যেকারণে বন্ধ সিলেট-ছাতক রেলপথের কাজ
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
সিলেট-ছাতক রেলপথ সম্প্রসারিত হওয়াকে কেন্দ্র করে বন্ধ হয়ে আছে এই পথের রেল-যাতায়াত। রেলপথটি সুনামগঞ্জ পর্যন্ত যাবে বলে অনেক আগে একটা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সঙ্গে ছাতক-দোয়ারাবাজার নির্বাচনি এলাকার সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে এই প্রকল্পের কাজ আর এগোয়নি। করোনার সময় রেলপথটিও বন্ধ হয়ে যায়। পরে দেশের সবকটি লাইন সচল হলেও বন্ধ থাকে সিলেট-ছাতক রেলপথ। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই মন্ত্রীও নেই, এমপিও নেই। তবু চালু হয়নি রেলপথ।
ব্রিটিশ আমল থেকে শিল্পশহর হিসেবে ছাতকের খ্যাতি। সে সময় সিলেট থেকে ছাতক পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারিত হয়েছিল বাণিজ্যিক কারণে। এরপর পরিকল্পনা ছিল সেখান থেকে সুনামগঞ্জ জেলা শহর (তৎকালীন মহকুমা) পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার। আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী থাকাকালে সেই পুরোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়টি আলোচনায় আসে। তবে রেল মন্ত্রণালয় থেকে তিনি সরে গেলে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। নতুন পরিকল্পনায় রেললাইনটি ছাতককে বাদ দিয়ে গোবিন্দগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জে নেওয়ার কথা বলা হয়। এর প্রতিবাদ জানান সেই সময়ের স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক। মন্ত্রী-এমপির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনে দুটি পথের কথা বলা হয়েছিল। রেলওয়ের দায়িত্বশীলদের বেশির ভাগ ছাতকের গোবিন্দগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জের দক্ষিণ নতুনপাড়া ও কালীপুরের মাঝের হাওর পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। দুই কিলোমিটার জালিয়ার হাওর এবং বাকি পথ এখনকার সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের পাশ দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতার কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। যৌথভাবে এই সম্ভাবতার সমীক্ষা ও নকশা প্রণয়ের কাজ করে বাংলাদেশের মজুমদার এন্টারপ্রাইজ এবং চীনের সিএইচইসি। কিন্তু এরপর আর কোনো অগ্রগতির খবর পাওয়া যায় না।
সরেজমিনে সমীক্ষা করা হলে বিদ্যমান আফজালাবাদ স্টেশন থেকে দক্ষিণ খুরমা, শান্তিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ রুটটি রেলপথ নির্মাণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী বলে বিবেচিত হয়। সমীক্ষায় বলা হয়, ৪৫ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার অ্যালাইনমেন্টে টপোগ্রাফিক (ভূমি) জরিপের কাজ করা হয়েছে। এই রুটে আছে ৬৬টি ছোট-বড় জলাভূমি। দক্ষিণ খুরমা, শান্তিগঞ্জে দুটি স্টেশন নির্মাণ করতে হবে। রেলপথ নির্মাণের জন্য সরাতে হবে ১২৮টি বসতবাড়ি ও অবকাঠামো। সাড়ে ১৩ হাজার গাছ কাটা পড়বে। পাঁচটি স্টেশনের জন্য ৫০ একরসহ মোট ৬১৩ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। প্রকল্পটির কাজ এরপর আর এগোয়নি।
এদিকে প্রায় চার বছর ধরে বন্ধ আছে ছাতক-সিলেট রেল-যোগাযোগ। এর আগে দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্যবাহী ছাতক-সিলেট রেল-যোগাযোগ জোড়াতালি দিয়ে চলে আসছিল। তবে করোনা মহামারি শুরু হলে সারা দেশের অন্যান্য রেলপথের মতো এই রেলপথটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। করোনার পরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রেল চলাচল স্বাভাবিক হলেও ছাতক-সিলেট রেল-যোগাযোগ আর চালু হয়নি। পরে ২০২২ সালের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ছাতক-সিলেট রেললাইনের ছাতকের অংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ১৩ কিলোমিটার রেললাইন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।
ছাতকের ব্যবসায়ীরা জানান, ক্ষমতার পটপরিবর্তনে ছাতক-সিলেট রেল চলাচলের ব্যাপারে ছাতকবাসীরা আশাবাদী হয়ে উঠছেন। রেল-যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের পাশাপাশি এর আধুনিকায়নেরও দাবি জানাচ্ছেন তারা। এর আগে এই দাবিতে ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে স্মারকলিপি দিয়েছিল ছাতক সোশ্যাল ফোরাম। স্মারকলিপিতে বলা হয়েছিল, ২০২২ সালের বন্যার পর অর্থ মন্ত্রণালয়, এডিপি এবং রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাতকে এসে কয়েক দফা লাইন পরিদর্শন করেন। তারা সিলেট-ছাতক-সুনামগঞ্জ রেললাইন স্থাপনসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদ, সুধীজনসহ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। রেললাইন চালুর ব্যাপারে তৎপরতাও শুরু হয়। কিন্তু মন্ত্রী-এমপির দ্বন্দ্বে সেই প্রক্রিয়া থেমে আছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পথ (সম্প্রসারণ) বিভাগও একই কথা বলেছে। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, সিলেট-ছাতক রেল চালুর জন্য গত মে-জুনে টেন্ডার ও চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু কাজ শুরুর মুহূর্তে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং সরকার পরিবর্তনের পর সেই কাজ থমকে গেছে। এর পরের অগ্রগতি সম্পর্কে আমাদের জানা নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (পূর্ত) রেজাউল হক বলেন, সরকার পরিবর্তন হওয়ায় সিলেট-ছাতক রেল-যোগাযোগ চালু হতে দেরি হচ্ছে। তবে আমরা থেমে নেই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আবার যাচাই-বাছাই করছেন, দেখছেন। তারা বলেছেন ডিসেম্বরের পরে কাজ আবার শুরু হতে পারে।
সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেলসংযোগ বর্ধিত করার বিষয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না, কোনো কাগজপত্র বা নির্দেশনা আমরা পাইনি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন, অস্থায়ী দায়িত্ব) এ এম সালাহ উদ্দীন বলেন, ‘আমাদের ইঞ্জিন ও কোচের সংকট আছে। নতুন টাইমটেবল হচ্ছে। আশা করি ডিসেম্বরের মধ্যে সিলেট-ছাতকের মধ্যে রেল-যোগাযোগ চালু করা যাবে।
রেলপথ বন্ধ থাকায় রেলওয়ের সম্পদ অব্যবহৃত থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রেলের ছাতক সূত্র। জানা গেছে, রেলের লৌহজাত সামগ্রী, লাইন, স্লিপার, এমনকি বগি পর্যন্ত কেটে বিক্রি করা হয়েছে। লাইনের পাথর চুরি করে নিয়ে পাথরশূন্য করা হয়েছে। রেলওয়ের কোটি কোটি টাকার ভূ-সম্পদ, স্টাফ কোয়ার্টার, পুকুর বিভিন্ন স্থাপনা যে যার মতো দখল করে নিয়েছেন। প্রতিনিয়ত চুরি হয়ে যাচ্ছে রেলওয়ের বিভিন্ন সম্পদ। রেললাইনে থাকা পাথর আর অবশিষ্ট নেই। বিভিন্ন স্থানের কাঠের স্লিপার প্রতিনিয়তই খুলে নিয়ে যাচ্ছে চোররা। জনশূন্য রেলস্টেশন হয়ে উঠেছে অপরাধীদের অভয়ারণ্য। রাত্রি নামার সঙ্গে সঙ্গে এখানে বখাটেদের আনাগোনা বেড়ে যায়। অরক্ষিত রেলওয়ে স্টেশন এখন মাদকসেবী ও মাদক বিক্রেতাদের নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে।