মামলার বিষয়বস্তু ও আসামি সম্পর্কে অবগত নন বাদী
বিয়ানীবাজার প্রতিনিধি
* মামলার এজাহারে কোন পুলিশ সদস্যের নাম নেই
* স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চাইলেন তারেকের পরিবার
বয়স ও অসুস্থতার সাথে লড়াই করে সর্বদা জয়ী হওয়া ইনারুন বেগমকে এবার পরাজয় মেনে নিতে হচ্ছে অভাব ও দারিদ্রতার কাছে। তাই দুঃখ-দুর্দশাই এখন নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মৃত্যুবরণকারী তারেকের মা ইনারুন বেগমের। অসুস্থ স্বামী রফিক উদ্দিন ও পাঁচ সন্তান নিয়ে সুখেই কাটছিল তার দিনগুলো। কিন্তু হঠাৎ করে আসা ঝড় সব কিছু তছনছ করে দেয় ইনারুন বেগমের সুখের সংসারকে। আট মাস আগে স্বামীকে হারানোর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই ৫ আগষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে প্রাণ হারান তার ছেলে তারেক আহমেদ। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে তারেক আহমদকে হারিয়ে ইনারুন বেগম এখন দিশেহারা। কলিজার টুকরো ছেলেকে এভাবে হারাতে হবে তা কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। দিন রাত শুধু ছেলের কথা মনে পড়ে। এই বুঝি তার ছেলে ফিরে এসে বলছে মা তুমি কোথায়। পৃথিবীর সকল কষ্টের পাহাড় যেন বাসা বেধেছে তার বুকে। অসহায় এই জীবন আর কত বয়ে বেড়াবেন তিনি। স্বামী-সন্তান হারিয়ে তিলে তিলে যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে তার জীবন।নিহত তারেক বিয়ানীবাজার মোল্লাপুর ইউনিয়নের নিধনপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃত রফিক উদ্দিনের ছেলে। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তারেক ছিলেন তৃতীয়। তারেকের বড় বোন মর্জিনার বিয়ে হয়েছে আগে। অপর বোন তান্নি ম্যানেজমেন্ট (অনার্স) সম্পন্ন করেছেন।তান্নি বলেন, আমাদের বাবা মারা গেছেন আমরা এতটা কষ্ট পাইনি। তারেক আমাদের সকল চাওয়া পূরণ করতো। মায়ের ঔষধ থেকে শুরু করে সংসারের চাহিদা মিটতো তার রোজগার থেকে। তিনি দুই বছর আগে বিয়ে করেছে। তার ১ বছর বয়সী ছেলে সন্তান রয়েছে।
তারেকের বড় ভাই লায়েক বলেন, ৫ আগষ্ট বিয়ানীবাজার শহরে আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ চলে। তার ভাই তারেকও আন্দেলনে সক্রিয় ছিলো। আমাদের পরিচিত কয়েকজন জানান ওইদিন দুপুরের কোন এক সময় পুলিশ তারেককে ধরে নিয়ে যায়। সারাদিন পুলিশ জনতার সংঘর্ষ চলায় পুলিশের সাথে তারা কোন যোগাযোগ করতে পারেন নি। ঘটনার দিন সন্ধ্যার দিকে পুলিশ আর আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে রায়হান ও ময়নুল নামের দুজন মারা যাওয়ার খবর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এই সংবাদে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে আমার পরিবার। রাতের দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারেকের খোঁজ নেন আত্মীয়- স্বজন। অনেক জায়গায় খোঁজাখুজির পর ৬ আগষ্ট ভোরে বিয়ানীবাজার থানার সীমানা দেয়ালের কাছে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তারেকের লাশ পাওয়া যায়। তারেকের কপালে একটি এবং দুই পায়ে গুলির চিহ্ন ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিলো। পরে তাকে উদ্ধার করে বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তারেককে মৃত ঘোষণা করেন।
লায়েকের ধারনা ছাত্র-জনতারবিক্ষোভের মুখে থানা ছেড়ে পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলি করে তারেককে হত্যা করেছে। ৬ আগষ্ট স্থানীয় মোল্লাপুর জামে মসজিদে জানাযার নামাযের পর নিধনপুর পারিবারিক কবরস্থানে তারেকের দাফন সম্পন্ন করা হয়।
তারেকের মৃত্যুতে পরিবার হারিয়েছে কর্মক্ষম একমাত্র সদস্যকে। বিদেশ ফেরত তারেকের বড় ভাই লায়েক মেরুদন্ডে আঘাত পাওয়ায় কোন কাজ করতে পারছেন
না। তারেকের ছোট ভাই ফায়েক স্থানীয় একটি ওয়ার্কশপে কাজ করে প্রতিদিন ১০০ থেকে ২০০ টাকা রোজগার করে। পরিবারে আর কোন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকায় ফায়েকের প্রতিদিনের রোজগারের উপর ভর করে চলছে তাদের পরিবার। তারেক মারা যাওয়ার তিন মাস পেরিয়ে গেছে। প্রশাসন বা ছাত্র সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে কেউ এখনও খোঁজ না নেওয়ায় হতাশ তাদের পরিবার। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত কোন সহায়তা পাননি তারা। লজ্জায় কারও কাছে সাহায্যও চাইতে পারছেন না তাই নিজেদের কষ্ট নিজেরাই ভাগ করে নিয়েছেন। ছেলে হারানোর শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তারেকের মমতাময়ী মা।
পরিবারে বিবাহ যোগ্য মেয়ে ও নিজের অসুস্থতা নিয়ে রয়েছেন মহা দুশ্চিন্তায়। নিজেদের কোন সম্পদ না থাকায় এখন নুন আনতেই পান্তা ফুরার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা অন্যান্য সুত্রে সরকারের সহযোগিতার খবর পান। কিন্ত তাদের দুর্দশাগ্রস্থ পরিবারের পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতিতে লায়েক অসহায় পরিবারের কথা চিন্তা কওে একটি চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে ছুটছেন। ছোট ভাই ফায়েকের সামান্য আয়ে নুনভাত জুটলেও বিবাহ যোগ্য বোনের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা দূর হয়না তার এঅবস্থায় নিজের শারিরিক অক্ষমতা নিয়েও লায়েক চেষ্টা করে যাচ্ছেন পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবার। তারেক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় ২০ আগষ্ট বিয়ানী বাজার থানায় মামলা দায়ের করা হয়। (নং ৪/৮২(৮)২০২৪) মামলায় বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লবকে প্রধান আসামি এবং বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব সভাপতি সজীব ভট্টাচার্য্য, সাংবাদিক মিসবাহ উদ্দিন, সাংবাদিক মহসিন রনি, সাংবাদিক সাদেক আহমদ আজাদ, সাংবাদিক আব্দুল ওয়াদুদ, সাংবাদিক পলাশ আবজালসহ ৭৫ জনের নামোল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ২০০ জনকে আসামি করা হয়। উক্ত মামলা দায়েরকালে বিয়ানীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেবদুলাল ধর কর্মরত ছিলেন। মামলার এজাহারে তারেকের বোন তান্নি ও ভাই আলী আহমেদ ফায়েক সহ মোট পাঁচ জন সাক্ষীর নাম উল্লেখ করা হয়। তারেকের পরিবার ঘটনার দিন কর্মরত পুলিশ সদস্যদেরকে তারেক হত্যায় দায়ী করলেও মামলার এজাহারে কোন পুলিশ সদস্যের নাম পাওয়া যায়নি। বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মিলাদ মো. জয়নুল ইসলাম বলেন, মামলায় সাংবাকিদের হয়রানির জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে বিয়ানীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সাথে কথা হয়েছে। তিনি আমাদের আশ্বস্থ করেছেন, কোন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হবেন না। এছাড়াও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
মামলার অগ্রগতি জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিয়ানীবাজার থানার এসআই সাবুদ্দিন জানান, আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে মাননীয় আদালত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে লাশ উত্তোলনের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের আদেশ দিয়েছেন। ময়না তদন্তের জন্য লাশ উত্তোলনের প্রস্তুতি চলছে। আলোচিত এই হত্যা মামলা সম্পর্কে কোন ধারনা নেই বলে জানিয়েছেন প্রয়াত তারেকের বড় ভাই লায়েক আহমেদ। তিনি বলেন, এই মামলায় আমার মাকে বাদি দেখানো হলেও তিনি মামলার বিষয়বস্তু ও আসামি সম্পর্কে অবগত নন। এই মামলায় আমার মা বা পরিবারের পক্ষ থেকে কাউকে আসামি করা হয়নি। আমি নিজেও দেশের বাইরে ছিলাম। তারেকের মৃত্যুতে যখন আমাদের গোটা পরিবার বিপর্যস্থ তখন কে বা কারা আমার মাকে সরকারি সহায়তার কথা বলে সাদা কাগজে সাক্ষর নিয়ে যায়। কিছুদিন পর মামলার বিষয়টি আমরা জানতে পারি। এ মামলায় আমাদের অনেক আত্মীয় স্বজনকেও আসামি করা হয়েছে, যারা সবসময় আমাদের পরিবারের পাশে ছিলেন। এজাহারে যাদের নাম এসেছে তাদের অনেকেই আছেন যারা আমার ভাই হত্যার সঙ্গে জড়িত নন। মামলা নিয়ে আমরা চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছি।
তিনি বলেন, ২২ আগষ্ট আমার মা মামলা প্রত্যাহার চেয়ে আদালতে আবেদন করেছেন। কিন্তু আদালতের সিদ্ধান্ত এখনো জানতে পারিনি। ভাইয়ের প্রকৃত হত্যাকারিদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় লায়েক আহমদ তার আনার জন্য অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।