কুশিয়ারা নদীতে বালু মহাল নিয়ে চলছে হরিলুট কান্ড

মোঃ সাগর আহমেদ, নবীগঞ্জ প্রতিনিধি
কুশিয়ারা নদীতে বালু মহাল নিয়ে চলছে হরিলুট কান্ড। সরকারি নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও সেগুলো অমান্য করে যথেচ্ছা বালু তুলছে এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহল। ইজারা করা বালু মহালের সরকারি নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে গিয়ে বালু তোলায় ক্ষতিগ্রস্ত নদী ও এর আশপাশের জনপদ। অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের ফলে প্রতি বছর নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার একর জমি, বিলীন হচ্ছে বসতভিটা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন অংশ।
নিয়ম নীতি ও আইনের তোয়াক্কা না করে যৌথবাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রকাশ্যে নদীর বিভিন্ন স্থানে ১৫/২০টি কাটার মেশিন দিয়ে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে বালু খেকোরা। এক মাসের বেশি সময় ধরে নির্বিচারে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে একটি চক্র। প্রশাসন মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করলেও থামছে না বালু উত্তোলন। ফলে নদী তীরবর্তী বাড়িঘর, ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে জাতীয় পাওয়ার গ্রিডের বৈদ্যুতিক সঞ্চালন কেন্দ্র বিবিয়ানা পাওয়ার প্লান্ট, কয়েকটি স্কুল, মসজিদ, মাদরাসা ও হাট-বাজারের বিভিন্ন স্থাপনা। অভিযোগ রয়েছে বেশিরভাগ এলাকার স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশে এসব বালু উত্তোলন হচ্ছে। যে কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত ও অতিষ্ট হলেও মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
জানাগেছে। নবীগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর চরে বালু মহালে অবৈধ ভাবে বালু তোলা নিয়ে গত শুক্রবার বিকালে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ১০ জন আহত হয়েছে । ঢাকার ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি সংগঠন তারা প্রশাসনের প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে বলে এলাকায় প্রচার করে। তারা বালু উত্তোলন করার জন্য গতকাল লোকজন নিয়ে কুশিয়ারা নদীতে ড্রেজার মেশিন বসানোর জন্য পাহাড়পুর ও বনগাও এর নিকট নদীর তীরে গেলে স্থানীয় লোকজন বাঁধা দেয়। এসময় দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে কয়েকজন আহত হয়। এনিয়ে এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এব্যাপারে ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজের সুপারভাইজার রাজিবুর রহমান বলেন, আমরা বিআইডব্লিউএ এর অনুমতি পেয়ে বালু তোলার জন্য গেলে একটি পক্ষ বাঁধা দেয়।
এবিষয়ে অপরপক্ষের বালু উত্তোলনকারী পারকুল গ্রামের ছাত্রদল নেতা সাজু আহমদ জানান, সে প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বালু উত্তোলন করছে, তার অনুমতি ছাড়া আর কেউ বালু তোলার কথা নয়। কাগজ পত্র দেখানোর কথা বলা হলে তিনি বলেন এসব সময় মতো দেখানো হবে।
হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নবীগঞ্জ উপজেলায় কয়েকটি বালু মহাল রয়েছে। এর মধ্যে নবীগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর যে কয়েকটি বালু মহালটি রয়েছে, তার মধ্যে কয়েক বছর ধরে কোনো ইজারা নেই। অথচ এ বালু মহাল থেকে অবৈধভাবে প্রতি বছর কোটি টাকার বালু উত্তোলন হলেও বিপুল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এ মহালটি ইজারার জন্য প্রতি বছর বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহল সিন্ডিকেট তৈরি করে নিজেরা যেমন কোনো দরপত্র দাখিল করে না, আবার অন্যদেরও দরপত্র জমা দিতে বাঁধা দেয়। এ সুযোগে বিনা ইজারায় ওই প্রভাবশালী চক্রটি অবৈধভাবে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন করছে। এ বালু মহালটির তাজাবাদ মৌজার দাগ নং ১০০৩ দীঘলবাক মৌজার দাগ নং ০৮ ও ৫২০ মৌজা এ দুটি মৌজার বালু মহালের আয়তন ৪৫.৬৫ একর। ঠিক এমনভাবে উপজেলার বিভিন্ন নদী ও খালগুলোতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
নবীগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদী বালু মহালের অংশ। ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজ, আলী এন্টার প্রাইজ, ছাত্রদল নেতা সাজু আহমদ, ফখরু মেম্বার, দুলাল মেম্বার সহ আরও অনেকেই অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করছেন।
বালু মহালগুলো সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সরকার থেকে যে নির্দিষ্ট সীমানা রয়েছে, তা অতিক্রম করে নিজেদের খেয়াল খুশিমতো যে কোনো স্থান থেকে প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলন করে চলেছেন। বিভিন্ন সময় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে এদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করলেও কোনোভাবেই অবৈধ বালু উত্তোলন থামানো যাচ্ছে না।
এদিকে, উপজেলার তাজাবাদ বালু মহাল যে এলাকায় প্রজেক্ট রয়েছে সে এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলন করায় উপজেলা প্রশাসন পক্ষ থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের অর্থদ- দেওয়া হয়।
এদিকে, জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন তারা। জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সরকারি ইজারার বাইরে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিন্ধান্ত হয়।
একই সূত্র জানায়, ২২, ২৩ ও ২৪ জানুয়ারি তিনদিন কুশিয়ারা নদী এলাকায় সেনা বাহিনী অবৈধ বালু খেকোদের ধরতে অভিযান পরিচালনা করেন। এসময় হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আব্দুল মতিন আছাবকে আটক করা হলে তিনি মুছলেকা দিয়ে ছাড়া পান। তিনি আর কখনও অবৈধ বালু উত্তোলনের কাজে যাবেন না বলে জানান।
বিবিয়ানা বিদ্যুৎ পাওয়ার প্লান্ট এর পাশে ১০টি ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন করে বাল্কহেডে ভরা হচ্ছে। এসব বালু বাল্কহেডে ও পাইপের মাধ্যমে শেরপুর অর্থনৈতিক জোনের পাশে খালি জমির মধ্যে রেখে অন্যত্র নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভাঙনে নদীতে চলে গেছে একটি মসজিদ, বহু কৃষিজমি ও কয়েকটি গ্রামের শতাধিক বসতবাড়ি। ভাঙনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি মসজিদ ও ঝুকির মধ্যে বিবিয়ানা পাওয়ার প্লান্ট।
ভাঙনের শিকার ছলিম উদ্দিন বলেন, ‘এখন শীতকাল চলছে। সাধারণত নদী ভাঙন কম থাকে। কিন্তু নদীতে ড্রেজারে বালু তোলার কারণে নদীর পাড় ভাঙছে। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে ভাঙন তীব্র হয়েছে। ফলে কয়েকটি পরিবার মিলে আমরা অন্যত্র সরে যাচ্ছি।’
ভুক্তভোগী মো. মুক্তার হোসেন, মো. সিরাজুল ইসলাম, রাজু আহমেদসহ স্থানীয়রা জানান, বাংলাদেশ অন্যতম বিবিয়ানা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির পাশ থেকে ১০টি কাটার মেশিন দিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এলাকার কেউ বাধা দিতে গেলে মারধরসহ বিভিন্ন মামলা দিয়ে হয়রানির হুমকি দেয় তারা। ভয়ে এখন কেউ কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না।
এছাড়া নদীর ওপর দিয়ে যাওয়া জাতীয় গ্রিডের ৩৩ কিলো ভোল্টের বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনটিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। যে কোনো সময় টাওয়ারের তলদেশ থেকে মাটি সরে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ওই বালুখেকোদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলেও বালু উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না। ফলে এলাকাবাসী আতঙ্কে দিন পার করছেন।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) অনুপম দাশ অনুপের সাথে যোগাযোগ করা হলে বলেন, কানোভাবে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতে দেয়া হবে না। তবে আমরা যেতে যেতে তারা খবর পেয়ে সেখান থেকে সটকে পড়ে। বালু তোলার মূলহোতাদের ধরার চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি। হবিগঞ্জ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক ড.মো.ফরিদুর রহমান বলেন, হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন নবীগঞ্জ কুশিয়ারা নদী থেকে বালু উত্তোলনের কোন অনুমতি দেয়নি। অনুমতি ছাড়া কেউ বালু উত্তোলন করা কথা নয়। বিআইডব্লিউএ কাউকে অনুমতি দিয়েছে কিনা বিষয়টি আমার জানা নেই।
তিনি আরও বলেন,অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের কোনো ছাড় নয় বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড.মো.ফরিদুর রহমান। তিনি বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে অনেক জায়গায় বাড়িঘর, ফসলি জমি বিলীন হচ্ছে, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। তাই ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
বিআইডব্লিউএ এর চেয়ারম্যান আরিফ আহমেদ মোস্তফা সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি পরে তাঁর প্রধান সমন্বয় কর্মকর্তা, মোঃ আশরাফুর রহমান বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের কোনো তালিকা আমাদের কাছে নেই। এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগও নেই। বিষয়টি সম্পূর্ণ জেলা প্রশাসনের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়। আমাদেও বালু উত্তোলনের জন্য কিছু আবেদন এসেছে এগুলো পরীক্ষা নিরিক্ষা করে চেয়ারম্যান স্যারে অনুমতিক্রমে উপ-পরিচালক অনুমোদন দিবেন। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কোন সুযোগ নেই।