প্রসঙ্গ: জামায়াতের নিবন্ধন ও দাঁড়িপাল্লা প্রতীক

দৈনিকসিলেটডেস্ক
আগামী ডিসেম্বর থেকে জুন মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। দলীয়ভাবে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজন নিবন্ধন ও প্রতীক। কিন্তু দেশের অন্যতম প্রধান দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীক নেই।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। এরপর ২০১৮ সালে জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীক বাতিল করে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি জামায়াত। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা জোটসঙ্গী বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে ভোটে অংশ নেয়। ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও এখনো নিবন্ধন ও দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ফিরে পায়নি জামায়াতে ইসলামী। নিবন্ধন ও দলীয় প্রতীক ফিরে পেতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইনি লড়াইয়ের অপেক্ষায় তারা। নিয়ম অনুযায়ী আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় (কজলিস্টে) এলে মামলাটির শুনানি হবে বলে আশা করছেন আইনজীবীরা।
এদিকে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলেও সংসদীয় আসনে নিজ নিজ দলীয় প্রার্থীদের গণসংযোগ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির পাশাপাশি জামায়াত ইসলামীও দেশের প্রায় সব আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় নামিয়েছে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে জানা গেছে, ইসির কর্মকর্তারা বলছেন যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে, সেহেতু আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আবার তারা নিবন্ধন ফিরে পেতে পারে।
এদিকে দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে আইনজীবী জানিয়েছেন, উচ্চ আদালতের রায়ে দলীয় নিবন্ধন পাওয়ার পরই একই প্রক্রিয়ায় দলের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ফিরে পেতে পারেন। আর নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পেতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যে সব যুক্তি তুলে ধরা হবে তা নিয়ে আলোচনা করেছে জামায়াতের আইনজীবী প্যানেল।
নিবন্ধন ও প্রতীক নিয়ে জামায়াতের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির জাগো নিউজকে বলেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দিয়েছিল সেনাসমর্থিত তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শুধু জামায়াতে ইসলামীই নয়, এর আগে তো বাংলাদেশে নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দলই ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালে আইন পাস করে সবাইকে বললো যে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন নিতে হবে। নিবন্ধনের দরখাস্ত করার পর জামায়াতে ইসলামীকে প্রভিশনাল নিবন্ধন দিল এবং বললো এই জিনিস সংশোধন করতে হবে। পরে সংশোধন করতে দেওয়া হয়েছে। এই প্রভিশনাল নিবন্ধনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করা হয়েছে। বৃহত্তর বেঞ্চে রিটের শুনানি হয়। শুনানি শেষে দুজন বিচারক বললেন যে নিবন্ধন বাতিল, আর একজন বললেন নিবন্ধন থাকবে। এর বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে। শুনানি অর্ধেক হয়ে গেছে। আশা করছি বাকি শুনানিও হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। একজন বিচারক আদালতে আসতে পারেননি। আশা করি এটার শুনানি হবে।
প্রতীক ফিরে পাওয়ার পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া কী হবে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন ফিরে পেলে প্রতীকও পাবে। জামায়াতের রেজিস্ট্রেশন ফিরে পাওয়ার সঙ্গে প্রতীক ফিরে না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ একটাই বলে যে সুপ্রিম কোর্টের রেজ্যুলেশন আছে। এ রেজ্যুলেশনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করা হয়েছে। কারণ সুপ্রিম কোর্টের সামনে দাঁড়িপাল্লা ঝোলানো আছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই দাঁড়িপাল্লা জামায়াতে ইসলামীর প্রতীক। সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রেজ্যুলেশন কোনো আইনগত প্রতিনিধিত্ব করে না। এটা মতামত মাত্র। রায়ের মাধ্যমে তো প্রতীক বাদ করেনি, সুতরাং এই আপিল নিষ্পত্তি হয়ে রেজিস্ট্রেশনও মিলবে, প্রতীকও মিলবে।
দাঁড়িপাল্লা নিয়ে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হবে
আপিল শুনানিতে জামায়াতের দলীয় নির্বাচনী প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ফিরে পেতে কয়েকটি আইনি যুক্তি তুলে ধরবেন দলটির আইনজীবীরা। এ বিষয়ে জামায়াতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আপিল বিভাগে শুনানিতে আমরা বলব, প্রতীক বরাদ্দের দায়িত্ব তো সুপ্রিম কোর্টের নয়। কোনো প্রতীক সুপ্রিম কোর্ট বরাদ্দ করতে পারেন না। প্রতীক বরাদ্দ করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রতিটি দলকে বরাদ্দ করা হয়েছে। আজ থেকে নয়, কয়েক যুগ থেকে জামায়াতের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা। জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত দাঁড়িপাল্লাই দলটির প্রতীক। এই প্রতীক এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর রেজিস্ট্রেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যদি আমাদের আপিল অ্যালাউ হয়, আপিল বিভাগ আপিল অ্যালাউ করেন, তাহলে নিশ্চয়ই প্রতীকসহ অ্যালাউ করবেন।
শিশির মনির বলেন, একটি কথা বলা হয় দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বরাদ্দ না দিতে সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভার একটি রেজ্যুলেশন আছে। রেজ্যুলেশনের কপি আমরা সংগ্রহ করেছি। পড়ে দেখেছি, রেজ্যুলেশনের মধ্যে যা আছে সেটা কোনো বিচারিক সিদ্ধান্ত নয়। এটা হলো প্রশাসনিক। উনারা বলছেন, দাঁড়িপাল্লা প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ সমীচীন নয়। কেন সমীচীন নয়, কারণ সুপ্রিম কোর্টের সামনে দাঁড়িপাল্লা ঝুলানো আছে। এ কারণে কোনো পার্টির ব্যবহার করাটা সমীচীন নয়। এটা একটা মতামত মাত্র। এর আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটা সুপ্রিম কোর্টের কোনো সিদ্ধান্ত নয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। হাইকোর্ট বিভাগও প্রতীকের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এই যুক্তিগুলো আমরা আপিল বিভাগে উপস্থাপন করব।
অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, আপিল শুনানির জন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। আদালতে আমাদের আইনি যুক্তিগুলো লিখিতভাবে উপস্থাপনের পাশাপাশি শুনানিকালে আরও নানান যুক্তি, ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে।
নিবন্ধন নিয়ে যুক্তিগুলো হলো
প্রথমত, সংবিধানের সঙ্গে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক এবং গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো, গণতান্ত্রিক ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী অতীতে সবগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। প্রায় সব জাতীয় সংসদেই জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব ছিল। জামায়াতের গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনোভাবেই অসাংবিধানিক নয়। কারণ অ্যাসোসিয়েশন করার অধিকার, দল গঠন করার অধিকার, এটা সব ব্যক্তির আছে।
দ্বিতীয়ত, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে এমন একজন ব্যক্তির (সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, যার দলের গঠনতন্ত্র যদি বিশ্লেষণ করেন তাহলে সেখানে দেখবেন জামায়াতের গঠনতন্ত্র যে কারণে তিনি দূষিত বলছেন, তার থেকে তার নিজের দলের গঠনতন্ত্র অনেক বেশি দূষিত। তার দল অর্থাৎ তরিকত ফেডারেশনের গঠনতন্ত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা আসলে কোনোভাবেই তাদের জায়গা থেকে জামায়াতের গঠনতন্ত্র চ্যালেঞ্জ করার এখতিয়ার রাখে না। কারণ উচ্চ আদালতের তিনজন বিচারপতির মধ্যে একজন বিচারপতি রায়ে উল্লেখ করেছেন, রিটকারী সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর এ ধরনের রিট করার লোকাস স্ট্যান্ডি (এখতিয়ার) নেই। তিনি জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে কথা বলতে পারেন না। কারণ তার নিজের দলের গঠনতন্ত্র ত্রুটিতে পরিপূর্ণ।
তৃতীয়ত, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন জামায়াতকে প্রথমে রেজিস্ট্রেশন দিয়ে গঠনতন্ত্রের কিছু জায়গায় সংশোধন করতে বলেছে। সংশোধন প্রক্রিয়া চলমান থাকা অবস্থায় নিবন্ধন বাতিলের রায় হয়েছে, তাহলে তো দলটিকে গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে দেওয়া হলো না। বরং নির্বাচন কমিশনের কাজের মধ্যে এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে কমিশনের কাজকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে।
চতুর্থত, ১৯৯২ সালের আইনে বলা হয়েছে, যখন সংবিধান কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে অধিকার দেওয়া হয় এবং তার সঙ্গে রেস্ট্রিকশন দেওয়া হয় তাহলে সংবিধান কর্তৃক যে অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেটা প্রাধান্য পাবে। সংবিধানে বলা হয়েছে, সংগঠন করা, দল গঠন করা এটা একটা সাংবিধানিক অধিকার। তাই যদি হয় তাহলে কোনো এক জায়গায় যদি রেস্ট্রিকশন থেকে থাকে, সেই রেস্ট্রিকশনকে অবশ্যই স্ট্রিকলি দেখার সুযোগ নেই।
পঞ্চমত, এটা একটা সার্টিফায়েড আপিল। সার্টিফায়েড আপিল মানে হলো, হাইকোর্ট বিভাগ যখন মামলাটা নিষ্পত্তি করেছে, তখন হাইকোর্ট ডিভিশন নিজেই সার্টিফিকেট দিয়ে বলেছেন, এই মামলায় সংবিধানের জটিল ব্যাখ্যা জড়িত। জটিল ব্যাখ্যা জড়িত হওয়ার কারণে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সরাসরি আপিল করা হবে। লিভ টু আপিল হওয়ার সুযোগ নেই। যদি তাই হয় তাহলে হাইকোর্ট ডিভিশন স্বীকার করছেন এই মামলাটি হলো এমন এক মামলা যে মামলায় সংবিধানের বিস্তর ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। অর্থাৎ হাইকোর্ট নিজেই স্বীকার করেছেন এটা সুপ্রিম কোর্টে পূর্ণাঙ্গ সেটেলড হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু যেহেতু পূর্ণাঙ্গভাবে সেটেলড হয়নি। কারও সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিতে হলে এভাবে তো কেড়ে নেওয়া যায় না।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়ার পরের বছর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। রিটে জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নির্বাচন কমিশনসহ চারজনকে বিবাদী করা হয়। তারা জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আর্জি জানান।
এ রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন। ছয় সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়। রুলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ (বি) (১) (বি) (২) ও ৯০ (সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে রুল জারির পর ওই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দুবার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে দুবার তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। এতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করাসহ বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়।
পরে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আবেদনকারীরা এ রুল শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠনে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেন। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৫ মার্চ আবেদনটি বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন দ্বৈত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠানো হয়। ১০ মার্চ সাংবিধানিক ও আইনের প্রশ্ন জড়িত থাকায় বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানির প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে আবেদনটি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানোর আদেশ দেন দ্বৈত বেঞ্চ। ওইদিন প্রধান বিচারপতি তিন বিচারপতির সমন্বয়ে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেন।
২০১৩ সালের ১২ জুন ওই রুলের শুনানি শেষ হলে যে কোনো দিন রায় দেবেন বলে জানিয়ে অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ। পরে জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন ২০১৩ সালের ১ আগস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ।
সে সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেন, এ নিবন্ধন দেওয়া আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত। একইসঙ্গে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে আপিল করারও অনুমোদন দিয়ে দেন। তবে এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। পরে একই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৩ সালে হাইকোর্টের ওই রায়ের পর দশম সংসদ নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। আবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অংশ হিসেবে তারা ভোটও বর্জন করে। সে সময় নিবন্ধনও বাতিলের কোনো কার্যক্রম শুরু করা হয়নি।
ওই নির্বাচনের পর সে সময়কার ইসি সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘আদালতের রায় থাকায় নিবন্ধন বাতিলের প্রয়োজন নেই। তবে দলটির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। ’
কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কেএম নূরুল হুদার কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। তৎকালীন ইসি সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমদের ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর দলটিকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। দলটি নিবন্ধন নম্বর পেয়েছিল ১৪। কিন্তু একটি মামলার রায়ে হাইকোর্ট ২০১৩ সালে দলটির নিবন্ধন প্রক্রিয়া অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন। তাই নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করলো।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, নিজ দলের প্রতীক নিয়ে ভোটে অংশ নিতে হলে ইসির নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। তাই ওই প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে দলটির নিজের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপনের পাঁচ বছর পর জামায়াতের আপিল আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ায় দলটির নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার আর কোনো পথ নেই।
এদিকে কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়, স্থানীয় কোনো নির্বাচনেও দলগতভাবে জামায়াতের অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা, স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা সংশোধন করে ২০১৫ সালেই কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের কমিশন জামায়াতের দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বাদ দেয়। এরপর ২০১৮ সালে বাদ দেওয়া হয় সংসদ নির্বাচনের প্রতীকের তালিকা থেকেও।
এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান বলেন, জামায়াতে ইসলামী আদালতের রায়ে নিবন্ধন হারিয়েছে। তাই দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যেভাবে দাঁড়ায়, যে শর্তগুলো আছে, সেগুলো পূরণ করলে যে কেউ দাঁড়াতে পারবে। সে নিয়ম অনুযায়ীই চলবে।
বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৫০টি। এজন্য দলগুলোর বিপরীতে ৫০টি প্রতীক সংরক্ষণ করেছে ইসি। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ২৫টি প্রতীক সংরক্ষণ করেছে সংস্থাটি। সেখানে কোথাও দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নেই। আরও ৪৬টি দল নিবন্ধনের আবেদন জমা দেওয়ার সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে।
সৌজন্যে: জাগোনিউজ