মন্দের সঙ্গ বোঝায় ভালোর মূল্য কত..
রাজু আহমেদ
জীবনের কোন এক পরতে মন্দ মানুষের সঙ্গ আপনাকে ভালো মানুষের অভাব বোঝাবে। খারাপ লোকের সঙ্গে জীবন যে কতোখানি বাজে ভাবে কাটতে পারে- তা যারা সয়েছে কেবল তারাই অনুধাবন করতে পারে। যে মানুষটির কাছে অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য নাই, যে অন্যের স্বাধীনতা বলতে বোঝে কেবল আনুগত্য সে মানুষটি সারাজীবন পাশাপাশি জীবন কাটিয়ে গেলেও আপন হয়ে উঠতে পারে না। যার কাছে তার নিজের স্বার্থই সব তার সাথে দু’দন্ড কাটানো মুশকিল। ভালোবেসে কিংবা চাপ দিয়ে- দু’ভাবেই কাজ আদায় করা সম্ভব তবে যে বেছে নেয় স্বৈরাচারের পথ তার জন্য মন উঠেপড়ে লাগে। অভিশাপের দীর্ঘশ্বাসে অনেক কথাই আপনা-আপনি চলে আসে। স্বগতোক্তি ভাষা পায়না বটে তবে নিঃশব্দে বুকের মাঝে বাজে! মুখে হাসি রেখে কথা বলতে হয়, বাধ্য হয়ে মাথা নাড়িয়ে সায় জানাতে হয় তবে সেখানে সম্মান-সদিচ্ছা কতটুকু থাকে তা স্বেচ্ছায় বাধ্য হওয়াদের আড়ালে ডেকে শুনলে ক্ষোভের খবর পাবেন!
মন্দ মানুষের জন্য ভালোবাসার ছন্দ থাকে না। বাধ্য করাই যার কাজ সে কখনো গোপন আনুগত্য পায় না। যে লোক পদে পদে বোঝায়- সে খারাপ, সে কখনো মনে থাকার যোগ্য হয়ে ওঠে না। তখন দূরে ছায়া ভালো লাগতে শুরু করে। আরেকজন ভালো মানুষের কথা শুনলে তার জন্য মায়া ধরে। মানুষ যখন স্বার্থের প্রতিযোগিতায় নামে, ক্ষণিকের বস সাজে- তখন যদি অতীত ভুলে যায় তবে সে আর বন্ধু হয়ে উঠতে পারে না। যে বস বন্ধু হতে পারে, যে সহকর্মী সহমর্মী হয়ে ওঠে- তারা অগোচরেই হৃদয়ে বাসা বাঁধে। অথচ যারা বোঝে না অপরের রাতদিন, যারা দেয়না ব্যক্তিত্বের স্পেস কিংবা যে ভাবে রাজ্য উদ্ধারের দায় কেবল তার- তারা অধীনদের দাস মনে করতে শুরু করে। অথচ সেই দাসদের মনে কি চলে তা যদি বস আন্দাজ করতেও পারতো তবে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিজের জন্য শ্রেয় মনে করতো।
কারো চলে যাওয়ায় যদি অন্তর না কাঁদে, মন খারাপের ঝাঁপি না খোলে তবে সেই মানুষটি কেমন মানুষ হয়ে ছিল কিংবা হৃদয়ের কতটুকুতে ছিল সেটা জানার জন্য ধান্যের আবশ্যক। দাম্পত্যের সঙ্গী হোক কিংবা পথে পাওয়া সহচর- যে তার প্রতিবেশের মনে জায়গা না পায় তাকে ভালো মানুষ বলতেই হবে- এমন দায় ঠেকেছে কার? বরং চলে যাওয়ায় যদি শূন্যতার সৃষ্টি হয়, যাদের নিয়ে চলে ওঠা-বসা তারা যদি শোকে নামায় দীর্ঘশ্বাস তবেই মনে হবে- অল্পদিনে একটা ভালো গল্প তৈরি হলো। যেদিন আর কোন ক্ষমতা থাকবে না কিংবা না কাজ করবে না কৈফিয়তের চেইন- সেদিন যদি সহকর্মীদের কেউ খোঁজ নেয়, অনুভব করে সঙ্গের দিনগুলো কিংবা স্মৃতি চারণে চোখের কোণ ঝিলিক দিয়ে ওঠে তবেই আজন্মের শ্রেষ্ঠ পাওয়া নিশ্চিত হবে। সে গেলে বাঁচি- এই যদি হয় প্রার্থণা তবে সেই সমাজের বড়রা ছোটদের মন জয় করতে পারেনি। যেটুকু আদায় করেছিল সেটুকু তার নামে/পদের জন্য ভয়। সম্মান সেখান থেকে আরও দূর-বহুদূরে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল; ডাকা হয়নি বরণডালায়।
দু’চারজন মন্দ লোকের দরকার একজীবনে নাই যে- জোর দিয়ে সেটাও প্রত্যাখ্যান করতে পারছিনে। ভালোর কদর করতে হলে, নিজের কিছু শেখার হলেও খারাপ মানুষের কাছাকাছি আসতে হয়। একজন খারাপ মানুষের সাথে বসবাসের অভিজ্ঞতা সারাজীবনের জন্যে ভালো মানুষ হয়ে ওঠার প্রেরণা দেয়। কোথায়, কতটুকু শোধরাতে হবে সেটাও জানা যায়। আশেপাশে ঘিরে থাকা যে মানুষগুলো আসলেই ভালো তাদের ওপর কোমল হতে শিক্ষা দেয়। মন্দ মানুষ জীবনে সাথে মিশে না যাক তবে অভিজ্ঞতা ঝুলিতে কিঞ্চিৎ তিক্ততা জমলে তবেই শুদ্ধতার মূল্য বুঝতে সুবিধা হয়! খারাপ- সে কত খারাপ হতে পারে সেটা না জানলে, ভালো- সে কতোখানি আলোর ঝোলা বহন করে তা বোঝা মুশকিল। ভালোকে সঠিকভাবে মূল্যায়নের জন্য মন্দের গভীরতা মাপাও জরুরি। তবে মন্দে আটকে থাকা শোভনীয় নয়।
জীবন কুয়াশা আসে নতুন ভোরের আলো দেখানোর জন্য। মন্দ মানুষের ছায়া কেটে গেলে তবেই ভালো মানুষের আবরণ কাছাকাছি হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান শেষে যে ভালোমানুষের দেখা তাকে আলিঙ্গন করার জন্য নিজেকেও ভালোমানুষ কাতারে রাখতে হবে। মানুষকে বেদনা দিয়ে, কটু কথা বলে কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্ষণিকের তরে কাছে পাওয়া গেলেও যে পাওয়া চিরকালের জন্য হয়- সেটার নাগাল পাওয়া যায় না। বরং একজন খারাপ মানুষের অভিজ্ঞতা ভালোমানুষের প্রত্যেক কথা ও কাজের জন্য দোয়া অবধারিত করে। জীবনের যতোগুলো শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি তার মধ্যে ভালো মানুষের সাথে দেখা পাওয়া, ওঠাবসা হওয়া ভাগ্যলিপির শীর্ষেই মর্যাদা নিয়ে থাকবে। একজন মন্দ মানুষ দুনিয়ার দিনগুলোকে জাহান্নামের আবেশে জঘন্য করে তুলতে পারেন। অথচ যারা ভালো মানুষ তাদের সঙ্গে প্রত্যেকটা দিন স্নিগ্ধ আলোয় ঝলমলে হতে পারে। স্বর্গের সুরঙ্গে পরিবার ও পরিবেশের সাথে যোগাযোগ ঘটাতে পারে।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
raju69alive@gmail.com