সাবেক মন্ত্রী ইমরানের অবৈধ সম্পদের পাহাড়
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। সিন্ডিকেট ও মানবপাচার করে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণের অর্থ। নিজের হলফনামা বলছে, গেল ১৫ বছরে তার সম্পদ ৬৮ গুণ বেড়েছে। ইমরান আহমদের দুর্নীতির অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুদক। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ঢাকার পল্টন থানায় ২৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলাও হয়েছে।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম পর্যায়ে যে ১৮ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর অবৈধ সম্পদের খোঁজ নিতে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তিনি তাদের অন্যতম। তার বিরুদ্ধে মানবপাচার ও সিন্ডিকেট করে ২৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলাও হয়েছে। তার বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে বালু মহাল-চোরাচালানসহ বিভিন্ন সিন্ডিকেট থেকে নিয়মিত অর্থ ভাগ-বাটোয়ারার অভিযোগ বহু পুরনো। এ সকল বিষয়সহ আরও অনেক বিষয়ে দুদক তদন্ত করছে।
সম্পদ বেড়েছে ৬৮ গুণ বেশি
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন ইসিতে দেয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গেল ১৪ বছরে ইমরান আহমদের সম্পদ ৬৮ গুণ বেশি বেড়েছে।
২০০৯ সালের হলফনামায় তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল যেখানে ৫ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা সেখানে ঠিক ১৪ বছর পরে ২০২৩ সালে অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৩৫ হাজার ৭১৯ টাকা। বেড়েছে স্থাবর সম্পদের পরিমাণও।
হলফনামা বলছে, ২০০৯ সালে তার স্থাবর সম্পদ ছিল নিজের নামে ৪ দশমিক ৫০ একর কৃষিজমি। যার দাম ৫৫ হাজার টাকা। ২০১৪ সালে তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২ লাখ ৪২ হাজার ৩৮২ টাকা আর স্থাবর সম্পদ হিসেবে আগের সাড়ে ৪ একর কৃষি জমি ছাড়াও তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে শ্রীপুর চা বাগানের ১৩/২ অংশের মালিক। কিন্তু এর আগের ২০০৯ সালের হলফনামায় চা বাগানের মালিকানার তথ্য উল্লেখ করেননি ইমরান আহমদ। ২০১৮ সালে তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দাড়ায় ১ কোটি ৫২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৯৭ টাকা এবং পরের নির্বাচন অর্থাৎ ২০২৩ সালের হলফনামা অনুযায়ী তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৩৫ হাজার ৭১৯ টাকা। ২০১৮ সালে তিনি পৈতৃক সূত্রে ২৪ দশমিক ২৭ একর কৃষি জমির মালিক হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন।
আছে গাড়ি বিলাসও
সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি ইমরান আহমদের আছে গাড়ি বিলাসও। ২০০৯ সালের হলফনামায় গাড়ির কোনো তথ্য দেননি। এর পরের বারের হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেন তার একটি পাজারো জীপ আছে, এটির দাম ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর পরের বারের হলফনামায় লিখেছেন তার টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো একটি গাড়ি আছে। গাড়িটির দাম ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সর্বশেষ দেয়া হলফনামায় তথ্য দেন, তার একটি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো ব্যান্ডের গাড়ি আছে। এর দাম ৪৭ লাখ ৭০ হাজার ৫৩৫ টাকা। তিনবার পৃথক পৃথক গাড়ির তথ্য দেয়া হলেও এগুলো শুল্ক বিহীন সংসদ সদস্য কোটায় আমদানি করা হয়েছে না বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে কেনা এর কোনো তথ্য দেননি। উল্লেখ নেই গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বরও।
গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়
সূত্র বলছে, সিলেট-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইমরান আহমদ ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, জাফলং পাথর কোয়ারি, বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারিসহ সবক’টি পাথর ও বালু মহাল থেকে নিয়মিত মোটা অংকের ভাগ পেতেন। কারণ, এসব পাথর কোয়ারি ও বালু মহাল তার ঘনিষ্ঠজনরা নিয়ন্ত্রণ করতেন। এসব পাথর কোয়ারি ও বালু মহাল থেকে ইমরান আহমদের ঘনিষ্ঠজনরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। একেকজন গড়ে তুলেছেন বিশাল অট্টালিকা। এছাড়াও প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী থাকাকালে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণের অর্থ হাতিয়ে নেন। এসব অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এসব অর্থ দিয়ে দেশে-বিদেশে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেন ইমরান।
গেল ৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ইমরান আহমদসহ ১০৩ জনের বিরুদ্ধে ২৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রাজধানীর পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। জনৈক ট্রাভেল ব্যবসায়ী আলতাব খান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় ইমরান আহমদকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। ওই মামলার এজাহারে বলা হয়, সাবেক প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ, সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, সাবেক সংসদ সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, নিজাম হাজারী ও বেনজীর আহমেদসহ ১০৩ জনের সিন্ডিকেট মানবপাচার করে ২৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। পল্টন থানার ওসি মো. খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, চাঞ্চল্যকর এই মামলার আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
তিনি দুদকের প্রথম তালিকায়
দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকে স্বৈরাচারী সরকারের বহু মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে প্রমাণাদিসহ অভিযোগ দিলেও দুদক রহস্যজনক নীরব ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ঝিমিয়ে পড়া দুদকও যেন গা ঝাড়া দেয়। শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতি খুঁজে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রথম দফায় পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ১৮ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক ২৩ সংসদ সদস্যসহ মোট ৪১ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। দুদকের প্রথম তালিকার ওই ৪১ জনের মধ্যে ইমরান আহমদ অন্যতম বলে দুদক সূত্র নিশ্চিত করেছে। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের পরবর্তী একাদশ সংসদের মন্ত্রিপরিষদে ইমরান আহমদ প্রথমে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ও পরবর্তীতে পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
ইমরান আহমদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি
এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে ইমরান আহমদের সেলফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় কোনো সূত্রেই তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত, ইমরান আহমদ ১৯৮৬ সাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। তিনি ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ, ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ, ১৯৯৬ সালের উপ-নির্বাচন, ২০০৮ সালের নবম সংসদ, ২০১৪ সালের দশম সংসদ, ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ এবং সর্বশেষ বাতিল হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সিলেট-৪ (জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সুত্র: দৈনিক সিলেটের ডাক