সুনামগঞ্জের জাদুকাটা নদে গাফিলতিতে সেতুর কাজ ঢিমেতালে
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
‘সীমান্তের পাহাড় পাদদেশ এলাকাটি সরাসরি সড়ক যোগাযোগবিহীন। একটি সেতু হলে যোগাযোগের আওতায় আসবে সীমান্ত জনপদ। বিকশিত হবে প্রান্তিক পর্যটন।’ সংক্ষেপে এমন সম্ভাব্যতা তুলে ধরে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার জাদুকাটা নদে সেতু প্রকল্পের সূত্রপাত হয়। নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ভোটের দিনক্ষণ নির্ধারণ হওয়ার প্রায় তিন সপ্তাহ আগে। নামকরণ করা হয় সীমান্তে দুই ধর্মীয় সাধক ‘শাহ আরেফিন (রহ.)-শ্রী অদ্বৈত মহাপ্রভু মৈত্রী সেতু’।
নির্মাণ শুরু হলেও সেতুর দুই দিক সড়কপথবিহীন। বলা হয়েছিল, সেতু ঘিরে হবে নতুন সড়কপথ। এ জন্য সেতু নির্মাণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শুরুতে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ছিল আড়াই বছর। এরপর দফায় দফায় সময় বাড়ানো হয়। এভাবে আড়াই বছরের কাজ ছয় বছরে গড়ায়। তবু সেতুর কাজ শেষ হয়নি।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্মাণকাজ পর্যবেক্ষণে সেতুটির স্থান নির্ধারণ ও কাজের গতি নিয়ে গুরুতর গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সূত্র বলছে, আঞ্চলিকতার কারণে তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন করলেও নির্মাণকাজ চলাকালে আর কোনো তদারকি করেননি। পরের বছর ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েন। এরপর পুরো প্রকল্পটি ঢিমেতালে চলে। এ বিষয়টি মৈত্রী সেতুর ‘বৈমাত্রেয়’ রূপ হিসেবে দেখছেন এলাকাবাসী। তারা বলছেন, তৎকালীন সংসদ সদস্যের বিমাতাসুলভ আচরণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগে সীমান্ত এলাকায় মৈত্রী সেতু হিসেবে এটিই প্রথম। দৈর্ঘ্য ৭৫০ মিটার। ‘পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সেতুটি নির্মাণ হচ্ছে। ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। তমা কনস্ট্রাকশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই কাজটি করছে। সেতুর নির্মাণ সম্পন্নের সময়সীমা ছিল ৩০ মাস। সে অনুযায়ী ২০২১ সালের জুন মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা।
জাদুকাটা নদের তীরে লামাশ্রম গ্রামে শ্রীশ্রী অদ্বৈত মহাপ্রভুর জন্মস্থান। সীমান্তে রয়েছে শাহ আরফিনের (রহ.) আস্তানা (আসন)। বছরের একই সময়ে সেখানে দুই ধর্মের মিলনমেলা হয়। ঐতিহ্যবাহী এই ধর্মীয় সম্প্রীতি বিবেচনায় দুই ধর্মের দুই সাধকের নামেই সেতুর নামকরণ করা হয়েছে। সেতুর পূর্বপারে তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের বিন্নাকুলি বাজার ও লামাশ্রম গ্রাম। পশ্চিম পারে গড়কটি গ্রাম।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সেতুতে ৭৫টি গার্ডারের মধ্যে তিনটি এবং ১৫টি স্ল্যাবের মধ্যে ১০টির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। মাখঝানে ১৮টি গার্ডার ও পাঁচটি স্ল্যাবের কাজ এখনো বাকি। গত জুন মাসের বন্যার সময়ে বালুভর্তি বাল্কহেডের ধাক্কায় দুটি গার্ডার ভেঙে পড়ে।
মৈত্রী সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুনামগঞ্জ জেলা সদরসহ অন্তত পাঁচটি উপজেলার সীমান্ত এলাকায় যোগাযোগের মৈত্রী স্থাপিত হতো বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। তারা বলেছেন, সেতুটি হলে সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা হয়ে তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকায় যাতায়াত সহজ হতো। সীমান্ত এলাকা হয়ে সহজে যাওয়া-আসা করা যেত মধ্যনগর ও ধর্মপাশা উপজেলায়। সেতু এলাকার পাশেই রয়েছে একটি সীমান্ত হাট। নদের পশ্চিম তীরে দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান ও নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বারিক টিলা। এর পাশে টাঙ্গুয়ার হাওর, লাকমাছড়া, শহিদ সিরাজ লেক (নিলাদ্রি লেক), টেকেরঘাট। এসব স্থানে প্রতিদিন হাজার পর্যটক আসেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকায় থাকা বড়ছড়া, চারাগাঁও ও বাগলী শুল্কস্টেশনেও সুনামগঞ্জ শহর থেকে ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন ওই এলাকায় যাতাযাত করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি অভিযোগ করেন, তৎকালীন সময়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। তার বাড়ি ধর্মপাশা উপজেলায়। সেতুটি হলে তাহিরপুর বেশি উপকৃত হবে এ রকম সম্ভাব্যতা প্রচার পায়। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর তিনি তৃতীয় দফা সংসদ সদস্য হওয়ার পর সেতু নির্মাণ নিয়ে আঞ্চলিকতায় এক ধরনের বিমাতাসুলভ আচরণ দেখান। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে মোয়াজ্জেম হোসেন রতন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হন। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করার সময় প্রচারে সেতুটি নির্মাণ সম্পন্নের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু নির্বাচিত না হওয়ায় এখন সেতুটির কাজ ঢিমেতালে চলায় বিষয়টি ‘বৈমাত্রেয়’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
লাউড়েরগড় গ্রামের বাসিন্দা মাসুক মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, ‘ব্রিজটার খুব দরকার আছিল। কিন্তু আমরার আগের এমপি (মোয়াজ্জেম হোসেন রতন) পুরা এলাকারে সৎভাই মনে করে চলতেন। নতুন এমপি ঘটনা বুঝবার আগেই ক্ষমতা শেষ। এর লাগি এই অবস্থা!’
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে এলাকাছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। তার মোবাইল ফোনে কল করে এ ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে কথা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প পরিচালক মিয়া মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে। তার কথায় সেতু প্রকল্পটি অভিভাবকহীন থাকার বিষয়টি প্রকাশ পায়।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘এখানে কাজ এক কদম এগোলে দুই কদম পেছাতে হয়। আবার নির্মাণসামগ্রী আনতেও সমস্যা হয়। এভাবে সেতুর ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। পুরো কাজ শেষ করতে আরও অন্তত এক বছর লাগবে।’
সেতুটির কাজ সময়মতো শেষ না করার পেছনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিও আছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘দ্রুত কাজ শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তা না হলে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।’