হোয়াটসঅ্যাপে শিল্পীদের গোপন গ্রুপ নিয়ে তুমুল চর্চা
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিদায় নেয়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিনোদন জগতের কলাকুশলী ও শিল্পীদের একটি অংশ দলটির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। সময়ে সময়ে দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সরব থাকতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ পতনের পর এসব শিল্পী এবং কলাকুশলীদের মধ্যে বেশিরভাগই আত্মগোপনে চলে গেছেন কিংবা গা ঢাকা দিয়েছেন।
তবে গেলো কয়েকদিন ধরেই আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শিল্পী ও কলাকুশলীরা আবারও চলে এসেছেন আলোচনার তুঙ্গে। তাদের নিয়ে চর্চায় নেট দুনিয়া থেকে শুরু করে সংবাদ ও গণমাধ্যম। এসব শিল্পীদের কথোপকথনের কয়েকটি স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। আর, তাই নিয়ে এখন চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বেরিয়ে আসছে তাদেরকে ঘিরে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
‘আলো আসবেই’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এসব নেতা ও শিল্পী আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। মঙ্গলবার দুপুরে গ্রুপের ১০০টি স্ক্রিনশট প্রকাশ্যে আসার পর সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নিতেই খোলা হয় গ্রুপটি।
‘আলো আসবেই’ শিরোনামের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলেছিলেন চিত্রনায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য ফেরদৌস আহমেদ। সেই গ্রুপে সাজু খাদেম, শামীমা তৃষ্টি, রিয়াজ আহমেদ ছিলেন অ্যাডমিন।
এছাড়া সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবিব নাসিম, অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু ও অরুণা বিশ্বাস, সাইমন সাদিক, সুবর্ণা মুস্তাফা, শমী কায়সার, তানভীন সুইটি, স্বাগতাসহ অনেকেই ছিলেন। তাদের প্রধান এজেন্ডা ছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সফল করতে না দেওয়া। যে কোনো ভাবে আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করে তাদের নীল নকশা বাস্তবায়ন করা।
নির্মাতা মেইল হক একাধিক স্ক্রিনশট ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছেন, অরুণা বিশ্বাস এবং সোহানা সাবার এখন কথা ফুটছে। অথচ আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন স্বৈরাচারের পক্ষ নিয়ে এরা কী ধরনের আলাপ করত তার দুইটা নমুনা দিলাম। এরপরই বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে খুব দ্রুতই ভাইরাল হয়ে উঠে।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি স্ক্রিনশট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গ্রুপের সদস্যরা আন্দোলনের বিপক্ষে সরব ছিলেন। আন্দোলনকারী ও আন্দোলনের পক্ষে থাকা নির্মাতা ও শিল্পীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিলেন তাঁরা। আন্দোলনকারীদের বিষোদ্গার করেছেন ‘আলো আসবেই’ গ্রুপের শিল্পীরা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিল্পী ও নির্মাতাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থীদের পক্ষে রাজপথে ছিলেন। পুলিশের গুলিতে একের পর এক শিক্ষার্থীর নিহতের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন বহু শিল্পী-নির্মাতা।
ছাত্র-জনতার ওপর দমন–পীড়ন চলাকালে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে সাফাই গাইতে দেখা গেছে অল্প কয়েকজন শিল্পীকে; মূলত তাঁরাই ‘আলো আসবেই’ গ্রুপের সদস্য ছিলেন।
ওই গ্রুপের কথোপকথন। বিশেষ করে অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাসের ‘গরম জল’ ঢেলে দেওয়ার অংশটুকু নেট দুনিয়ায় ভাইরাল। যা নিয়ে চারিদিকে বইছে নিন্দার ঝড়। গত ৫ আগস্ট থেকে গা-ঢাকা দিয়ে আছেন তারা সবাই। কেউ কেউ এরই মধ্যে গোপনে দেশ ছেড়েছেন। ৬ আগস্ট দেশত্যাগ করেছেন অরুণা বিশ্বাস।
খবর নেই ফেরদৌস, নিপুণ, রিয়াজ, ফজলুর রহমান বাবু ও তুষ্টিদের। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত সুবিধা নিতেন বলে খবর রয়েছে। পরপর ছ’বার সেন্সর বোর্ডের সদস্য হয়েছেন অরুণা বিশ্বাস। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটিতে জায়গা করে শামীমা তুষ্টি ভাগিয়েছেন অনুদানের সিনেমা।
অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতিকে লিখতে দেখা গেছে, ‘বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুন। ফায়ার সার্ভিস ও গণমাধ্যমকে ঢুকতে দিচ্ছে না টোকাই জামাত শিবিরের মেধাবী আন্দোলনকারীরা। তখন আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস বলেছেন, ‘গরম জল দিলেই হবে’।
আওয়ামী লীগপন্থি শিল্পীদের এই গ্রুপে লিমন আহমেদ নামের এক বিনোদন সাংবাদিককেও দেখা গেছে। আন্দোলনের পক্ষে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর একটি ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট ‘আলো আসবেই’ গ্রুপে দেন লিমন। ফারুকীকে প্রকাশের অযোগ্য ভাষায় গালি দিয়েছেন অভিনেত্রী সোহানা সাবা, অরুণা বিশ্বাস, জ্যোতিকা জ্যোতিসহ আরও কয়েকজন।
আন্দোলনের পক্ষে যাঁরা প্রোফাইল লাল করেছিলেন তাঁদের চিনে রাখা এবং পরবর্তী সময়ে ‘সাইজ করার’ হুমকির কথাও এসেছে এই গ্রুপে। আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে প্রোফাইল ‘লাল’ করায় এক সংগীতশিল্পীকে নিয়ে অরুণা বিশ্বাস লিখেছেন, ‘বয়স যদি কম থাকত পিটাইতে পিটাইতে বাবা ডাক শিখাইতাম’।
আন্দোলনের পক্ষে ‘এক দফা’ শীর্ষক ছবি কাভারে পোস্ট করেছিলেন তরুণ অভিনেত্রী নাজিফা তুষি। সেই পোস্টের স্ক্রিনশট ‘আলো আসবেই’ গ্রুপে দিয়ে তাঁকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়া হয়।
এই গ্রুপ থেকেই সরকারের পক্ষে শিল্পীদের নিয়ে বিটিভি, এফডিসির সামনে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। এই গ্রুপে অ্যাডমিনদের পাশাপাশি আন্দোলনের বিরুদ্ধে রোকেয়া প্রাচী, পরিচালক মাসুদ পথিক, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী করসহ আরও অনেকে সরব ছিলেন। এদের সবাই পাঁচ আগস্টের পর থেকে লোকচক্ষুর আড়ালে।
জানা গেছে, সাবেক তথ্যপ্রতিমন্ত্রী আরাফাত ও সংসদ সদস্য ফেরদৌসের নেতৃত্বে ‘আলো আসবেই’ নামক এই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটি খোলা হয়। সেখানে সবার অবস্থান ছিল ছাত্রদের আন্দোলনের বিপক্ষে! তারা মত দেন যেভাবেই হোক আন্দোলন থামাতে হবে; ছাত্রদের ওপর গরম জল ঢেলে দিতে হবে।
ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই সামাজিক মাধ্যমে সরব ছিলেন অভিনেত্রী ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর ও রোকেয়া প্রাচী। সরকারের পক্ষ নিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বিভিন্ন বার্তা প্রচারের চেষ্টা করেছেন তারা দু’জন। ‘আলো আসবেই’ গ্রুপেও দেখা মিলেছে তাদের সেই কর্মকাণ্ডের চিত্র।
এর মধ্যে ঊর্মিলা প্রতিদিনই কোথায় কোন তারকা শিক্ষার্থীদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন, সেসব চিত্র ওই গ্রুপে তুলে ধরতেন। রোকেয়া প্রাচী কখনো ভিডিওবার্তা নিয়ে হাজির হতেন, আবার কখনো রাজপথে সরকারের হয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নেমে আসার আহ্বান জানাতেন।
সোহানা সাবাকেও একের পর এক স্ক্রিনশট শেয়ার করতে দেখা গেছে সেই গ্রুপে। এর মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সহশিল্পীদের নিয়েও বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন এই অভিনেত্রী। জুলাইয়ের শেষে রাজপথে শিক্ষার্থীদের পক্ষে যখন একদল শিল্পীরা মাঠে নেমে আসে, তখন আওয়ামীপন্থি ওই গ্রুপের তারকারাও সরব হয়ে ওঠেন। নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন মানববন্ধন ও সমাবেশের ডাক দেন তারা।
অভিনেতা সাজু খাদেমের সমন্বয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। কবে, কখন তারকারা কোথায় হাজির হবেন সেসব আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করে নেওয়া হতো ‘আলো আসবেই’ গ্রুপে। চিত্রনায়ক ফেরদৌসের নেতৃত্বে আগস্টের শুরুতেই রাজপথে নেমে আসেন আওয়ামীপন্থি ওই শিল্পীরা। গ্রুপেই তাদের আন্দোলনে যোগ দিতে বিভিন্ন নির্দেশনা ও চাপ প্রয়োগ করতে দেখা যায় এই নায়ককে।
আন্দোলনে কারা অংশ নিচ্ছেন, এসব তথ্য নিয়মিত সেই গ্রুপে শেয়ার করতেন অভিনেত্রী তানভীন সুইটি ও শামিমা তুষ্টি।
এছাড়া যারা শিক্ষার্থীদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছিলেন, তাদের কড়া সমালোচনায় মেতে উঠতে দেখা গেছে এই দুই শিল্পীকে।
দেশের নন্দিত অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফা ও বদরুল আনাম সৌদকেও সক্রিয়া দেখা গেছে ‘আলো আসবেই’ সেই গ্রুপে। এর মধ্যে গত ১ আগস্ট একটি মেসেজে সুবর্ণা মোস্তফাকে লিখতে দেখা যায়, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ‘ফেকবুক’ ব্যবহার করব না। যতদিন না এটা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন ও সহিংসতার ভিডিও নিয়ে যখন সামাজিক মাধ্যম উত্তাল তখনই ফেসবুককে ব্যঙ্গ করে ফেকবুক বলে মন্তব্য করতে দেখা যায় এই তারকাকে। একইদিনে সুবর্ণা মোস্তফার স্বামী নির্মাতা বদরুল আনাম সৌদকে একটি মেসেজে লিখতে দেখা যায়, আজ ছাত্রদের স্লোগানে ইনকিলাব জিন্দাবাদ শুনতে হলো। এটা পাইক্কাদের স্লোগান। এখানে আসলো কী করে?
এসব, স্ক্রিনশট ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সমালোচনার ঝড় উঠছে। অনেক শিল্পী, নির্মাতা ‘আলো আসবেই’ গ্রুপের শিল্পীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। কেউ কেউ শিল্পীদের ভুল পথ ছেড়ে সঠিক পথে ফেরার পরামর্শ দিচ্ছেন। আবার অনেকের এই গ্রুপে জড়িতদের শাস্তিও দাবি করেছেন।
নির্মাতা আশফাক নিপুন এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘আলো আসবেই’ গ্রুপে আমার যত সহকর্মী ছিলেন সবাইকে বলতে চাই, এখনো সময় আছে ‘আলোতে আসেন’। খুনি শাসক না, জনগণই সকল আলোর উৎস। আপনাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। এটার স্ক্রিনশট নিয়েও ছড়িয়ে দেন, যদি কোনো গোপন গ্রুপ থাকে।
হোয়াটসঅ্যাপে ‘আলো আসবেই’ গ্রুপে ঠিক কতজন সদস্য যুক্ত ছিলেন সেটির সঠিক কোন হিসাবে জানা যায়নি। তবে জানা গেছে, গ্রুপটির সদস্য সংখ্যা শতাধিক হবে। কারও কারও মতে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
এই গ্রুপে অসংখ্য সদস্যদের মধ্যে যারা উল্লেখযোগ্য, তারা হলেন— সোহানা সাবা, অরুণা বিশ্বাস, এমপি আরাফাত, এমপি ফেরদৌস, রিয়াজ আহমেদ, সুবর্ণা মুস্তফা, বিজরী বরকতুল্লাহ, আজিজুল হাকিম, রফিক, স্বাগতা, বদরুল আনাম সৌদ, শমী কায়সার, সুইটি, রওনক হাসান, মাসুদ পথিক, আশনা হাবীব ভাবনা, জ্যোতিকা জ্যোতি, শামীমা তুষ্টি, জমশেদ শামীম, উর্মিলা, মামুনুর রশিদ, খান জেহাদ, এবার্ট খান, সাজু খাদেম, হৃদি হক, ফজলুর রহমান বাবু, আশরাফ কবীর, দীপান্বিতা মার্টিন, এমপি হাসান মাহমুদ, সাইমন সাদিক, জুয়েল মাহমুদ, জায়েদ খান, হারুনুর রশিদ, ঝুনা চৌধুরী, লিয়াকত আলী লাকি, সৈয়দ আওলাদ, সাইদ খান, সাখাওয়াত মুন, স্মরণ সাহা, সায়েম সামাদ, শাকিল (দেশনাটক), শহীদ আলমগীর, নূনা আফরোজ, রোকেয়া প্রাচী, সঙ্গীতা মেখাল, সৈয়দা শাহানুর, শাহাদাত হোসেন, গুলজার, নাহিদ, মিলন, প্রণীল, এসএ হক অলীক, রুনি, রুবেল শংকর, রাজিবুল ইসলাম রাজিব প্রমুখ।