেটে অবস্থান নিয়ে ঘেরাও দিয়ে অনেকগুলোকে আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছি। প্রাথমিকভাবে এরা স্বীকার করছে স্থানীয় এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার হয়ে টাকার বিনিময়ে এই ডাকাতি, তাণ্ডব করতে আসছে এরা। তারা কালশি বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা। রাত তিনটার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
তাদের এলাকায় ডাকাতি রোধে সতর্ক আছেন, অন্যদেরও নিজ নিজ এলাকায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান তিনি।
গত মঙ্গলবার রাত থেকে শুরু হয়েছে এই ডাকাতি। বুধবার সেটা একযোগে চলতে থাকে। ঢাকা ছাড়াও মুন্সিগঞ্জ এবং বিভিন্ন জেলায় ডাকাতের খবর জানার আছে।
ডাকাতির এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এলাকাবাসী একত্রিত হয়ে ডাকাত প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছেন। শুধু তাই নয় তারা এলাকাবাসীর মাঝে সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ফোন নম্বর ছড়িয়ে দিচ্ছেন। যাতে খুব সহজে কল করলে ছুটে যেতে পারেন। এমন সংক্রান্ত কমিটি করা হয়েছে মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, বসিলা এবং ঢাকা উদ্যান এলাকায়।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, তারা নিজ উদ্যোগে এই কাজটি করছেন। যতক্ষণ না থানায় পুলিশ ফেরে ততক্ষণ তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করছেন না। দেশে একটি নৈরাজ্য পরিবেশ তৈরি করে জনমনে অশান্তি তৈরির জন্যই একটি চক্র এমন করছে বলে মনে করেন তারা।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি হচ্ছে বুধবার বিষয়টি নিয়ে সদর দপ্তরে পুলিশের নতুন আইজি মইনুল ইসলামকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেও তিনি এই বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে যে সকল সদস্য কর্মস্থল থেকে দূরে আছেন তাদেরকে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে কর্মস্থলে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
এদিকে বুধবার (৭ আগস্ট) আইএসপিআর থেকে জানানো হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে জনসাধারণের জানমাল ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন রয়েছে। যেকোনো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড, হানাহানি এবং প্রাণনাশের হুমকির সম্মুখীন হলে নিকটস্থ সেনাবাহিনী ক্যাম্পে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।