রাফায়েল নাদাল: টেনিসের রাজ্যে ‘স্প্যানিশ সম্রাট’
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
ডেভিস কাপের ডাবলসের লড়াই। গভীর মনোযোগে খেলা দেখছেন ৩৮ বছরের এক ভদ্রলোক। কার্লোস আলকারাজ ও মারসেল গ্রানোয়ার্স জুটি হেরে যেতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। চেহারায় বিষন্নতার ছাপ, মনে বিষাদের ঝড়। যে ঝড় বুকে পুষে ২৩ বছর আগে এই ডেভিস কাপেই শুরু হয়েছিল ক্যারিয়ার। সেই ক্যারিয়ার টেনিস সাম্রাজের অলিগলি ঘুরে শেষ হলো একই মঞ্চে। সেই সঙ্গে টেনিসের আকাশেও থমকে গেল ‘রাফায়েল নাদাল’ নামক নক্ষত্রের আলোক ঝর্ণাটি।
নাদাল, টেনিসের রাজ্যে স্পেনের পতাকা বয়ে নিয়ে যিনি হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি। ২০০১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রথম প্রতিযোগিতামুলক টেনিসের মঞ্চে পা রাখা। এরপর আর পেছনে ফিরতে তাকাতে হয়নি। টেনিস তাকে আগলে রেখেছে আপন আলয়ে। মেধা আর প্রতিভার ঝলকে টেনিস কোর্টে অজস্রবার তুলেছেন করতালির ঝড়, ‘রাফা.. রাফা..’ স্লোগানে উন্মাতাল করেছেন বিশ্বের অজস্র সীমান্ত।বিদায়ের প্রাক্কালে দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছেন নাদাল।
২৩ বছরের ক্যারিয়ার, ১৩০৭ টি ম্যাচে র্যাকেট হাতে কোর্টে নেমে ১০৮০ ম্যাচেই জয় নিয়ে ফেরা। কিংবদন্তির আসন তাকে তো এমনিতেই আপন করে নেয়নি। টেনিস কোর্টে কাটিয়েছেন জীবনের ২৫৪৩ ঘন্টা। উপহার দিয়েছেন রুদ্ধশ্বাস আর রোমাঞ্চে ভরা সুস্থ ধারার বিনোদন। হয়ে উঠেছেন টেনিসের একচ্ছত্র সম্রাট। রাফা নামেই যেখানে বন্দনা হতো রোজ।
২০০৪ সালে প্রথম খেতাব জয়। পরের বছরই এটিপি র্যাঙ্কিংয়ে সেরা দশে আগমন। এরপর টানা ৯১২ সপ্তাহ তাকে সেরা দশ থেকে বের করতে পারেনি কেউ। যা আজও রেকর্ডের পাতায় অক্ষুণ্ণ। দুই দশকের ক্যারিয়ারে জিতেছেন ৯২টি সিঙ্গেলস শিরোপা। এর মধ্যে রয়েছে ২২টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম। উইম্বলডন জিতেছেন দুটি। সর্বোচ্চ ১৪টি ট্রফি বাগিয়েছেন ফ্রেঞ্চ ওপেনে। এছাড়াও চারটি ইউএস ওপেন ও দুটি অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছেন। অলিম্পিকে দেশকে এনে দিয়েছেন ২টি স্বর্ণপদক।
টেনিসের ইতিহাসে তিনি ‘ক্লে কোর্টের মহারাজ’। মাটির কোর্টে খেলতে নামলেই তার র্যাকেট কথা বলতো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। একতরফা রাজত্ব করে গেছেন। আজ অবধি কোনও প্লেয়ার তার ধারে কাছে আসতে পারেননি। ১১৬টি ম্যাচের মধ্যে জিতেছেন ১১২টি। ১৯ টুর্নামেন্টে ১৪ বারই ফিরেছেন ট্রফি নিয়ে। রোলা গারোঁতে কখনো তাকে খালি হাতে ফেরায়নি। আরও বিশেষ করে বললে চারটি ফাইনালে একটি সেটেও তাকে পরাজিত করতে পারেনি প্রতিপক্ষ। একটানা ৮১ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ডও তার।
প্রায় দুই যুগের টেনিস ক্যারিয়ারে নাদাল ছিলেন স্বচ্ছ ইমেজের অধিকারী। ভদ্রলোক যাকে বলে। এই দীর্ঘ সময়ে বন্ধু জুটিয়েছেন অসংখ্য। তবে রজার ফেদেরারের মতো বন্ধু বোধহয় আর একটিও পাননি। যার বিদায়ে চোখের জল কথা বলেছে ব্যথিত হয়ে। কোর্টে ধুন্ধুমার লড়াইয়ে দুজন ছিলেন সময়ের সেরা প্রতিদ্বন্দ্বী। কোর্টের বাইরে সুইজারল্যান্ড আর স্পেন মিলেমিশে থেমেছে এক বিন্দুতে। যে বিন্দুতে রচিত হয়েছে ‘ফ্রেন্ডস ফরএভার’ স্টোরির পটভূমি। খোদাই হয়েছে ইতিহাসের পাতায়। ক্যারিয়ারের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের পর উদযাপন।
বিদায়বেলায় বন্ধু ফেদেরারের কণ্ঠে ঝরলো নাদালের বন্দনা, “একসঙ্গে নিজেদের যাত্রা শুরু করেছিলাম এবং এখন কথা বলে শেষ করছি। তোমার ২০ বছরের এই সফর ছিলো আলোয় ঝলমল দুর্দান্ত। ১৪টা ফ্রেন্স ওপেন জেতা অবশ্যই ঐতিহাসিক। তুমি স্পেনকে এবং সমগ্র টেনিস বিশ্বকে গর্বিত করেছ। একসাথে টেনিস কোর্টে কাটানো মুহূর্তগুলো আমার কাছে বিশেষ হয়ে থাকবে।”
ক্যারিয়ারে যেমন সাফল্য এসেছে, তেমন হানা দিয়েছে চোট। একের পর এক চোটে জর্জরিত হয়ে শেষে ক্যারিয়ারই থাময়ে দিতে হলো নাদালকে। ২৩ বছরে ১৫টি বড় টুর্নামেন্ট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। অপারেশনের পরে দীর্ঘ বিরতি নিয়ে ফিরলেও ২০২৪ সালে প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলতে পারেননি তিনি। মুকুটে আরও কিছু পালক যোগ যে হতো বিদায়ের প্রাক্কালে সেই আফসোস ঝরলো নাদালের কণ্ঠেও। বন্ধু ফেদেরারের শেষ ম্যাচে আনন্দঘন মুহূর্ত।
বিদায়ের রাতে নাদাল বলেন, “২০ বছরের পেশাদার ক্যারিয়ার। এই ভালো-খারাপ সময়ে আপনারা আমার পাশে ছিলেন, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। সত্য হচ্ছে আমি টেনিস খেলে ক্লান্ত নয়, আমার শরীর চায় না আমি খেলাটা চালিয়ে যাই এবং এটা মেনে নিতে হবে। আমি অনেক ভাগ্যবান। নিজের শখকে দীর্ঘ সময়ের জন্য পেশা হিসেবে রাখতে পেরেছি।”
শখকে পেশা হিসেবে রূপ দিতে সবাই পারে না। নাদাল পেরেছেন। ছোটবেলায় বোধহয় জীবনের লক্ষ্য রচনায় তাই লিখেছিলেন। না লিখলেও ইতিহাস তার মেধার প্রজ্ঞার কাছে নত হয়েছে। নাদাল পেরেছেন; জিতেছেন, হেরেছেন, বিজয়ীর বেশে চড়েছেন সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে। যে শিখরের টেনিস সাম্রাজ্যে নাদালই ‘স্প্যানিশ সম্রাট’।