১৪ বছর দেশে না থেকেও চুনারুঘাটের শাহজাহান চৌধুরী আসামি

নুর উদ্দিন সুমন
ভাগ্যের অন্বেষণে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানোর পর সর্বশেষ ২০১১ সালে দেশে এসেছিলেন চুনারুঘাট উপজেলার বগাডুবি গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান চৌধুরী। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট প্রতিকূল থাকায় এখন পর্যন্ত দেশের মাটিতে পা রাখেননি উপজেলার আহম্মদাবাদ ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও যুক্তরাজ্যের কোভেন্ট্রি বিএনপির সাবেক এই সদস্য সচিব। এর মাঝেই শেষবার ছেলের মুখ দেখতে না পারার আক্ষেপ নিয়েই চলে যান তাঁর মা। অথচ ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় করা মামলায় আসামি করা হয়েছে শাহজাহানকে।
জানা যায়, ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে দেশত্যাগ করেন শাহজাহান চৌধুরী। ২০১১ সালের ১ মার্চ দেশে এসে ২৭ মার্চ ফিরে যান যুক্তরাজ্যে। এর পর গত ১৩ বছরের মধ্যে একবারও দেশে আসেননি তিনি। ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তাঁর মা ও দুই বোনের মৃত্যু হয়। এর কোনোবারই ফিরতে পারেননি শাহজাহান। স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এদিকে ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সিলেটের একটি ঘটনায় করা মামলায় আসামি করা হয়েছে শাহজাহানকে। মামলার এজাহার ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই জুমার নামাজের পর সিলেট কালেক্টরেট মসজিদ থেকে বেরিয়ে স্থানীয় একদল ছাত্র-জনতা বন্দরবাজার এলাকায় গিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন। ওই সমাবেশে উপস্থিত ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানোর পাশাপাশি ঘটনাস্থলে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নাশকতা সৃষ্টি করা হয়। এ ঘটনায় ২৭ অক্টোবর দক্ষিণ সুরমার মানিকপুর এলাকার আকবর আলী নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়ে সিলেট কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। ১০০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪০ থেকে ৫০ জনকে আসামি করে দায়ের করা হয় এই মামলা। আসামির তালিকার ৭৬ নম্বর নামটি শাহজাহান চৌধুরীর।
মামলায় উল্লিখিত সময় দেশে না থাকলেও ছাত্রদলের সাবেক নেতা শাহজাহান চৌধুরীর নাম উল্লেখ করে এমন ‘গায়েবি মামলা’র জড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি সহজভাবে দেখতে নারাজ স্থানীয় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। তারা বলছেন, সুপরিকল্পিতভাবে প্রবাসী শাহজাহানকে আসামি করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাঁকে দ্রুত এ মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার পাশাপাশি এই কাজে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করারও দাবি করেন। তা না হলে যে কোনো সময় দলের অন্য নেতাকর্মীও এমন সংকটে পড়তে পারেন।
এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এবং শাহজাহান চৌধুরীর পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী ঘটনার সময় তাঁর বাংলাদেশে না থাকার বিষয়টি পরিষ্কার হয়। অন্যদিকে সে সময়ই তিনি যে দেশে ছিলেন– তা পুলিশ বা মামলার বাদী নিশ্চিত করতে পারেননি। এমনকি মামলার বাদী আকবর আলী শাহজাহানের পরিচয় শনাক্ত করতে পারেননি। সে ক্ষেত্রে কীভাবে নাম উল্লেখ করে ইনি শাহজাহানকে মামলার আসামি করেছেন সে প্রশ্নের কোনো উত্তরও দেননি। সমকালের সঙ্গে কথা বলার সময় আকবর আলী মামলার ৭৬ নম্বর আসামি শাহজাহান সম্পর্কে জানতে চাইলে কোনো কিছুই বলতে পারেননি। তিনি এখন খুব অসুস্থ বলে কল কেটে দেন।
সিলেট কোতোয়ালি থানার ওসি জিয়াউল হক এ ব্যাপারে জানান, সরকার পতনের পর অনেক মামলা হয়েছে। প্রবাসে কেউ থাকাবস্থায় যদি মামলায় আসামি হন, তদন্তে তেমনটা পাওয়া গেলে চার্জশিট থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হবে। বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলেও জানিয়েছেন। তবে তাৎক্ষণিকভাবে শাহজাহান ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং হামলায় অংশ নিয়েছেন এমন কোনো তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি।
চুনারুঘাট উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মীর সিরাজ আলী এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘মা-বোন মারা গেলেন, সে সময়ই তাঁকে কেউ দেখিনি। শাহজাহান চৌধুরী প্রায় ১৩ বছর ধরে দেশেই নেই। তাহলে উনি কীভাবে হামলা করলেন? যতদিন ছাত্রদলের রাজনীতি করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগের কথা শোনা যায়নি।’
চুনারুঘাটের দি জাহাঙ্গীর ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী মো. জাহাঙ্গীর আলমের ভাষ্য, ২০১১ সালের ১ মার্চ ছুটিতে আসেন শাহজাহান। প্রায় মাসখানেক বাড়িতে ছিলেন। এর পর ২৭ মার্চ দেশ ছেড়ে যান। তিনি খুব পরিচিত মুখ। তাঁকে শেষ কবে এলাকায় দেখা গেছে, তা অনেকেরই মনে নেই।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে সমকাল থেকে যোগাযোগ করা হয় যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে। এ সময় আক্ষেপের সুরে শাহজাহান বলেন, ছাত্র রাজনীতির নামে টেন্ডারবাজি, ভোগদখল, চাঁদাবাজিতে ছিলেন না কখনও। জীবিকার তাগিদে যুক্তরাজ্যে চলে যান। ২০১১ সালে শেষবার দেশে যান। এর পর আর যাওয়া হয়নি। নিজের মা-বোনের মুখও শেষ দেখা হয়নি। চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় এক ইউপি সদস্যের মাধ্যমে জানতে পারেন, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এখন পুলিশ আসামি খোঁজার নাম করে বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের হয়রানি করছে।
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই তিনি কোথায় ছিলেন তা জানতে চাইলে শাহজাহান চৌধুরী জানান, মামলার এজাহারে ঘটনা সংঘটিত হওয়ার যে সময় ও স্থান উল্লেখ করা হয়েছে, সে সময় তিনি যুক্তরাজ্যের কোভেন্ট্রিতে অবস্থান করছিলেন। তাঁর পাসপোর্ট ও কোভেন্ট্রি বিএনপি নেতাদের বক্তব্যেও একই তথ্য জানা গেছে।
শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘রাজনৈতিক জীবনে একজন পুরোপুরি ছাত্রনেতাই ছিলাম। সেই সঙ্গে ফুটবলে জাতীয় পর্যায়ের একজন উদীয়মান খেলোয়াড়ও। বিগত ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সঙ্গে আঁতাত করা স্থানীয় বিএনপির কিছু সুবিধাবাদী নেতার প্রতিহিংসার শিকার হই। যে কারণে রাজনীতির পাশ কাটাতেই সব ছেড়ে যুক্তরাজ্য চলে আসি। সেখানেও তাড়া করে বেড়াচ্ছে ভূতুড়ে মামলার হয়রানি।’
যুক্তরাজ্যের কোভেন্ট্রি বিএনপির সাবেক সহসভাপতি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘শাহজাহান চৌধুরী যুক্তরাজ্যেই আছেন। আমার জানামতে, তিনি ১৮ জুলাই বাংলাদেশে যাননি। আমরা সবসময় একসঙ্গে চলি। একই এলাকায় একই সার্কেলে চলা প্রবাসীরা একে অন্যের পরিবারের সদস্যের মতো। তিনি এর মাঝে দেশে গেলে আমরা অবশ্যই জানতাম। আমিসহ এখানকার বিএনপি নেতাকর্মীকে তিনি জানিয়েছেন, তাঁকে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে। আমরা শুধু রাজনীতিবিদ নই, দেশের রেমিট্যান্সযোদ্ধাও। শাহজাহান চৌধুরী দলের কাজ করার পরও যদি ভুয়া মামলা ঠুঁকে দেওয়া হয় আমাদের নামে, তাহলে আমরা যাবো কোথায়?’
শাহজাহানকে দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে উল্লেখ করে তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের মতো গায়েবি মামলায় বিএনপিকে ভোগানোর এই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে দলকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে দেশের একজন নাগরিক হিসেবে সরকারের উচিত প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।’
স্থানীয় বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশে না আসা শাহজাহান চৌধুরীকে ‘গায়েবি মামলায়’ আসামি করার ঘটনাটি উদ্বেগের। কোনো পক্ষের দ্বারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেশ-বিদেশে থাকা দলের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার দাবি করেন। শাহজাহানের বিষয়টি আমলে নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে তৃণমূলে অনাস্থা ও অস্বস্তি সৃষ্টি হবে বলেও মনে করেন তারা। তাই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি এসব বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কড়া বার্তা দেওয়ার আহ্বান জানান তারা।
এসব নেতাকর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিভিন্ন স্থানে দলীয় নেতাকর্মীরা হামলা-মামলায় জর্জরিত। জুলাই বিপ্লবের পর দেশে প্রথম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন একজন বিএনপিপন্থি নেতা। এখন দেখা যাচ্ছে, প্রবাসে থেকেও সাবেক নেতারা ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলায় আসামি। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেও ফ্যাসিস্ট ম্যাকানিজম সক্রিয়। এখনও বিএনপির নেতাকর্মীরা নিরাপদ নন।
সিলেট বিভাগের দায়িত্বে থাকা বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক জি কে গউস বলেন, ‘সাবেক বা বর্তমানের বিষয়টি সাংগঠনিক। তবে নৈতিকভাবে বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারীরা সবসময়ই দলের। বিগত সরকারের সময় এমন গায়েবি মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীকে নাজেহাল করা হয়েছে। এখনও যদি সেই অপচর্চা অব্যাহত থাকে, সেটা আপত্তিকর। আমরা দলীয়সহ সম্ভাব্য প্রতিটি সূত্রে নেতাকর্মীর জানাতে চাই, এ বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে তৎপরতা শুরু হয়েছে। এমন মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তারা বিস্তারিত তথ্য কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠাবেন। সেগুলো আমরা দেখব।’
বিএনপির এই কেন্দ্রীয় নেতা আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূসের সঙ্গে সর্বশেষ সাক্ষাতে এসব গায়েবি মামলায় দলীয় নেতাকর্মীকে হয়রানির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এসব মামলা প্রত্যাহার করার কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে কারা বিএনপির নেতাকর্মীকে এসব মামলায় ফাঁসিয়ে বিতর্কিত করতে চাচ্ছে, তাদের ব্যাপারেও খোঁজ নেওয়া হবে।
সিলেট কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল হক জানান, সরকার পতনের পর অনেক মামলা হয়েছে। প্রবাসে কেউ থাকাবস্থায় যদি মামলায় আসামি হন, তদন্তে তেমনটা প্রমাণ হলে চার্জশিট থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হবে। বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখছেন বলেও জানিয়েছেন।