গ্রেফতার সাবেক দুই ডজন মন্ত্রী-এমপি
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা দেশের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও এমপি এখন গ্রেফতার ও মামলা আতঙ্কে ভুগছেন। গ্রেফতার এড়াতে কেউ দেশে নিরাপদ আশ্রয়ে, কেউ বা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন। এরই মধ্যে অন্তত দুই ডজন মন্ত্রী-এমপি, দলের শীর্ষ নেতা হয়েছেন গ্রেফতার, রিমান্ড শেষে অনেকে কারাগারে দিনাতিপাত করছেন। যারা দেশত্যাগ করতে পারেননি, তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। এই তালিকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যেমন আছেন, তেমনি আছেন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও।
জানা গেছে, গণহারে হত্যা মামলায় বাদ পড়ছেন না কেউ। শঙ্কা জেগেছে আইনি লড়াইয়ের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের। যাদের নামে এখনো মামলা হয়নি, তাদের কাছে অজ্ঞাতনামা আসামি যেন আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। হুমকি পেয়ে কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে মামলা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন। আপসরফা না হলেই নেমে আসছে হত্যা মামলার মতো খড়্গ। অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভাঙচুরের শিকার বেশিরভাগই। আত্মগোপনে থাকায় অনেকে চাকরিস্থল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যেতে না পারায় অর্থকষ্টে আছেন পরিবারের সদস্যরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশত্যাগ করেন। বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে ছোট বোন শেখ রেহানাসহ ভারতে যান। অবসান ঘটে আওয়ামী লীগের টানা চারবারের শাসনামলের। দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর পর থেকে দ্রুত দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রী ও এমপিরা গা-ঢাকা দিতে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান, অনেকে দেশত্যাগ করেন।
গ্রেফতার হতে শুরু করেন আওয়ামী লীগের নেতা, আলোচিত মন্ত্রী ও এমপি। এরই মধ্যে দেশজুড়ে শুরু হয় গণহারে হত্যা মামলা দায়ের, আসামির সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় শত শত আওয়ামী লীগের অনুসারীর নাম, অজ্ঞাত রাখা হয় হাজার হাজার। একের পর এক এসব মামলায় আসামির তালিকায় আসতে থাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, তার ছোট বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ শীর্ষ প্রায় সব নেতা ও এমপি-মন্ত্রীর নাম।
আওয়ামী লীগ সরকারের ২৬ জন মন্ত্রী-সংসদ সদস্য, উপদেষ্টা ও শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ১৩ আগস্ট থেকে শুরু হয় আওয়ামী লীগের বিতর্কিত মন্ত্রী, আর্থিক অনিয়মের জন্য আলোচিত ব্যক্তিবর্গের গ্রেফতার। এ ছাড়া আরও দুজন ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সর্বশেষ গত শনিবার রাতে গ্রেফতার হয়েছেন সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ও এমপি শাহে আলম তালুকদার।
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বেসরকারি শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে গ্রেফতারের মাধ্যমে শুরু হয় এই মিছিল। এরপর একে একে সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক পর্যটন ও বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ এবং সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আরিফ খান জয় আটক হন।
সাবেক এমপিদের মধ্য নেত্রকোনা-৫ আসনের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, মাদারীপুর-৩ আসনের দলের প্রচার সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ, চট্টগ্রাম-৬ আসনের এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, কক্সবাজার-৪-এর আব্দুর রহমান বদি, বরিশাল-২ আসনের শাহে আলম তালুকদার, চট্টগ্রাম-১১ আসনের এম এ লতিফ, ঠাকুরগাঁও-১ আসনের রমেশ চন্দ্র সেন, ঢাকা-৭ আসনের হাজী সেলিম, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের মাজহারুল ইসলাম সুজন, ঝিনাইদহ-১ আসনের নায়েব আলী জোয়ার্দার, ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফেনী-২ আসনের নিজামউদ্দিন হাজারীকে সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আটক করে।
এ ছাড়া বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির, ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে, গতকাল রোববার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করা হয়েছে। ২০২২ সালে ড. ইউনূসকে পদ্মা নদীতে চুবানি এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নদীতে ফেলে দেওয়ার হুমকির অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে এই হত্যাচেষ্টা মামলা হয়।
আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হলে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, প্রতিদিনই শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। সঠিক তথ্য নিরূপণ করা সম্ভব না হলেও মামলার সংখ্যা দেড়শ পেরিয়েছে। গত শনিবার ঢাকার পল্টন থানায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রায় সব শীর্ষ নেতাকে আসামি করা হলেও নাম ছিল না শেখ হাসিনার। তবে এক নম্বর আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে।
এদিকে, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ছাড়াও সারা দেশের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নামেও মামলা হয়েছে, এখনো মামলা চলমান রয়েছে।
জানা গেছে, খুলনা বিভাগে অন্তত ৪৩টি ও বরিশাল বিভাগে কমপক্ষে ১৯টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে বরগুনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনালাপের কারণে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীরসহ ৩১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রংপুর বিভাগে অন্তত ২১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর নামও আসামির তালিকায় রয়েছে। সিলেট বিভাগে অন্তত দুই ডজন মামলা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম বিভাগে অন্তত ৫০টি মামলা হয়েছে। রাজশাহী বিভাগে অন্তত ৪৫টি মামলা হয়েছে। ঢাকা বিভাগে এসব মামলার সংখ্যা শতাধিক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গণমাধ্যমকে বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হয়রানি করতেই এসব মামলা করা হয়েছে। ঢালাওভাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নামে হত্যা মামলা করা হচ্ছে। বাদ যাচ্ছেন না সহযোগী সংগঠনের নেতারাও। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোকাবিলা করা হবে; কিন্তু আইনি লড়াইয়ের মতো মানবাধিকার আওয়ামী লীগের জন্য সংরক্ষিত থাকবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা জানান তিনি।