‘চোর’ উপেক্ষা করে কৃষিতেই স্বপ্ন যে কৃষকের
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
কৃষক পরিশ্রম করে ফসল লাগাবেন, সেই ফসল মাটির আশ্চর্যক্ষমতা বলে উৎপন্ন হবে এবং সবশেষে কৃষকের মুখে ফুটবে সার্থকতার হাসি। এটাই আমাদের আবহমান বাংলার কৃষকদের জীবনযাপনের প্রাত্যহিক কর্মপরিকল্পনা।
কিন্তু না! এ কৃষক বা তার সঙ্গীয় কৃষকদের সার্থকতা শুধু কৃষিজাত পণ্য মাটিতেই পুঁতে দিয়েই নয়। এ সংক্রান্ত দুর্ভোগ বা দুর্দশা ভেতরমনের চারদিককে আজ গ্রাস করে ফেলেছে।
এখানে চোরের উৎদ্রপ বিরতিহীন। ফসলের মাঠে সারা দিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর, রাতে এসে যে ক্লান্তির ঘুমে শরীর চাঙা করবেন তার সুযোগ নেই। রাতের বিছানায় ক্লান্ত শরীর বিছিয়ে দিলেই তার ঘটে যেতে পারে ক্ষয়ক্ষতি। ফলে এই কৃষককে শুধু দিনের বেলাতেই নয়, রাতের বেলাও ‘ফসল পাহারা’ নামক পরিশ্রমটি করতে হচ্ছে।
‘ফসল চোর’ কৃষকের গৃহের সিঁধ কাটে না। অতি সঙ্গোপনে ঘরে ঢুকে না। কিন্তু নিয়ে যায় পরিশ্রম লালিত প্রিয় ফসলের সম্ভার! এ যেন বিপন্ন সময়ের অন্য এক অত্যাচার!
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর ইউনিয়নের ইছবপুর গ্রাম। মৌসুমি সবজি চাষে পরিচিত গ্রামটি। এই গ্রামের পৌড় বয়েসী কৃষক সুশেন দেব। সম্প্রতি তার কৃষিবিষয়ক আলাপচারিতা হয়। কৃষক সুশেন দেব কথা প্রসঙ্গে জানান, আড়াই বিঘা জমিতে দেশি আলু চাষ করেছি। এর পাশাপাশি টমেটো, লম্বা বেগুন, মরিচ, সরিষা লাগিয়েছি। এই আলু লাগিয়েছি এক মাস হয়েছে। আরও দুই মাস পড়ে সফল তুলতে পারবো হয়তো। অগ্রাহণের শেষে লাগিয়েছি, ফাল্গুনের শেষে ফলস তুলতে পারবো আশা করি।
‘প্রতিদিন অল্প অল্প করে মাটির নিচ থেকে আলু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলতে হয়। অনেক সময় লাগে। মাটি থেকে আলু যে তুলবে সেই লোক আলাদা আছে। তাকে আলু তোলা বাবদ প্রায় এক কেজি করে আলু দিতে হয়। ’জমিতে শ্রমিক নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন দৈনিক শ্রমিক রয়েছে ২ জন। তাদের ৪শ টাকা করে দিতে হয়। সকাল ৮টা থেকে কাজ শুরু করবে। চা খাবে এবং দুপুরে খাবারও খাবে। সবজিক্ষেতে কাজ যদি বেড়ে যায় তখন দৈনিক শ্রমিক ১ জন থেকে ৩ জন পর্যন্ত লাগানো হয়।
আলুর তুলনামূলক পার্থক্যে তিনি বলেন, এই দেশি আলু পরিপূর্ণ হতে প্রায় ১২০ দিন লাগে। দেশি আলু সুস্বাদু। বাজারে মুন্সিগনজ বা অন্য আলু কেজি প্রতি যদি ৩০ টাকা থাকা, তাহলে এই দেশি আলুর দাম ৪০ টাকা থাকবে। অর্থাৎ অন্য আলু থেকে দর বেশি থাকে। মুন্সিগঞ্জের আলু সাইজে বড় হয়। আর এই দেশি আলু মাঝারি সাইজের হয়। ঘরে সপ্তাহ-দশ দিন রাখলেও পচবে না। আর খেতেও অপেক্ষাকৃত ভালো।
অন্য সবজি চাষে অধিক শ্রমের ব্যাপারে তিনি বলেন, আলুতে মাটি দেওয়া হয়ে গেছে। এখন আর তেমন কাজ নেই। এখন শুধু পরিমাণ মতো মেডিসিন আর পরিমাণ মতো পানি নিয়মিত দিতে হবে। আর কোনো খাটনি নেই তেমন। তবে যত্ন বেশি করতে হয় টমেটো গাছগুলোতে। টমেটোতে এখন বাঁশের খুটা বাঁধতেছি। এরপর সূতা এনে প্রতিটি টমেটো গাছকে খুটার সাথে বাঁধতে হবে। যখন গাছ বড় হয়ে যাবে তখন পাতাগুলো কেটে দেবো।
বৃষ্টির প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের যে মাটি, তাতে সাধারণ বৃষ্টিপাতে সমস্যা হয় না। কিন্তু বেশি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলেই সমস্যা। আশা করছি, বৃষ্টিপাতের আক্রমণ থাকবে না। শীতকালই নানান স্বাদের সবজির সময়। আমার লক্ষ্যই হলো – ভালো সবজি চাষ করবো ভালো দাম পাবো বলে জানান সুশেন।
সরকারি সাহায্য পাই তবে চাহিদার তুলনায় খুবই কম। যেমন এই আলু খেতে লাগে ১ মণ সার। সরকার থেকে দিবে মাত্র ১০ কেজি। এই অনুপাতে যখন সরিষা বীজ দিয়েছিল ১ বিঘা জমি চাষে। আর সার দিয়েছিল মাত্র ১০ কেজি। ১ বিঘা জায়গায় সরিষা বান (উৎপন্ন) করতে গেলে সর্বনিম্ন তিন জাতের ১শ কেজি সারের দরকার। আমি সরিষা লাগিয়েছি ১ পোয়া (৪ শতাংশ) জায়গায়। এভাবে আমাদেরকে চাহিদার তুলনায় খুবই কম বীজ, সার এগুলো দেয়া হয়ে থাকে। এই দুখগুলো আমরা এখনকার কৃষকরা ভোগ করে চলছি।
অভিমানের সাথে সুশেন দেব বলেন, এই ইছবপুর এলাকায় শুধু আমিই বঞ্চিত নই, আমাদের এলাকার খিরু দেব, সজল দেব, সলং দেব, শিমল দেব এবং প্রশান্ত দেব এরাও বঞ্চিত। আমরা প্রত্যেকেই সাধারণ কৃষক। আমরা সবাই দৈনিক কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি। আমরা প্রয়োজন মতো বীজ, সার পাই না। আর যাদের বীজ, সার দেয় হয় তাদের কেউ কেউ কৃষক না। এসব কারণে কৃষি অফিসের প্রতি আমাদের আগ্রহ কমে গেছে। আগের কৃষি অফিসার মোনালিসা সুইটি ম্যাডাম যখন ছিলেন তখন তিনি আমাদের মতো সাধারণ কৃষকদের দিকে বেশি খেয়াল রাখতেন।
দেশি আলুর এই চাষাবাদের খরচ এবং লভ্যাংশের বিষয়ে বলেন, আড়াই বিঘা জমিতে ১২০ কেজি আলু লাগিয়েছি। আশা করছি, ১শ মণের ওপরে আলু উৎপাদন হবে। তিন মাসে খরচ হবে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। সব খরচ বাদে প্রায় এক লাখ টাকার ওপর মতো আয় হবে বলে আশা করি।
‘ফসল চোর’ প্রসঙ্গে কৃষকরা অভিযোগ করে বলেন, নোয়াগাও এলাকার ‘আনকার মিয়া’ গভীর রাতে এসে আমাদের সবজি চুরি করে নিয়ে যায়। আমরা কয়েকবার থানা দিয়েছি। কিন্তু তিনি এখনো ঠিক হননি। ১/২ মাস জেল খেটে বের হয়ে আবার চুরিতে লেগে যায়। তার জন্য আমাদের রাত জেগে পাহারা দিতে হয়।
গভীর উৎকণ্ঠা আর ক্ষোভের জর্জরিত মুখে তৎক্ষণাৎ কৃষক সুশেন দেব বলেন, এই দেখেন দুদিন আগে আমার ক্ষেতের মুলাগুলো চুরি করে নিয়ে গেছে ওই চোর আনকার! কি করি বলেন তো!
‘সবজি চোর’ এর বিষয়ে মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, আসলে বিষয়টি আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণের মধ্য পড়ে। সংশ্লিষ্ট উপজেলার ইউএনও বা থানার ওসিকে অবহিত করা যেতে পারে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। ওই এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা আমার সাথে যোগাযোগ করলে তাদের সবজি চুরি বিষয়টি প্রতিরোধে আমি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো।