অসংখ্য কালজয়ী গানের গীতিকবি নজরুল ইসলাম বাবু
অসংখ্য কালজয়ী গানের গীতিকবি নজরুল ইসলাম বাবু
দৈনিকসিলেটডেস্ক
ক্ষণজন্মা গীতিকবি নজরুল ইসলাম বাবু। মাত্র ৪১ বছর বয়সেই চলে যান না ফেরার দেশে। ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’সহ এমন আরও অনেক দেশের গানের রচয়িতা নজরুল ইসলাম বাবু। শুধু কি দেশের গান? তিনি লিখেছেন সুবীর নন্দীর কণ্ঠে ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, সে কথা তুমি যদি জানতে’ শাম্মী আকতারের কণ্ঠে ‘মনে হয় হাজার বছর ধরে দেখি না তোমায়’, আশা ভোঁসলে ও বেবী নাজনীনের ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপনেরও রাত’, কুমার শানুর কণ্ঠে ‘আমার মনের আকাশে আজ জ্বলে শুকতারা’, হৈমন্তী শুক্লার কণ্ঠে ‘ডাকে পাখি খোল আঁখি’- এমন সব জনপ্রিয় গানের রচয়িতা নজরুল ইসলাম বাবু।
সমৃদ্ধ করেছেন চলচ্চিত্রের গানও। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৭৮ সালে সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে প্রথম চলচ্চিত্রে গান লেখা শুরু করেন। তিনি যেসব সিনেমাতে গান লেখেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আঁখি মিলন, দুই পয়সার আলতা, সাক্ষী, মহানায়ক, নসিব, বউ শাশুড়ি, সুখ, প্রতিরোধ, শুভদা, প্রতিঘাত, উসিলা, চাকর, পদ্মা মেঘনা যমুনা, প্রেমের প্রতিদান, সিপাহি প্রভৃতি।
১৯৯১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’র গীত রচনার জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। মৃত্যুর তিন দশক পর ২০২২ সালে পান একুশে পদক। গুণী এই গীতিকবির গান কণ্ঠে তুলেছেন বশীর আহমেদ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, আশা ভোঁসলে, সুবীর নন্দী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, শাম্মী আখতার, দিলরুবা খান, বেবী নাজনীন, সুখেন্দু চক্রবর্তী, এন্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, শুভ্র দেব, কুমার শানুসহ অনেকেই।
দিলরুবা খানের কণ্ঠে আরেক বিখ্যাত গান ‘রেললাইন বহে সমান্তরাল’। এই গানের নেপথ্য গল্প সুরকার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বলেন, ‘আশির দশকের শরুর দিকের কথা। কোরবানির ঈদের পরদিন। সকালে চালের রুটি ও মাংস দিয়ে নাশতা করে রিকশায় বের হয়েছিলেন দুই বন্ধু। মালিবাগ রেলক্রসিংয়ে হঠাৎ ট্রেন এলো। রিকশা থামল। ঝিকঝিক আওয়াজে ট্রেন যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখমুখ বড় হয়ে গেল নজরুল ইসলাম বাবুর। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সব কটি সিগারেট ফেলে দিলেন। প্যাকেটর সাদা কাগজে লিখলেন, ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল/রেললাইন বহে সমান্তরাল বহে সমান্তরাল…। রিকশায় বসে পুরো গান লেখা হয়ে গেল।
নজরুল ইসলাম বাবু এমনই সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন। যার আত্মার সঙ্গে মিশে ছিল গান। একজন গীতিকবির অসংখ্য কালজয়ী গান থাকার পরও তাকে কেউ মনে রাখেনি, তাকে নিয়ে আলোচনা হয় না কোথাও, কোনো সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠান নজরুল ইসলাম বাবুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেও দেখা যায় না।
স্বাধীনতার পর যে কজন গীতিকার বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন নজরুল ইসলাম বাবু ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। এ প্রজন্ম হয়তো জানেই না বিখ্যাত গানগুলোর রচয়িতা নজরুল ইসলাম বাবু।
নজরুল ইসলাম বাবু সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বলেন, অসম্ভব প্রতিভাবান গীতিকার ছিলেন বাবু। সত্যিকার কবিপ্রতিভা নিয়ে জন্ম নিলেও নজরুল ইসলাম বাবু আধুনিক কবিতার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে নিবিষ্ট হয়েছিলেন গানের কবিতায়। ওর বিষয়চয়ন ছিল খুব সুন্দর, অদ্ভুত সব আইডিয়া নিয়ে আসতেন গানে। ওর মধ্যে একটা পাগলামি ছিল। নিজে যেটা লিখে ফেলত, সেটির ছন্দ বা অন্য কোনো ভুল থাকলে তা সংশোধন করতে চাইত না। বলত, যা লিখেছি লিখে ফেলেছি, আর চেঞ্জ করব না।’
নজরুল ইসলাম বাবু শুধু গীতিকবিই নন, একজন সম্মুখ সারির মুক্তিযোদ্ধাও। ১৯৭১ সালে ১১ নম্বর সেক্টরে তুরার পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তার অন্যতম দায়িত্ব ছিল বিস্ফোরক দিয়ে ভারী ও মজবুত সেতু ধ্বংস করা। যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ২২ বছরের তরুণ। ১৯৭০ সালে সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্রনেতা হিসেবে তার ওপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে তিনি আত্মগোপন করে চলে যান ভারতে। ট্রেনিং শেষে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার লেখাপড়া, সাহিত্য ও সংগীত চর্চা শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে বিএসসিতে ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জের চরনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল ইসলাম বাবু। তার পৈতৃক বাড়ি একই উপজেলার হেমাড়াবাড়ি গ্রামে। তার বাবার নাম বজলুল কাদের এবং মা রেজিয়া বেগম। ১৯৮৪ সালের ২৩ নভেম্বর শাহীন আক্তারকে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তানের নাম নাজিয়া ও নাফিয়া। মহাকাল তাকে বেশি দূর যেতে দেননি। ১৯৯০ সালের আজকের দিনে (১৪ সেপ্টেম্বর) থেমে যায় তার প্রাণ। কিন্তু নজরুল ইসলাম বাবু প্রতিদিনই ফিরে আসেন গানে গানে।
কালজয়ী গান
সব কটা জানালা খুলে দাও না
একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার
রেললাইন বহে সমান্তরাল
কথা বলবো না বলেছি, শুনবো না শুনেছি
কাল সারারাত ছিল স্বপনের রাত
কাঠ পুড়লে কয়লা হয় আর কয়লা পুড়লে ছাই
পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই
সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী
আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে
আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়
কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো
আমার মনের আকাশে আজ জ্বলে শুকতারা
ডাকে পাখি খোলো আঁখি
সূত্র:আমাদেরসময়