‘আমার ওপর রাগ করবেন না’
দৈনিকসিলেটডেস্ক
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শুরু থেকেই সরব ছিলেন সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। প্রতিবাদী গান ও কবিতা নিয়ে ছিলেন রাজপথে। শুধু ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনই নয়, বিগত সরকারের সকল দমনপীড়নে বিরুদ্ধেও কথা বলে গেছেন এই সংগীতশিল্পী। গেল ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন তিনি। যা শিল্পী নিজেই জানিয়েছেন তার ফেসবুকে।
সরকার পতনের পর যখনই দেশে কোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা গেছে, এমনকি মব ভায়োলেন্সে অনেকেই হত্যার শিকার হয়েছেন, তখন অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সায়ানের বর্তমান অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, স্বৈরাচার পতনে সক্রিয় ছিলেন, কিন্তু চলমান নৈরাজ্যের সময় তিনি কেন চুপ? কেন তিনি প্রতিবাদী গান কবিতায় গর্জে উঠছেন না? কেউ তো আবার ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, সায়ান আর নেই!
এসব কিছুই দৃষ্টিগোচড় হয়েছে শিল্পী সায়ানের। শুধু তাই নয়, তার ফেসবুক মেসেঞ্জার থেকে ইমেইলেও এমন শত শত অভিযোগ। এসব দেখে আর চুপ থাকেননি সায়ান। প্রশ্নকারীদের উদ্দেশে ‘তুমি যখন আমার বিচার করো’ নামে একটি কবিতাও পড়ে শোনান এই শিল্পী। সঙ্গে সঙ্গে কথা বলেছেন কবিতাটি লেখার প্রেক্ষাপট নিয়েও।
প্রায় ১৫ মিনিটের ভিডিওবার্তায় সায়ান এক পর্যায়ে বলেণ, ‘স্বৈরাচার পতনের পরে অনেকেই আঘাত পেয়েছেন। একজন তো ইমেইল করে আমাকে বলেছেন, এত বড় অন্যায় আমি বা আমরা যে করলাম, তার জন্য আমার নাকি প্রায়শ্চিত করা উচিত। স্বৈরাচারের পতন হলো এজন্য আমাকে বকছেন, আমাকে এত বড় কৃতিত্বটা দিচ্ছেন? এত রক্ত ঝরল, এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল, এত মানুষের চোখ অন্ধ হয়ে গেল- আমি একজন সাধারণ লেখক কবি। আমি কী করতাম? বলেনতো? তবে এ কথাটা সত্যি, আমি যদি পারতাম- স্বৈরাচারের পতন স্বৈরাচার হওয়ার আগেই ঘটাতাম!’
‘সায়ান মারা গেছেন’- এমনটাও কেউ কেউ সমাজমাধ্যমে ছড়াচ্ছেন। তাদের উদ্দেশে প্রতিবাদী এই শিল্পী বলেন ‘আমি কী করি, আমি গান গাই কবিতা লিখি। আমি গান বা কবিতার বাইরে গিয়ে কোনো প্রতিবাদ করব না। আপনাকেও যদি কখনো উত্তর দিতে হয়, আমি কবিতা বা গানের মধ্যদিয়ে দিব। আমার পথ এটা। সেভাবেই কথা বলব। এটাই আমার শিক্ষা। আপনি আমাকে অপছন্দ করতে পারেন, আপনার হক আছে। আপনার এই অধিকারকে আমি সম্মান করি। আমারও হক আছে আপনাকে অপছন্দ করার, কিন্তু তাই বলে আমি আপনাকে আক্রমণ করব না। এই যে বলেছেন, আমি মারা গেছি- আমার পরিবারের লোকজন চিন্তিত হয়ে গেছেন। এগুলো আসলে খুব যা-তা, পচা কাজ। এগুলো না করলেও হয়।’
স্বৈরাচার পতনের পরবর্তী সময়ে নিজের অবস্থান পরিস্কার করে সায়ান বলেন, ‘স্বৈরাচারের ষোল বছরে আমরা ভয়ে থাকতাম। কিন্তু তখনো আমরা গান গাইতাম, কবিতা লিখতাম। তার বাইরে তো আমরা কিছু করতাম না। এখনো তাই করব। এই মব ভায়োলেন্স হচ্ছে, এত দুর্ঘটনা ঘটছে, এত কিছু হচ্ছে- এটার উত্তর কি আমি আরেকজনকে আক্রমণ করে দিব? এটা কিন্তু আমি করব না। এটা আমার পথ নয়। আমার পথ হলো, আমার কাজের মধ্যদিয়ে আমি আমার প্রতিবাদটা করব। যখন সম্ভব হবে, মনের সাঁয় থাকবে- তখনই সশরীরে হাজির হবো। আপনি চাইছেন বলে তো আমি কোথাও যাব না। আপনি যেমন স্বাধীন মানুষ, আমিও তাই। কিন্তু আপনি আপনার স্বাধীনতা ব্যবহার করছেন অন্যজনকে আক্রমণ করে, আমার মতো আরো অনেককে আপনি/আপনারা আক্রমণ করছেন। স্বৈরাচারের পতনের জন্য আপনি যে মানুষগুলোতে দোষী করছেন, দায়ী করছেন- আমাদের ওপর রাগ করছেন; আসলে স্বৈরাচারের পতনের কারণ আসলে স্বৈরাচার নিজেই। যখন কেউ স্বৈরাচার হয়ে উঠে, অন্যদের তখন খুব বেশি কিছু করতে হয় না।’
সবশেষে সায়ান বলেন, ‘গণহত্যার কারণে আসলে মানুষের মৃত্যু ভয় চলে গিয়েছিল। আমি আমার সাধারণ বুদ্ধিতে এটুকু বুঝি। মানুষ আসলে আর মৃত্যুর পরোয়াটা করেনি। সবাই মরতে চলে গিয়েছিল। তারপর যা হওয়ার হয়েছে। এখানে কিন্তু আমি একা কিছু করিনি। বরং আমি বলব, আমি ব্যর্থ মানুষ। অনেক দিন ধরেই এই ঘটনাটি ঘটাতে চেষ্টা করেছি, পারিনি। মুরদ ছিল না। মুরদ কাদের ছিল জানেন, ওই শিক্ষার্থী বাচ্চাগুলোর। মরে-টরে গিয়ে এই ঘটনাটি ঘটিয়ে দিয়ে গেল। ওদেরকে আদর। তাই বলি, আমার ওপর রাগ করবেন না। গালি দিবেন না, পচা কথা বলবেন না। মানুষকে আক্রমণ না করাই ভালো।’