মুকুল চৌধুরী: একজন জ্যোতির্ময় কবির প্রস্থান

দৈনিকসিলেটডটকম
আশির দশকের অন্যতম কবি ও গীতিকার মুকুল চৌধুরী আর নেই। ২৩ এপ্রিল এই জ্যোতির্ময় কবি প্রস্থান করেছেন।
মুকুল চৌধুরী শ্রমনিষ্ঠ কবি, লেখক। লিখে চলেছেন অনলস, গত শতকের সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে। কবিতার পাশাপাশি গদ্যসাহিত্যেও তিনি শক্তিমান, ঝরঝরে, বুদ্ধিদীপ্ত। প্রবন্ধ, গবেষণায় ঐতিহ্যগামী, ক্লাসিক ও কল্যাণব্রতে কমিটেড। কিশোর-রচনা ও সম্পাদনায় তার রয়েছে স্বচ্ছন্দ ও স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ বিচরণ।
কবি মুকুল চৌধুরী বুক অব দি ইয়ার এচিভম্যান্ট এওয়ার্ড, বিএনএসএ, ইংল্যান্ড (১৯৯৬); সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ, ঢাকা (১৯৯৭); রাগীব রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার, সিলেট (২০০৬); জালালাবাদ সাহিত্য পুরস্কার, সিলেট (২০১২) এ ভূষিত হন।
মুকুল চৌধুরী বাংলা কবিতায় নিজস্ব দৃষ্টি ও সৃষ্টির নতুন বাঁক নির্মাণ করেছেন। মত এবং পথ নিয়ে ভিন্নতা আনতে চেষ্টা করেছেন সজ্ঞানে, সচেতনভাবে। কবিতার কারিগর হিসেবে সেই আশির দশক থেকে সৌরভে গৌরবে এগিয়ে চলেছেন। তার কবিতায় উঠে এসেছে, আকাশ, নক্ষত্র, নদী, বৃষ্টি, পাহাড়, জ্যোৎস্না, গাছগাছালি, জীবন-জীবিকা, আশা ও ভালবাসা। তার পংক্তিমালায় জ্যোতির্ময় কাব্যসত্তা বহমান।
কবিতার আবেগঘন সবুজ জমিনে এক সরব পরিব্রাজক তিনি। কয়েক দশক ধরে বিরামহীন হাঁটছেন। হেঁটে হেঁটে মাড়িয়েছেন কবিতার নতুন নতুন দেশ ও প্রদেশ। মুকুল চৌধুরীর সৃজনবিশ্বে দৃশ্যমান ভাবের সমুদ্র। আধ্যাত্ম-মরম, মানুষের মানচিত্রে মুক্তির যুদ্ধ, প্রিয়তমার গান্ধর্ব ঘ্রাণ, উম্মার সোয়াশো কোটি হাহাকার।
অস্পষ্ট বন্দর থেকে মাটির ঘটনা কালের সবুজপত্রে মোড়া তার সকল সৃজনকর্মের ঋদ্ধ মলাটের মুখচ্ছবিগুলোও স্বকীয়-স্বতন্ত্র। নিরীক্ষা প্রয়াসের সার্থক পাপড়ি। আলাদা স্বরের গায়ক পাপিয়া।
স্বতন্তরের স্বননে কোনটি শিকড়সন্ধানী। কোনটি আবেগমন্ত্রিত-ইতিহাস ঐতিহ্যে আত্মত্রাণের পথপদর্শক। কোনটি গার্হস্থ্য প্রেমের রাহসিক প্রস্রবন। কোনটি আধ্যাত্ম-হৃদয়ের অতল আশ্চর্য অনুভবে গরীয়ান। এ অনুভব বন্ধুর আধ্যাত্মিক পর্যটনে রূপান্তরিত। এ রূপান্তর শিল্পাত্মার যৌথতায় শব্দভূগোলেও অনন্য।
বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি ও কথাশিল্পী আল মাহমুদ বলেছেন, মুকুল চৌধুরী প্রতিভাবান কবি। বিবেকবান কবি। তার দেখার চোখ আছে। তিনি স্বপ্ন ও কল্পনাকে সাজাতে জানেন। তার ভাষা নমনীয় এবং ভাষার যে ছন্দ চাতুরী, তার কবিতায় তাও বহমান। এই গুনগুলো নিয়ে একজন কবি বড়ো কবি হতে পারেন। মুকুল চৌধুরীর এই গুণগুলোকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি মনে করি যে, মুকুল চৌধুরী একজন প্রকৃত কবি। আমাদের মধ্যে যে কয়জন প্রকৃত কবি আবির্ভূত হয়েছেন, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন, আশির দশকের কবিতার একটি চারিত্রলক্ষণ- কবিতার ছন্দ-মিলে প্রত্যাবর্তন- মুকুল চৌধুরীর কবিতায় প্রথম থেকেই স্পষ্টভাবে দেখা দিয়েছে।.. বিষয়ের দিক থেকে আদর্শিকতার অনুধ্যান আর আঙ্গিকের দিক থেকে ছন্দ-মিলে সমর্পন.. আশির দশকের কবিদের মধ্যে তাকে একটি স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
‘পাতলা কুয়াশা গায়ে মেখে কিশোর বাড়ি ফিরছে,/ ফিরতে ফিরতে খড়ের চুল্লির পাশে হিম-হাত সেঁকা।/ ফিরতে ফিরতে অন্ধকার, চাঁদের লণ্ঠনে পথ দেখা।/ ফিরতে ফিরতে বিকেলের সুখ ভোরের চাঁদের মতো ফিকে হয়ে যাওয়া।/ এক ফাঁকে/ মায়ের বকুনীর পিছে পিছে পিঁপড়ার আগে আগে/ পড়ার টেবিলে হাঁটে পিঠা আর পায়েসের বাটি।/ কে বেশি মোহিত হয়, পিঁপড়া না শীতের পিঠা?/ কে বেশি আনন্দ পায়, পিঠা না মায়ের মুখ?/ বরাবর শীত এলে এইসব স্মৃতির প্রবাল/ বারবার খুঁজে খুঁজে হন্যে হয় একটি লাটাই,/ যেখানে মাঞ্জা দেওয়া সুতোর ভেতর/ আমার কিশোর-বেলা লুকিয়েছিল শীতের সন্ধ্যায়।’
‘ঢালু বেয়ে ওঠে আসছে মেঘ। ঢালু বেয়ে ওঠে আসছো তুমিও।/ করিডোরে আমি কার দর্শনার্থী?/ মেঘকে বলি, হে মেঘ-আমি তো কালিদাস নই!/ তোমাকেও বলি, ওগো মেয়ে-আমি তোমার কে?/ কতো জনমের চেনা?/ জবাব না পেয়ে সতের বছর ধরে লেখা বিরহ-গাথা থেকে/ কয়েক পঙ্ক্তি আবৃত্তি করবো বলে যেই না/ ঝোলা ব্যাগে হাত ঢুকিয়েছি-/ তুমি বললে বৃষ্টি থামুক! নয়তো বৃষ্টির ঝাপটায়/ সব বিরহ-উপমা মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যাবে/ আমি বললাম-হ্যাঁ, আমার বিরহ-গাথা কেন?/ উপমান যেখানে সশরীরে হাজির, সেখানে শব্দের অভিঘাতের চেয়ে/ নন্দনের আনন্দই শ্রেয়।
এমন অসংখ্য জীবনধর্মী কবিতার স্রষ্টা মুকুল চৌধুরী মনের ক্যানভাসে নান্দনিকতার আঁচড়ে জীবন কথনের ছবি আঁকেন। তাই তার কবিতায় প্রস্ফুটিত হয় চির নতুনের এক অনিবার্য সন্নিবেশ। চেতনার অভিব্যক্তিকে নাড়া দিয়ে মনের ঘুমন্ত সত্তাকে জাগিয়ে তোলে তার কবিতা।
‘নিঃস্রোত নদীর দু’পাড়ে ঝাউগাছের বদলে এখন ইটের স্তূপ।/ ট্রাক নামক দৈত্যের উদরপূর্তির অপেক্ষায় বালি আর কংক্রিটের অট্টহাসিতে/ হাঁপিয়ে উঠছে প্রাচীন অশ্বত্থ। সেই আলপথও নেই। বিশাল অজগরের মতো/ শুয়ে থাকা পাকা সড়কের নীচে ঘনঘাসের সাথে মুছে গেছে তার রেখা।/ টেলিগ্রাফ থামের উত্তরসূরি হয়েছে বহুজাতিকের মোবাইল এ্যান্টিন্যা। ছাতা-মাথার/ কৃষক যখন পাওয়ার টিলারে বসে বিঘার পর বিঘা, একরের পর একর/ চষে বেড়ায়; দূরের গরুগুলো তখন মনোবেদনায় জাবরকাটাও ভুলে যায়।’
‘আমাদের দিন ও রাত্রি, আমাদের সকাল ও সন্ধ্যা/ আমাদের ঝড় ও রৌদ্র, আমাদের মেঘ ও বৃষ্টি;/ সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, টাইফুন অথবা সাম্প্রতিক সুনামির মতো/ দুঃস্বপ্নও ধুয়ে-মুছে যায়, শুকিয়ে যায় ক্ষতচিহ্ন।/ যথারীতি সূর্য ওঠে, পৃথিবীতে রোদ খেলা করে/ বাতাসে ক্লোরোফিলও জমে।/ পেশীতে শক্তি ফিরে এলে মনের মেঘও কেটে যায়। গাছের পাতাও ঝরে, কিন্তু ঝরে না মনের পাতা।’
এভাবে আমাদের জীবন ঘনিষ্ঠ কবিতা লিখে মুকুল চৌধুরী গণমানুষের মনে নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছেন। জন্মদিন শিরোনামের কবিতায় অসাধারণভাবে বলেছেন-
‘জন্মের ক্রন্দন শোনে ঐদিন কোন্ পাখি হারিয়েছিল পথ,/ কোন্ ফুল ফুটেছিল মৃত-বসুধায়,/ পাতার মর্মরে কার ধ্যান ভাঙে, কার গানে জ্যোৎস্নার প্লাবন?’
‘পঞ্চাশ পেরিয়ে আজ একান্ন শরৎ। সূর্যস্নাত সকাল,/ তীব্রতাপ দুপুর পেরিয়ে বিষণ্ণ বিকেল।/ করুণ সন্ধ্যা সমাগত!/ পর্দা উঠছে, পর্দা নামছে/ দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে অসফল অভিনয়ে মঞ্চ কেঁপে ওঠে।/ অথচ মনে হয় এই তো সেদিন, বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের সাথে/ জনান্তিকে হারিয়ে গিয়েছিল কম্পনহীন প্রথম কান্নার স্বর।’
কবির মমতায় উচ্চারিত কবিতার পঙ্ক্তি সমূহ বাংলা সাহিত্যের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
‘নরম রোদের তেজে আলপথে গঙ্গাফড়িং ধরতে গিয়ে বান্নী থেকে কিনে আনা/ নাকফুল হারিয়েছে বলে কিশোরীর নিষ্পাপ মুখখানি গাঙপাড়ের/ কাদামাটির রঙ ধরেছে।/ বেলা বেড়ে গেলে ভরপেট স্কুলের মেঠোপথ। সীমান্ত প্রহরীর মতো গ্রামের প্রবেশ পথে/ দাঁড়িয়ে থাকা শত বছরের অশ্বত্থের ছায়া গায়ে মেখে ছাতা-মাথার কৃষকের/ বীজ বপনের কলা-কৌশল দেখতে দেখতে কাঁটা ঝোপের পাশে স্তূপ করে রাখা/ আধ-মরা টাকি মাছ ডিঙ্গিয়ে স্কুলের মাঠ।’
তথ্য সূত্র: চ্যানেল৭৮৬