গণহত্যার বিচারে প্রস্তুত হচ্ছে ট্রাইব্যুনাল
দৈনিকসিলেটডেস্ক
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে সংঘটিত গণহত্যার বিচারও হতে যাচ্ছে এই ট্রাইব্যুনালেই। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। এরপর এ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় গণহত্যার ১৪টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে প্রতিটি অভিযোগেই রয়েছে ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনার নাম। বর্তমানে অভিযোগগুলোর তদন্ত চলছে। ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পরপরই বিচার কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথের পরপরই আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গণহত্যার ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ যাদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার করার উদ্যোগ নেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর সেদিনই শেখ হাসিনাসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে তদন্তের আবেদন জানানো হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান মো. আতাউর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগগুলোর তদন্ত চলছে। আমরা ঢাকা মেডিক্যালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল, বিশ^বিদ্যালয়, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছি। অপরাধ সংঘটনের স্পট থেকেও তথ্য সংগ্রহ চলছে। এ ছাড়া গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে জমা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
মুুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে আওয়ামী লীগ সরকার। বিচারকাজ ত্বরান্বিত করতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। দুই ট্রাইব্যুনাল থেকে এ পর্যন্ত ৫১ মামলার রায় এসেছে। এতে দ-িত ১৩১ আসামির মধ্যে ৯১ জনকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদ-। এর মধ্যে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় শেষে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। মামলার সংখ্যা কমে যাওয়ায় ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। মামলার কার্যক্রমেও গতি কমে যায়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর গত ১৮ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটরসহ ১৩ জন প্রসিকিউটর পদত্যাগ করেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের প্রসিকিউশন টিম গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন মন্ত্রণালয়। এ টিমের সদস্য সংখ্যা আরও বাড়তে বলে জানা গেছে।
এদিকে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় ১০ জন কর্মকর্তা ছিলেন। এর মধ্যে ৪ জন ছিলেন চুক্তিভিত্তিক। সরকার পরিবর্তনের পর তাদের চুক্তি বাতিল হয়। বর্তমানে ৬ জন তদন্ত কর্মকর্তা আছেন। যারা গণহত্যার অভিযোগের তদন্ত করছেন। জানা গেছে, শিগগিরই তদন্ত সংস্থায় আরও কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে।
এদিকে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন টিমের কার্যক্রম চলমান থাকলেও ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি না থাকায় বিচার কার্যক্রম থমকে আছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার গত ১৩ জুলাই অবসরে গেছেন। অপর এক সদস্য বিচারপতি হাইকোর্টে ফিরে গেছেন। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে কোনো বিচারপতি নেই।
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ দেওয়া আবশ্যক জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করি সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
পুরনো অভিযোগ ও চলমান মামলার বিষয়ে প্রসিকিউশনের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেগুলো পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তদন্ত সংস্থা সূত্র জানিয়েছে, সরকার পতনের আগে তদন্ত সংস্থায় ২৫টি অভিযোগ তদন্তাধীন ছিল। ট্রাইব্যুনালের ৩৪টি মামলার বিচার চলমান। গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত গণহত্যার ১৪টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকা- নিয়ে একটি অভিযোগ রয়েছে। অন্য ১৩টি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় গণহত্যার অভিযোগ। সবগুলো অভিযোগেই প্রধান আসামি শেখ হাসিনা।
গত ১৪ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় এক আবেদনে আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ আরও ৯ জনের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদন করা হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা আন্দোলনের সময় নিহত বাগেরহাটের আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা মো. বুলবুল কবিরের পক্ষে সুপ্রিমকোর্টের অ্যাডভোকেট গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম এ আবেদন করেন। ছাত্রদের আন্দোলন চলাকালে মিরপুরে শিক্ষার্থী শাহরিয়ার হাসান আলভীকে হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, ড. হাছান মাহমুদ, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, জুনায়েদ আহমেদ পলক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, জাহাঙ্গীর কবির নানক, কামাল আহমেদ মজুমদার, তরীকত ফেডারেশনের নেতা সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভা-ারির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। এ ছাড়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ, সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, যুবলীগ সাধারণ সম্পাক মাইনুল ইসলাম নিখিল, আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর সভাপতি বজলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পদচ্যুত মেয়র আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধেও তদন্তের আবেদন করা হয়েছে। এ ছাড়া সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও তাদের সদস্যসহ আনুমানিক ৫০০ জনের কথা বলা হয়েছে আবেদনে। পাশাপাশি হত্যায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও তদন্তের আবেদন করা হয়। আবেদনে ২৯ গণমাধ্যমকর্মীর বিরুদ্ধেও সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকউিটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম তদন্ত কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানান, ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করবেন। ট্রাইব্যুনাল দরখাস্ত মঞ্জুর করলে আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।