প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য কোনো চিহ্ন পায় না টাংগুয়ার হাওরের পর্যটকগন
প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর থাকা মাদার ফিসারিজ খ্যাত রামসার সাইড টাংগুয়ার। হাওরে পর্যটক আসে হাওরের সুনাম শুনে। কিন্তু সেই সুনামের এর চিহ্ন এসে দেখতে না পাওয়া ও হাওর নিয়ন্ত্রণীন থাকায় দিন যতই যাচ্ছে ততই প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধংশ হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ফিরছেন আগত অনেক পর্যটকগন।
এছাড়াও নিয়ন্ত্রনহীন ভাবে হাউজবোড গুলো সংরক্ষিত এলাকায় চলাচলে হাওরের জীব বৈচিত্র্য, পরিবেশ ও হাওরে পাড়ের বাসিন্দাদের জীবন জীবিকা হুমকি মুখে পড়েছে। ফলে উদ্বেগ প্রকাশ করছে পরিবেশবিদগন।
অপর দিকে, টাংগুয়ার হাওর এখন নিয়ন্ত্রিতহীন ও ধংশ প্রাপ্ত একটি পর্যটন স্পষ্টের নাম হিসাবে পরিচিত পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাওর পাড়ে বাসিন্দা ও সচেতন মহল।
টাংগুয়ার হাওর পাড়ের বাসিন্দা সফিউল আলম জানান,হাওর উন্নয়নে যে বরাদ্দ দেয়া হয় হয়েছে তার এক আনাও কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরং ধংশ করা হয়েছে। আগে মাছ ধরতে পারতাম এখন মাছের দেখা নাই। মিঠাপানি মাছের বদলে পাঙ্গাশ মাছ খাইতে হয়। মাছের নিরাপদ আশ্রয় স্থল গুলোতে অবাধে পর্যটকের নৌকা গুরাফেরা করছে।
হাওর পাড়ে বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৬সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আইইউসিএন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকলেও হাওর সুরক্ষার বদলে পরিবেশ, প্রকৃতি, পাখি মাছ শূন্য করেছে,গাছ পালা ও উজার হয়েছে সংরক্ষিত বন অভিযোগ রয়েছে।
আরও জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে সরকার এই এলাকাকে বিপন্ন প্রতিবেশ এলাকা ও ২০০০ সালে ২০ জানুয়ারি ইউনেস্কো বিশ্বের ১০৩১টি রামসার সাইটের মধ্যে বাংলাদেশের টাংগুয়ার হাওর কে দ্বিতীয় রামসার সাইট ঘোষণা করে।পরে ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে হাওর কে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবার পর ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর জেলা প্রশাসন হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
সচেতন মহল বলছেন, হাউজবোড গুলো থেকে গত ৭ বছরে ধরে হাওরে শব্দ দূষন,পানিতে প্লাস্টিকের বোতল,চিপসসহ ডিজেল,বিভিন্ন ময়লা ফেলায় দূষিত হচ্ছে পানি। নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না পর্যটক পরিবহনকারী হাউজবোড ও নৌযান চালকরা ফলে আরও ধংশ হয়েছে হাওর। আর রাজধানী ঢাকা থেকে পর্যটন ব্যবসায়ীরা অর্থ লগ্নি করে তৈরি করেছে ৫ শতাধিক অত্যাধুনিক নামীদামী হোটেলের মতই বিলাশ বহুল হাউজবোর্ড তৈরী করেছে। তারাই অনলাইনে পেইজ খোলে পর্যটন স্পষ্টে যাওয়ার জন্য হাউজবোডে প্যাকেজ দিচ্ছে। ঐ টুর পরিচালনাকারী দল নিজেদের লাভের জন্য প্রশাসনের দেয়া কোনো নিয়মনীতি মানছে না। তারাই নানান ভাবে পর্যটকদের হাউজবোডে সব ধরনের সুবিধা দিয়ে আকর্ষণ বাড়িয়ে হাওরে আনছে। এতে তাদের লাভ হলেও স্থানীয় নৌযান চালকরা কোনো সুবিধা ভোগ করতে পারছেন না। অপর দিকে হাওর ধংশ করে দিচ্ছে। আর প্রশাসন নির্বিকার,কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।
হাওরপাড়ের বাসিন্দাগন বলেন, মেঘালয় পাহাড় ঘেঁষে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বেশীর ভাগ ও মধ্যনগর উপজেলার আংশিক অংশ নিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি টাংগুয়ার হাওরের অবস্থান। স্থানীয় লোকজনের কাছে এ হাওর নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে ৯,৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে হাওরটি জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। পানি বহুল মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার,বাকি অংশ কৃষিজমি ও ৬৮টি গ্রামের মানুষের বসবাস। আমাদের কোনো উন্নয়ন হয়নি বরং দিন দিন ক্ষতির শিকার হচ্ছি।
সরজমিনে টাংগুয়ার হাওর গুড়ে দেখা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় গিয়ে নৌকাগুলো করচ গাছে বেঁধে রাখা হয়। ফলে এই এলাকায় থাকা শতাধিক হিজল করচ গাছের ডাল-পালাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাওরের সংরক্ষিত এলাকার বিভিন্ন অংশে ঘুরছেন নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে হাউজবোড। আর তাদের থাকা খাওয়া ও ব্যবহৃত পানির বোতল, প্লাস্টিকের পন্য আর আগত পর্যটকদের মল,মুত্র পানিতে ফেলছে,নৌকার কালো ধৌয়া ও কেরসিন মবিল পানিতে পরে নষ্ট হচ্ছে পানি দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। উচ্চ শব্দে সাউণ্ড বক্সে গান বাজচ্ছে। ওয়াচ টাওয়ার এলাকার শব্দে কম্পিত হচ্ছে।
তাহিরপুর নৌ পর্যটন শিল্প সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ রব্বানী সহ বিভিন্ন হাউজবোডের সাথে কথা বললে তাদের দাবী তারা কোনো অনিয়ম করছেন না। নিয়ম মেনেই পর্যটক পরিবহন করছে। আমরা স্থানীয়রা নিয়মনীতি অনুসরণ করে চলাচল করলেও বাহিরের নৌকা ও হাউজবোড গুলো নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে হাওরে চলাচল ও বিভিন্ন প্লাস্টিকের পন্য পানিতে ফেলছেন। এর দার ভার আমাদের নিতে হচ্ছে।
ঢাকা থেকে আগত পর্যটক মোহাম্মদ রেজাউল আহমেদ জানান, টাংগুয়ার হাওর দেখে ভাল লাগলেও পর্যটকদের নেই নিরাপত্তা কোনো ব্যবস্থা। উচ্চ শব্দে সাউন্ড বক্সে গান বাজানো হচ্ছে যা বিরক্তকর। রিফ্রেশমেন্টের জন্য এসে অস্বীকর পরিবেশের মধ্যে আছি। আগের হাওর কিছুই নেই। আর হাওরে আগতরা সরকারী কোনো নীতিমালাই মানছে না, এখনিই সময় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার। না হলে টাংগুয়ার হাওর ধংশ হয়েছে আর যে টকু আছে তাও শেষ হয়ে যাবে। এছাড়াও হাওরে এসে অনেক পর্যটক হাউজ বোড ও নৌকা বেড়াতে এসে নানান ভাবে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছে। সব মিলিয়ে হাওর ও পরিবেশ,জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবী জানাই। না হলে পর্যটকদের আগম কমে আসবে।
জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা আরিফ মিয়া জানান, পর্যটকদের নিয়মনীতিহীন কর্মকাণ্ডের কারনে আমাদের বসবাস করাই দায় হয়ে গেছে। তারা হাউজবোড ও নৌকায় করে হাওরে এসে পোষাক আশাক চলাফেরা আমাদের সামাজিক রীতিনীতি অবক্ষয়ের কারন হয়ে দাড়িয়েছে। হাউজ বোড গুলো নিয়ন্ত্রিতহীন ভাবে সংরক্ষিত এলাকায় চলা ফেরা করছে। টয়লেটের ময়লাসহ বিভিন্ন ময়লা হাওরের পানিতেই ফলছে। আমরা হাওর পাড়ে গ্রামের মানুষ আছি চরম দুর্ভোগের মধ্যে নানান পানি বাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছি।
হাওর ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন সাইফুল ইসলাম তিনি জানান, নিয়মনীতিহীন কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হাওর পাড়ের বাসিন্দাগন। সেই সাথে হুমকির মুখে পড়েছে হাওরের প্রকৃতি,পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। কারন নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে টাংগুয়ার হাওরে সর্বত্র বিচরন করছে পর্যটক পরিবহনকারী নৌকা ও হাউজ বোড গুলো। দায়িত্বশীল কতৃপক্ষ হাওর পাড়ে বাসিন্দা ও হাওর রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে না হয় যেটুকু ধংশ হবার বাকী আছে তাও শেষ হবে।
তাহিরপুর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি দেলোয়ার হোসেন জানান, আমরা সকল পর্যটককে ও হাউজবোড গুলোকে নিয়মনীতি মেনে চলার জন্য বার বার বার বলছি। টুরিস্ট পুলিশ কাজ করছে। ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকদের আগমন বেড়ে যার। আমাদের পক্ষ থেকে নজরদারি বাড়ানোর হয়েছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ডাঃ মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া জানিয়েছেন, হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে পরিকল্পিত পর্যটন করা সম্ভব হবে। তার জন্য আগত পর্যটক ও সকল নৌযানকে নীতিমালা অনুসারে চলাচল করতে হবে। হাওরের ক্ষতি হয় এমন কাজ কাউকেই করতে দেয়া হবে না। আমাদের পক্ষ থেকে প্রয়োজনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।