ফসল তুলতে জনবিচ্ছিন্ন হাওরে জিরাতিরা

হাওরাঞ্চল প্রতিনিধি
শুধুমাত্র ফসল উৎপাদনের জন্য শুষ্ক মৌসুমের ছয় মাস নিজের পরিবার পরিজন ছেড়ে অস্থায়ী ভাবে সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার গোরমার হাওরের পাড়ের মুকসুদপুর গ্রামের থাকেন কিছু মানুষ। কাগজে কলমে উপজেলার চামরদানী ইউনিয়নের একটি গ্রাম হিসেবে মুকসুদপুরকে গ্রাম বলা হলেও মুলত ছয় মাসের গ্রাম হিসাবে পরিচিত।
তবে প্রত্যেক বোরো মৌসুমে মুকসুদপুরের জিরাতিরা কার্তিক অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত অবস্থান করায় জমজমাট এক জনবসতির দেখা মিলে। কারন ছয় মাস কৃষিকাজে ব্যস্ত জীবন কাটিয়ে সোনালি ফসল নিয়ে বৈশাখ মাসে বাড়ি ফেরেন গ্রামটির সকল বাসিন্দারা।আর প্রতিবছর বর্ষাকালের ছয়মাস হাওরের অথৈ জলের নিচে থাকে এই গ্রামের অস্তিত্ব।এই গ্রামটি জিরাতি গ্রাম এবং একটি কৃষি শ্রমিকদের বসতি হিসাবে হাওরাঞ্চলে ব্যাপক পরিচিত রয়েছে। নানান কারনেই জিরাতিদের অবস্থা এখন আগের মত নেই। তবুও হাওরের সঙ্গেই এসব জিরাতিদের গভীর হৃদ্যতা সখ্যতা থাকার বার বার আসছেন বলে জানিয়েছেন হাওর পাড়ের মানুষজন।
মুকসুদপুর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, আমরা ছন,বাঁশ দিয়ে ছাওয়া অস্থায়ী ঘরে স্বামী স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে খরতাপ,রোদে পোড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে কষ্ট করে থাকেন। পাশাপাশি গরু, ছাগলসহ অন্যান্য প্রাণীও। বছরের একমাত্র সম্বল বোরো ফসল ফলিয়ে গন্তব্যে ফেরেন বৈশাখ মাসে। তাদের আদিপুরুষ থেকে বংশ পরম্পরা এভাবেই চালাচ্ছেন নিজেদের চাষাবাদ। জিরাতকালে তাদের সুপেয় পানি,স্যানিটেশন ল্যাট্রিন,শিশুদের পড়াশোনার জন্য কমিউনিটি স্কুল স্থাপনাসহ সকল ধরনের নাগরিক জীবনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে। পাহাড়ী ঢলের রোরো ফসলের ক্ষতি হওয়ায় আগের মত জিরাতিদের আসা অনেকটাই কমেছে।
তারা আরো জানান,ইজারাদারের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় হাওরে আগের মত মাছ ধরার সুযোগ নেই। ফলে পরিবারের সদস্যদের আমিষের ঘাটতি পূরণ করা যায় না। দিন দিন এসব সংকট বাড়ছে। এতে অনেক জমি পতিত থেকে যাচ্ছে প্রতি বছর।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে,সমৃদ্ধশালী কৃষকদের গ্রাম হিসাবে পাকিস্তান শাসন আমলে মুকসুদপুর গ্রামের পরিচিত ছিল। এই গ্রামে হিন্দু মুসলিম মিলেমিশে শতাধিক গৃহস্থ পরিবারের বসবাস ছিল সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ়। শুষ্ক মৌসুমে হাওরে ফসল উৎপাদন ও ভরা বর্ষায় হাওরে মাছ ধরে চলত গ্রামবাসীর জীবন। বছরের পর বছর পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট অকাল বন্যায় ফসল হারিয়ে ও হাওরের টেউয়ের আঘাতে গ্রামের বাড়িঘর ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি ছিল ডাকাতের উপদ্রব। ফলে মুকসুদপুর গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দারা জীবিকার তাগিদে শূন্যহাতে উপজেলার বংশীকুন্ডা উত্তর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী অঞ্চল বাকাতলা গ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। রয়ে যায় তাদের বাপ দাদার ভিটেমাটি আর হাওরের বুকে শত শত একর ফসলি জমি।
বৃদ্ধা গীতা রাণী সরকার জানান,মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে স্বামী সন্তানদের নিয়ে মুকসুদপুর গ্রামে বসবাস করেছেন। শুকনো মৌসুমে হাওরে বোরো ফসল আর বর্ষায় হাওরে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে যা রোজগার হতো তা দিয়া সংসারের খরচ চলতো। এরপর হাওরের ডেউয়ে গ্রামটি বিলিন হতে শুরু করে। এর মধ্যে ডাকাতের দল লুট করে নিয়ে নিয়ে যেত সর্বস্ব। পরে গ্রামের মানুষ সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে মেঘালয় সীমান্তবর্তী বাকাতলা গ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। সেই থেকেই মুকসুদপুর শুধু নামই রইল,গ্রামটি হারিয়ে গেল হাওরের বুকে। ছেড়ে যাওয়ার কয়েক বছর পর থেকেই তারা জিরাতি হিসেবে মুকসুদপুরে আসতে শুরু করেন। তবে স্থায়ী বসতি স্থাপনের চিন্তা আর করেনি কেউ।
মুকসুদপুরের জিরাতি আরেক বাসিন্দা কৃষক শংকর সরকার বলেন, বাপ দাদার জমি ছাইড়া যাইতে মন চায় না। তাই প্রতিবছর এমন সময়ে এখানে আসি। ২০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে মধ্যনগর বাজারে গিয়ে জিনিসপত্র কিনতে হয়। এছাড়া সুপেয় পানি,স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাবে নানা রোগে আক্রান্ত হই, সুচিকিৎসা পাই না। পরিবারের ছোট শিশুরা পড়ালেখা করতে পারে না। তারা আমাদের সাথেই আবার ঘরে কাজ করে খেলা ধুলা করে সময় পার করে। এখানে বিদ্যুৎ নেই,তাই কেউ কুপি বাতি কেউবা সোলার প্যানেল ব্যবহার করে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে হয়। এছাড়াও হাওরে ফসল ফলাতে এসে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অকাল বন্যায় হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে ফসল ডুবে গেলে জিরাতিদের স্বপ্ন ভেঙে যায়। মাথার উপরে ঋণের বোঝা নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়। ভাল ফলনে বুক ভরা আশা নিয়ে সারা বছর পরিশ্রম করেন তারা। যুগের পর যুগ শত দুঃখ কষ্টে এভাবেই চলছে জিরাতিদের জীবনযাপন।
মধ্যনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজ্জ্বল রায় বললেন, জিরাতিদেরকে সরজমিনে পরিদর্শন করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তাদের জীবন মানের উন্নয়নে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।