সুনামগঞ্জে নদী ভাঙনে দিশেহারা স্থানীয়রা
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ধোপাজান নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরইমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে নদী তীরের শতাধিক বসতবাড়ি, ফসলি জমি। এতে ঘরবাড়ি, জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে প্রায় ১০০ পরিবার। নদীগর্ভে চলে গেছে চার গ্রামের একমাত্র সড়কটিও। অব্যাহত নদী ভাঙনে দিশেহারা স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় লোকজন জানান, সীমান্ত নদী ধোপাজান হয়ে জেলার প্রধান নদী সুরমায় প্রতিদিন বাল্কহেড, টাঙ্গুয়ার হাওরের হাউসবোট, স্পিডবোটসহ শত শত নৌযান যাতায়াত করে। এতে সব সময় নদীতে প্রচণ্ড ঢেউ থাকে। এছাড়া, উজান থেকে নেমে আশা পাহাড়ি ঢলের কারণে এই সীমান্ত নদীতে প্রচণ্ড স্রোত থাকে, যা সরাসরি আঘাত হানছে নদীর পাড়ে। এছাড়া, স্থানীয়দের অভিযোগ রাতে নদীতে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করায় ভাঙন দিন দিন বেড়েছে।
সরজমিনে সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের সদরঘর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় নদী ভাঙনের ভয়ঙ্কর চিত্র। ভাঙন আতঙ্কে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বাড়িঘরের সব জিনিসপত্র, ভিটায় হয়েছে বড় বড় ফাটল।
ভাঙন রোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে সুরমা ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা বাসিন্দাদের। তাদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্টদের কাছে বারবার জানালেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না।
ব্লক ফেলে ভিটেমাটি রক্ষার কথা বলে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা গ্রামবাসীর কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে স্থানীয় মোহাম্মদ শাহ গোলাম হোসাইন বুরহান নামে একজন বলেন, ব্লক ফেলার কথা বলে হাজার হাজার টাকা নিয়েছে সরকার। অথচ কাজ করেনি। নদী ভেঙে বিলীন হচ্ছে। আমরা না পেরে ঘরবাড়ি ভেঙে এখান থেকে চলে যাচ্ছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড টাকা খেয়েছে, কিন্তু কাজ করে নাই।
তিনি আরও বলেন, হেমন্ত আসলে নদীর মুখ থেকে রাতের বেলা ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে অবৈধভাবে বালি ও মাটি উত্তোলন করা হয়। এ কারণে নদী ভাঙন তীব্র হচ্ছে।
আরেক ভুক্তভোগী রিপা বেগম বলেন, নদী ভাঙনের জন্য বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমরা বড় অসহায়। এই যে আমরা হুকমির মুখে, সরকারে এতো দিনে কিছুই করলো না। ২০ বছর আগে একবার নদী ভাঙনে সব হারিয়েছি। এখন যে বাড়িতে আছি সেটাও যেকোনো সময় নদীতে চলে যাবে। চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না। এখন অন্য কোথায়ও যে যাবো সেই ক্ষমতাও আমাদের নেই।
মোহাম্মদ আব্দুল রহমান নামে একজন বলেন, আমরা কই যাইমু? এই জায়গা ছাড়া আমার আর কিছু নেই। অন্য কোনো জায়গায় গিয়ে যে একটা ঘর করমু সেই টাকা পয়সাও নেই। নদী ভাঙনে আমাদের সব জমি শেষ। কেউই বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব দিছে না।
সদরঘর গ্রামের আয়াতুন নেছা (৫০) অসুস্থ স্বামী আর দুই মেয়েকে নিয়ে নদী ভাঙন কবলিত এলাকায় থাকছেন। জায়গা জমি বসতবাড়ি রক্ষার আশায় সুদে টাকা এনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু টাকা নিয়েও আয়াতুন নেছার সেই আশা আর পূর্ণ করেনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সুদে টাকা এনে সরকারের ঘরে (পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিসে এক কর্মকর্তাকে) দিছিলাম এই নদীতে ব্লক দেওয়ার জন্য। তিন হাজার করে ৬ হাজার টাকা দিছি। আমাদের এলাকার আরও মানুষ ৫ হাজার, ৬ হাজার টাকা করে দিছে। তারা বলেছিলো ব্লক দিয়ে দিবে কিন্তু আর দিলো না।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের অভিযুক্ত ওই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ সদর সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. আফসান পারভেজ বলেন, নদী ভাঙন রোধে বিভিন্ন সময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড, এমপির কাছে আবেদন জানিয়েছি, কিন্তু তারা আমাদের নদী ভাঙনের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেননি। শহরতলী ওয়ার্ডটি আসলে খুবই অবহেলিত। এখানে চারটা গ্রাম আছে, সদরঘর- আমিরগঞ্জ, আমিরপুর, কুরুতলা।
তিনি আরও বলেন, নদী ভাঙনে ইতিমধ্যে শতাধিক বাড়িঘর ভেঙে গেছে। এখনও ভাঙন চলমান। এখন নৌকা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়, কোনো রাস্তাঘাটও নেই।
তবে নদী ভাঙনের কারণ হিসেবে চলতি বছরের তিন দফা বন্যাকে দায়ী করলেন সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার।
তিনি বলেন, সুনামগঞ্জে এ বছর তিন দফায় বন্যা দেখা দিয়েছিলো, এই তিন দফা বন্যার কারণে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে আমরা প্রায় ১১টি স্থান চিহ্নিত করেছি। এই ১১টি স্থানে প্রায় ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ভাঙন দেখা দিছে। এই ভাঙার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের সাতশ মিটার। এই সাতশ মিটারে কাজ করার জন্য আমরা অলরেডি কাজ বাস্তবায়ন করার জন্য ৪৫ কোটি টাকার একটা চাহিদা দিয়েছি। যদি আমরা অর্থ বরাদ্দ পাই, তাহলে আমরা এখানে কাজ করবো।
দীর্ঘ ২০ বছর থেকে নদী ভাঙনে প্রতিরোধে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই বলে অভিযোগ স্থানীয়দের, এছাড়া নদীতে ব্লক বসানোর জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্তকর্তা টাকা নেওয়ার অভিযোগ করেছেন সদরঘর গ্রামের একাধিক বাসিন্দা। বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, এই ধরনের অভিযোগ আমরা পূর্বে পাইনি। এখন যেহেতু এ অভিযোগটি এসেছে আমরা বিষয়টি দেখবো।