নারী সুরক্ষা কমিটি গড়ছেন টলিগঞ্জের তারকারা
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
মালায়ালম চলচ্চিত্র জগতে নারীদের কাজের পরিস্থিতি নিয়ে পেশ করা কেরালা সরকারের ‘হেমা কমিটির রিপোর্ট’ ঘিরে তোলপাড় চলছে ভারতজুড়ে।
বলিউডের পাশাপাশি এবার সরব হচ্ছেন কলকাতার বাংলা সিনেমার তারকারাও। কলকাতার অভিনেত্রী থেকে টেকনিশিয়ান সবার জন্য ‘নারী সুরক্ষা কমিটি’ তৈরির জন্য আবেদন করেছেন তারা।
আনন্দবাজার লিখেছে, কেরালা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির নারীদের ‘যৌন হেনস্থার’ নানা তথ্য নিয়ে প্রকাশ হওয়া ‘হেমা কমিটির’ রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর কলকাতার অভিনেত্রী ঋতাভরী চক্রবর্তী সরাসরি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে নারীদের সুরক্ষা চেয়ে একটি আবেদন জানিয়েছেন।
ওই আবেদনপত্রে পশ্চিমবঙ্গে বিনোদন দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক নারী যাতে সুরক্ষিত থাকেন, কোনো কারণে হেনস্থার শিকার হওয়ার পরও যাতে ভীত না হয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারেন এবং আইনি পথে যাতে বিচার পান, সেজন্য একটি কমিটি তৈরির কথা বলা হয়েছে।
ঋতাভরীর এই ভাবনায় সায় দিয়েছেন টালিগঞ্জের অনেকে। নিয়েছেন পদক্ষেপও। টেলি অ্যাকাডেমি, আর্টিস্ট ফোরাম, ফেডারেশনের সভাপতির উদ্দেশ্যে অভিনেত্রীদের সই করা একটি চিঠি তৈরি হয়েছে। সেই চিঠিতে ‘নারী সুরক্ষা কমিটি’ গড়ে তোলার আবেদন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আনন্দবাজার কথা বলেছে অভিনয়শিল্পী সুদীপ্তা চক্রবর্তী, পাওলি দাম, রানা সরকার, ফিরদৌসল হাসান ও টোটা রায়চৌধুরীর সঙ্গে। প্রত্যেকেই এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী বলেন, ” আজ হোক কাল হোক, প্রতিবাদ যে শুরু হল এতেই ভালো লাগছে। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিষয়টি নিয়ে ভাবা হচ্ছিল। গত চার দিন ধরে চিঠির বয়ান তৈরি হয়েছে। খুব দরকার ছিল এই পদক্ষেপ।”
সুদীপ্তা একই সঙ্গে অভিনয়ের শিক্ষিকাও। অভিনেত্রীর কাছে নতুন প্রজন্মের অনেক মেয়ে অভিনয় শিখতে আসেন। ছাত্রীরা তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অনেক ঘটনার কথাই সুদীপ্তাকে বলেন।
সুদীপ্তার ভাষ্য, “এই কমিটি তৈরি হলে নতুনরা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা নিয়ে যে ভয় পাচ্ছেন তা কেটে যাবে।”
অভিনেত্রী পাওলি দাম বলেন, “মেয়েদের অসম্মানের এসব অভিযোগ আজকের নয়। যুগ যুগ ধরে নারীরা অত্যাচার, হেনস্থার শিকার হয়ে আসছেন। হেমা কমিটির রিপোর্ট সেই অন্ধকারে যেন দিশা দেখাল।”
আর জি কর হাসপাতালের নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন এই অভিনেত্রী। বলেন, চিকিৎসকের নির্যাতন-মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি।
পাওলি বলেন, “সমগ্র নারী জাতির জন্য একুশ শতকে এসে নিরাপত্তা চেয়ে, অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে পথে নামতে হচ্ছে। আলাদা কমিটি গড়ার কথা ভাবতে হচ্ছে। একজন নারী হিসাবে এর থেকে বড় লজ্জা আর কি হতে পারে।”
পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে এক নারীকে হেনস্থার অভিযোগ এনেছিলেন প্রযোজক রানা সরকার। পরে যদিও অভিযোগ উঠিয়ে নেওয়া হয়।
ওই সময় বাধ্য হয়ে ‘গোপনে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়া হয়েছিল’ জানিয়ে রানা বলেন,” কিছু করার নেই। এটাই এখানকার অন্দরের আসল ছবি। কাজ হারানোর ভয়ে, আরও হেনস্থা হওয়ার ভয়ে আক্রান্ত অভিনেত্রীরা মুখ খোলেন না। এতে যে পরোক্ষে অপরাধীদের মদদ দেওয়া হয়, সেটাও বোঝেন না তারা। কারণ, প্রতিবাদ যত কম হবে ততই অপরাধী অন্যায় করার সাহস পাবে।”
‘নারী সুরক্ষা কমিটি’ তৈরি হলে প্রত্যেক নারী সাহস করে সেখানে অভিযোগ জানাতে পারবেন?
রানা বলেন, “সবাই জানেন, আইন কখনও আক্রান্তের নাম প্রকাশ্যে আনে না। কিন্তু ভয় পেয়ে এভাবে যত দিন নারী নীরব থাকবে অন্যায় ততই বাড়তে থাকবে।”
সুরক্ষা কমিটির চিঠিতে কেবল নারীরা সই করেছেন, এতে পুরুষ অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালকরা সই করেননি। তাহলে কি নারীদের পাশে পুরুষ অভিনেতারা নেই?
এই প্রশ্নে অভিনেতা টোটা বলেন, “অতি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে আমি সবসময় নারীর পাশে আছি ও থাকব। তাই মন থেকে চাইছি, এই ধরনের কমিটি গড়া হোক। চাইছি, শুধু খ্যাতনামারাই নন, ইন্ডাস্ট্রিতে যারা নতুন, তারাও যেন এই কমিটির থেকে উপকৃত হন।
“নিজে দেখেছি, অনেক সময় তারা আলাদা ওয়াশরুম বা পোশাক ছাড়ার জন্য আলাদা ঘরও পান না! বিশেষ করে নারী জুনিয়র আর্টিস্ট বা পর্দার নারী নৃত্যশিল্পীরা এই অন্যায়ের শিকার।”
হেমা কমিটি কি?
২০১৭ সালে এক মালয়ালাম অভিনেত্রী তার নিজের গাড়িতে যৌন হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে কেরালা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি।
তখন ‘উইমেন ইন সিনেমা কালেক্টিভ’ নামের এক সংগঠন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের পরিবেশ নিয়ে সমীক্ষার জন্য একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। কেরালার হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে হেমার নেতৃত্বাধীন ওই কমিটি গঠিত হয় এরপর।
ওই কমিটি সে সময় তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দেওয়ার সাড়ে চার বছর পর কেরালার সরকার গত ১৯ অগাস্টে সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে মালায়ালাম চলচ্চিত্র জগতে নারীদের যৌন হেনস্থার নানা তথ্য উঠে এসেছে। ঘটনাটি পরিচিতি পাচ্ছে ‘হেমা কমিটির রিপোর্ট’ নামে।
২৩৫ পাতার এই রিপোর্টে যৌন হয়রানি, বেআইনি নিষেধাজ্ঞা, বৈষম্য, মাদক ও অ্যালকোহলের অপব্যবহার, পারিশ্রমিক বৈষম্য, এবং কাজে ক্ষেত্রে অমানবিক পরিবেশের বিবরণ উঠে এসেছে।
অভিযোগের উঠেছে অভিনেতা সিদ্দিক, জয়সুরিয়া, মুকেশ, মানিয়ানপিল্লা রাজু, এদাভেলা বাবু, সুরাজ ভেঞ্জারমুডু, নির্মাতা রঞ্জিত, তুলসী দাসসহ ইন্ডাস্ট্রির একাধিক প্রযোজক, পরিচালকের বিরুদ্ধে। এছাড়া একজন খ্যাতনামা অভিনেতাকে ‘মাফিয়া’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
হেমা রিপোর্ট প্রকাশের সাত দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় জানিয়েছে, এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং অভিযোগগুলো তদন্তের সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর ঊর্ধ্বতন নারী পুলিশ কর্মকর্তারাও অন্তর্ভুক্ত করে কেরালা ইন্ডাস্ট্রির ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে ইন্ডাস্ট্রির ভেতরে।প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের মধ্যে কয়েকজন অভিনেতাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মালয়ালম মুভি আর্টিস্টসের সঙ্গে যুক্ত আছেন। এ সংগঠনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা মোহনলাল। মঙ্গলবার সভাপতির পদ মোহনলালসহ কমিটির ১৭ সদস্যের সবাই পদত্যাগ করেছেন।