পঞ্চম কাব্য ও কবির অবয়ব
সরওয়ার ফারুকী
‘নিলামে উঠুক তোমার পৃথিবী’ হাতে নিয়ে কবি বলেন, এ আমার সেরা কাব্য। আত্মতৃপ্তিতে যখন একজন কবি এমন বলেন, তখন তা অন্যরকম মাত্রা যোগ করে এবং আমাদের ভাবনায় সাাড়া ফেলে। যদিও একটি কাব্য একজন কবিকে জানবার জন্য যথেষ্ট নয়, কিন্তু কবি যখন আত্মবিশ্বাসে ‘আমার সেরা কাব্য’ বলেন, তখন সে কাব্যই হয়ে ওঠে তাঁর অবয়ব, তার মনোজগত বোঝার গুরুত্বপূর্ণ স্মারক।
নিলামে উঠুক তোমার পৃথিবীতে কবির অভিমান স্পষ্ট, অনুভূতি প্রখর, ভাষা সুচালা, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। কোন অভিমানে তিনি সুন্দর এ পৃথিবীরে নিলামে ওঠালেন, কোন বেদনায় অপরূপ ধরণীর হাত ছুঁড়লেন তা দেখা যায়, বোঝা যায়। বর্ণিল পাখির ডানার মতো এ কাব্যের বাঁকে-বাঁকে তার শব্দবান যেখানে স্ফুরিত মান-অভিমানের নানান দ্বন্ধ। এ দ্বন্ধের শেষ মঞ্জিলে দাঁড়িয়ে আছেন কবি নিজে দেখছেন তার নিলামের পৃথিবীর দ্বন্ধসমূহ।
পৃথিবী আমাদের অস্তিত্বের প্রতীক, এখানেই আমাদের উপস্থিতি, এর অপরূপ সৌন্দর্যে আমাদের অবগাহন। দিন-রাত্রি, জন্ম-মৃত্যুর অনিবার্য এক খেলায় আমাদের নিরন্তর আসা-যাওয়া এখানে। এই অস্তিত্বের প্রতি কবি যখন প্রশ্ন ছুঁড়েন, তাকে বিসর্জন দেন, নিলামে তোলেন তখন কবির আত্মায় যে মারেফাতের নুরের বিচ্ছুরণ হয় তা টের পাওয়া যায়।
”নিলামে উঠুক তোমার পৃথিবী কবি মুহিত’ চৌধুরীর পঞ্চম কাব্য, এ কাব্যে সাইত্রিশটি কবিতা আছে। যে-যে কারণে কবি এ পৃথিবীকে নিলামে তুলছেন, কাব্যে তার কারণ লুকিয়ে আছে। কচ্ছপের মতো হামাগুড়ি দিয়ে হেটেও কবি ক্রোধ-হিংসা, প্রবঞ্চনা থেকে নিস্তার যে পাচ্ছেন না, তা শিরোনাম কবিতায় অঙ্কিত। মনিপুর জ্বলছে, ঘৃণার অনলে কবিতায় বিকেলের মেঘ-বাতাসে কান্নার গুঞ্জরন, উদোম শরীর খাবলে খাওয়ার দগদগে দাগগুলোর যে যন্ত্রণা তা-ও পৃথিবীকে নিলামে তুলবার আরেক কারণ।
কবি এ কাব্যে মনিপুর থেকে গাজার ধ্বংস্তুপ পর্যন্ত স্থানে-স্থানে প্রতিবাদী আওয়াজ তুলেছেন। লাস্যময়ী সময়ের ইতিরেখা এঁকেছেন, জালিমের উদ্ধত তর্জনী নামানোর নির্দেশনা দিয়েছেন, কিন্তু কবির আহবান-নির্দেশনা-হাহাকার বাতাসের ফাঁকে-ফাঁকে মিলিয়ে গেছে, তার কথা কেউ শোনে নি, কথা রাখে নি তাই এ পৃথিবীকে নিলামে ওঠাচ্ছেন কবি!
রাতে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে/অসুস্থ শরীর নিয়ে তুমি জেগে থাকতে ‘মা’ কবিতায় এভাবেই রয়েছে কোল-বেলার স্মৃতি। মা শিরোনাম কবিতার পরের কবিতা ‘তুমি ছাড়া আর কেউ নেই’। মহাপরাক্রমশালী প্রভুর দরবারে এ কবিতা যেন নানারকম মান-অভিমানের চিঠি-চালাচালি, আশরফ-আতরফের ভেদ ভেঙে প্রভুর দরবারে আপন আর্তির এক মন্থনগাঁথা।
একাত্মবাদী কবি মুহিত চৌধুরীর নিলামে উঠুক তোমার পৃথিবী-জুড়ে আছে ঐশ্বরিক এক ছোঁয়া যা প্রাণে এসে লাগে, চোখে ঢেউ তোলে। এ কাব্যের ল্যান্ডমার্ক কবিতা হয়তো ‘যদি মন চায় তবে কাঁদো’। কবি লিখছেন;
যদি মন চায় কাঁদতে, তবে কাঁদো তাঁর জন্য/যে অক্ষয়-অমর চিরঞ্জীব।
আমরা সকলেই মহাগাঙের কিনারে বসে আছি, কেউ তার ধ্বনি শুনি, কেউ শুনি না। আমাদের রূহের কিনারে প্রতিনিয়ত মহাগাঙের শত-সহস্র ঢেউ এসে আছাড় খায়; তার আঘাতেই আমাদের প্রাণ কাঁদে, চোখ উছলায়। সেসকল ঢেউয়ের ধ্বনি বেজে ওঠে আমাদের কবিতায়, কণ্ঠে, প্রকাশ হয় শিল্প-সাহিত্যে। বিশ্বকবির ভাষায় যদি বলি,
‘আমি কান পেতে রই আমার আপন হৃদয়-গহন-দ্বারে
কোন্ গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে।
ভ্রমর সেথায় হয় বিবাগি নিভৃত নীলপদ্ম লাগি যে,
তার রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে।’
সরওয়ার ফারুকী: কবি ও গবেষক