সিলেটে জুলাই বিপ্লবে আহত -শহীদ পরিবারের কান্না থামেনি আজও

দৈনিকসিলেটডটকম
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ৯ মাস পেরিয়ে গেছে। আহত-শহীদদের পরিবারে কান্না থামেনি আজও। কেউ কাঁদছে সন্তান হারিয়ে, কেউ স্বামী হারিয়ে, কেউ বাবা হারানোর শোকে এখনো দিশাহারা। কেউ আবার হাত পা চোখ হারিয়ে পঙ্গু কিংবা অন্ধত্বকে সঙ্গী করে নিয়েছেন। অনেকে ঢাকার নিটর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সিলেটে যারা আহত হয়েছেন তাদের অনেকে এখনো ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেডে নিরবে কাঁদছে। অনেকে উন্নত চিকিৎসার আশায় স্বপ্ন দেখছেন নতুন জীবনের।
কারোভাগ্যে এতদিনেও আহত-শহীদের তালিকায় জায়গা কিংবা সরকারি সহায়তা না জোটছেনা। ইতিমধ্যে অভ্যুত্থানে আহত-শহীদদের আংশিক তালিকাও প্রকাশ হয়েছে। নিহদের মধ্যে সিলেটের ১২ জনের নাম রয়েছে। এই জেলার নিহত ৩ জন ও আহত ১৮ জনের নাম এখনো তালিকায় ওঠেনি। সরকারি সহায়তা ও নাম তালিকাভুক্তির জন্য বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেছে তাদের পরিবার। কিন্তু নেই কোন অগ্রগতি। এখন তাদের খোঁজও নিচ্ছেনা কেউ। এতে হতাশ নিহত ও আহতদের পরিবার।
শহীদের তালিকায় না ওঠা একটি নাম নাহেদুল ইসলাম। গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের ইসলামাবাদের উছমান আলী ও শফিকুন নেছা দম্পতির সন্তান তিনি। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে নাহেদুল বড়। বাবা অসুস্থ হওয়ায় অল্প বয়সেই পরিবারের হাল ধরতে দিনমজুরি শুরু করেন। ২২ বছরের এই যুবক গত ৫ আগস্ট মিছিলে গুলিতে প্রাণ হারান। এর পর কেটে গেছে ৯ মাস। স্থানীয় এক ইউপি সদস্য তাঁর পরিবারকে ২০ হাজার টাকা সহায়তা দিয়েছেন। এ ছাড়া কোনো সহায়তা পায়নি দরিদ্র পরিবারটি। সরকারি সহায়তা ও নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে আবেদন করেছিলেন অসুস্থ বাবা উছমান আলী। ইউএনও অফিসে ঘুরেছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। ক্যাম্পের সামনে ৫ আগস্ট বিজিবির গুলিতে প্রাণ হারান নাহেদুলসহ তিনজন। অন্য দু’জন হলেন– অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সিয়াম আহমদ রাহিম (১৪) ও ব্যবসায়ী সুমন মিয়া (২৫)। তাদের নামও ওঠেনি শহীদের তালিকায়।সোনারহাট বিজিবি ক্যাম্পের সামনে বিজিবি সদস্যদের গুলিতে প্রাণ হারান সুমন। ছেলের মৃত্যুর পর প্রথমে ইউএনও, পরবর্তী সময়ে জেলা প্রশাসক, মন্ত্রণালয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়কের কাছে তালিকাবূক্তির আবেদন করেন তিনি। কিন্তু তারা আজও কোনো ব্যবস্থা নেননি।
গত বছরের ২০ আগস্ট যৌথ স্বাক্ষরিত প্রত্যয়নপত্রে বিজিবি সদস্যের গুলিতে সুমনের নিহতের বিষয়টি উল্লেখ করেন সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম রাব্বানী সুমন ও ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেন। এ ছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক মতিউর রহমান ৩০ সেপ্টেম্বর ইউএনওর কাছে একটি প্রতিবেদন দেন। তাতে রাহিম, নাহেদুল ও সুমন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। আহতদের মধ্যে রয়েছে, একই উপজেলার মৃত ইব্রাহিম আলীর দুই ছেলে বাহার উদ্দিন (২৩) মামুনুর রশীদ (১৯) তার উপজেলার উত্তরলাবু গ্রামের বাসিন্ধা। একই গ্রামের ইসরাঈল আলীর ছেলে ছালেহ আহমদ (২২) নোমান আহমদ। মৃত ইছহাক আলীর ছেলে সেবুল আহমদ (২২), পান্তুমাই, আহার কান্দিনজরুল ইসলামের ছেলে সুলতান আহমদ (২০), দক্ষিণ পান্তুমাই গ্রামের আনছার আলীর ছেলে ইদ্রিস আলী (২১), ভাদেশ্বর মুরামুরি খালের আব্দুর রহমানের ছেলে আনোয়ার হোসেন (২২) কিন্তু আজ তাদের নাম তালিভুক্তি হয়নি আগষ্টের তালিকায়। এনিয়ে আহতদের পরিবার বাধ্য হয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করলে সিলেট জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয় আহতের জুলাই আন্দোলনের আহতদের তালিকায় অন্তভূক্তির জন্য। কিন্তু জেলা প্রশাসক উচ্চ আদালতের কাজটি রিসিভ করলে ব্যবস্থা না নিয়ে জেলা সিভিল সার্জনের কাছে প্রেরণ করেছেন । কিন্তু কোন কারণ ছাড়াই উচ্চ আদালতের আদেশটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছেনা জেলা প্রশাসন ও সিভিল সার্জনের দপ্তর থেকে। এ বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহমুদ মুরাদ জানান, তিনি উচ্চ আদালতের আদেশ টি পেয়েছেন এবং সেটির বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা সিভিল সার্জনেকে নির্দেশ দিয়ে অফিশিয়াল আদেশ দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, কারা নিহত ও আহত হয়েছেন, সেটি নিয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। তারা যাচাই-বাছাই করে তালিকা দেয়, তালিকা থেকে কেউ বাদ পড়লে আবেদন করার সুযোগ আছে।
এ ব্যাপারে জুলাই আগষ্টে আহত বাহার উদ্দিন জানান, আমি যখন আহত হয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নিতে যাই তখন জেলা প্রশাসক থেকে আর্থিক সাহায্য পাই, পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন সহ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের অনেকে নানান ভাবে সহায়তা করেন। আমি এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছি । আমি আমার স্ত্রী সন্তান নিয়ে অনেক কষ্টে জীবন যাপন করতেছি। তিনি আরো বলেন, পরবর্তীতে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের পর যখন সারাদেশের মতো সিলেটসহ বিভিন্ন জেলা উপজেলায় আহত-নিহতদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হলে আমি আবেদন করি। পরে অনলাইনে আমার নাম আহতদের তালিকায় ছিল। কিন্তু এখন আমার নাম তালিকায় নাই। ফলে আমি ঠিক মতো চিকিৎসা পাচ্ছিনা। কারণ হাসপাতাল কতৃপক্ষ জানিয়েছে, অনলাইনে নাম না থাকলে তারা চিকিৎসা দিবেনা। যার ফলে সঠিক চিকিৎসার জন্য বারবার জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জন অফিসে দৌড়ঝাপ করছি।
এ ব্যাপারে জুলাই আগষ্টে আহত মামুনুর রশীদ জানান, আমি আহত হয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজে দীর্ঘ তিন মাস চিকিৎসা নেই উন্নত চিকিৎসার জন্য ওসমানী মেডিকেল থেকে সরকারি এম্বুলেন্স দিয়ে ঢাকা নিটর (ঘওঞঙজ) হাসপাতালে পাটানো হয় বর্তমানে আমি টাকা নিটর(NITOR) হাসপাতালের চিকিৎসাধীন আছি। সিলেটে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় সিলেটের জেলা প্রশাসক থেকে আর্থিক সাহায্য পাই, পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন সহ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের অনেকে নানান ভাবে সহায়তা করেন। পরবর্তীতে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের পর যখন সারাদেশের মতো সিলেটসহ বিভিন্ন জেলা উপজেলায় আহত-নিহতদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হলে আমি আবেদন করি। পরে অনলাইনে আমার নাম আহতদের তালিকায় ছিল। কিন্তু এখন দেখি আমার নাম তালিকায় নাই।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিলেট জেলার মুখ্য সংগঠক নাইম শেহজাদ বলেন, আমাদের যাচাই-বাছাই কমিটি এখনও কাজ করছে। গোয়াইনঘাটে আহত-নিহতদের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মেজয় দত্ত বলেন, জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিয়ে তালিকা করা হয়। গোয়াইনঘাটে আহত-নিহত তালিকভুক্তির জন্য পরিবার থেকে আবেদন করা হয়েছিলো। আমরা জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করতে বলেছি।
জুলাই আহত- নিহতদের নামের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করে কোন প্রতিকার না পেয়ে তারা বাধ্য হয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন।