মৌলভীবাজারে পলাশের রঙে প্রকৃতি, গাছের ডালে আগুনবন্যা

দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
‘পলাশ ফুলের মউ পিয়ে ওই/ বউ-কথা-কও উঠল ডেকে’ কিংবা ‘পিন্দাড়ে পলাশের বন পালাব পালাব মন/ নেংটি ইন্দুরে ঢোল কাটে হে কাটে হে/ বতরে পিরিতির ফুল ফুটে।’ গানের এই পঙ্ক্তিগুলো কমবেশি অনেকের কানের কাছে কখনো না কখনো বেজে উঠেছে। গানের সুর, কথা মনকে উদাস করেছে। বুকের ভেতর বেজেছে ঘোরলাগা মাদলের ডাক।
প্রকৃতিতে এখন বসন্ত। বউ কথা কও, নয়তো কোকিল পাখির ডাক শুরু হয়ে গেছে প্রকৃতিতে। পাতার আড়ালে বসে দুই-চারটা কোকিল মুখর হয়ে উঠছে দিনে, রাত দুপুরে। বসন্তের বাতাস বইছে। গাছের পাতায় পাতায় বিলি কাটছে নতুন হাওয়া। ঝিরিঝিরি গান ফুটছে ঝরাপাতাদের বনে। শিমুল-পলাশের বনে ঢেউ তুলছে আগুনবন্যা। দগদগে লাল শিখার মতো সবুজের বুকে জ্বলে উঠছে পলাশ ফুল, বসন্তের মন রাঙানোর খেলা।
এ অঞ্চলের পথের পাশে, নদ-নদীর পারে, হাওরপারে, কারও বাড়ির কোনো এক কোণে তবু কিছু শিমুলের দেখা পাওয়া যায়। পাতা ঝরিয়ে ডালে ডালে ফুটে থাকে লাল, হলদেটে রঙের শিমুল ফুল। এই ফাল্গুনের দিনে, নয়তো রাতের কোনো এক সময় এই ফুল ঝরে পড়ছে ধুলায়, ঘাসের বুকে। সেই দিক থেকে পলাশের দেখা পাওয়ার সুযোগ একেবারেই কম। পথ চলতে কিংবা কোনো সংরক্ষিত এলাকায় কদাচিৎ কোথাও দু–একটা পলাশগাছের দেখা পাওয়া যায়। তারা নীরবে-নিভৃতে ফুটে থাকে। অচেনা-অদেখা হওয়ায় এই অঞ্চলের অনেকের কাছে পলাশ শুধুই একটি নাম আর যতটুকু পরিচয়-তা ওই ছবিতেই।
তবে শুধু ছবিতে নয়, এই পলাশ ফুলের সঙ্গে সম্প্রতি এক দুপুরে সরাসরি দেখা হয়েছে মৌলভীবাজারে বর্ষিজোড়া ইকোপার্কসংলগ্ন বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় কার্যালয় এলাকায়। সেখানে দুটি গাছে ঝেঁকে পলাশ ফুটেছে। মৌলভীবাজার শহর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে কার্যালয়টির অবস্থান।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মির্জা মেহেদী সরোয়ার জানিয়েছেন, এখানে মাঘের শেষেই পলাশের গাছে ফুল ফুটতে শুরু করেছে। ফাল্গুনে ডালে ডালে পলাশের ফুল।
মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে কালেঙ্গার দিকে বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক হয়ে একটি সড়ক চলে গেছে। এই উঁচু-নিচু সড়কের এক পাশে টিলার ওপর বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় কার্যালয়। ঢালু পাকা সড়ক বেয়ে টিলার ওপর উঠতেই দূর থেকে চোখে পড়ে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তার বাংলো-সংলগ্ন দুটি গাছ আগুন রঙে লাল হয়ে আছে। বাইরে থেকে এই আগুন বন্যার দেখা পাওয়ার সুযোগ নেই। চারদিক উঁচু গাছে ছেয়ে আছে। শালসহ অনেক রকমের গাছ। কবে কে ওই পলাশের গাছগুলো ওই স্থানটিতে রোপণ করেছিল, তা এখন আর কারও জানা নেই। শুধু ফাগুন এলেই সকলে বুঝতে পারেন এখানে বসন্তের আগুন লেগেছে। এ ছাড়াও কার্যালয়ের দক্ষিণ পাশে পলাশের আরও কয়েকটি গাছ আছে। সেগুলোতেও কলি এসেছে, বিচ্ছিন্নভাবে এক-দুটোতে ফুল ফুটেছে। কয়েক দিনের মধ্যেই গাছগুলো ফুলে ফুলে লাল হয়ে উঠবে। ওই গাছগুলোতেও ঢেউ ফুটবে আগুনের।
পলাশগাছ মাঝারি আকারের একটি পর্ণমোচী বৃক্ষ। বৈজ্ঞানিক নাম বিউটিয়া মোনোসপারমা। গাছটি সর্বোচ্চ ১৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। টকটকে লাল ছাড়াও হলুদ ও লালচে রঙের পলাশ ফুল দেখা যায়। পলাশ ফুল দুই থেকে চার সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। বাংলাদেশের কমবেশি সব জায়গায় পলাশগাছ দেখা যায়। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া পর্যন্ত পলাশের বিস্তৃতি আছে।
মুহূর্তটি তখন ‘আলতা সিন্দুরে রাঙা’ হয়ে আছে। হালকা ধূসর সবুজের মাঝখানে এখানে পলাশের রঙে এখন অন্য এক প্রকৃতি। এখানে পলাশের রঙেই বসন্ত এসেছে।