পরকালে সর্বপ্রথম যাদের বিচার হবে
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তির আশায় মানুষ ইবাদত-বন্দেগি, দান-খয়রাত ও দ্বীনি জ্ঞানার্জনে আত্মনিয়োগ করে থাকে। এসব মহান আমল ইসলামে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে গণ্য। শহীদ হওয়া, ইলম অর্জন ও প্রচার, কোরআন তেলাওয়াত এবং দানশীলতা এসব এমন শ্রেষ্ঠ ইবাদত, যেগুলো মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয় সহজেই। কিন্তু আমলের বাহ্যিক রূপ যতটা দৃষ্টিনন্দনই হোক না কেন, আল্লাহর দরবারে তার গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র মানদণ্ড হলো খাঁটি নিয়ত।
ইসলাম ইখলাস বা একনিষ্ঠতার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য না হলে কোনো আমলই তার দরবারে কবুল হয় না। মানুষকে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব, কিন্তু আল্লাহতায়ালাকে নয়। মানুষ বাহ্যিক আমল দেখে মুগ্ধ হতে পারে, প্রশংসা করতে পারে, কিন্তু সেসব আমলের পেছনে অন্তর্নিহিত অভিপ্রায় কেবল আল্লাহই জানেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সব কাজই নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (সহিহ বুখারি)
এই পরিপ্রেক্ষিতেই সহিহ মুসলিমে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিস আমাদের সামনে এক ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরে, যেখানে এমন তিন ব্যক্তি, যারা সমাজে পণ্ডিত বা দানবীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন, কেয়ামতের দিন প্রথমে তাদের বিচার হবে এবং তাদের মিথ্যা নিয়তের কারণে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এ হাদিস মানুষের আত্মোপলব্ধি, আত্মসমালোচনা এবং আমলের পেছনে অন্তরের বিশুদ্ধতা যাচাই করার জন্য এক গভীর আহ্বান।
পরকালে সর্বপ্রথম যাদের বিচার হবে সেই বিষয়ে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কেয়ামতের দিন প্রথম যার বিচার হবে, সে একজন শহীদ। তাকে আল্লাহর দরবারে হাজির করা হবে। আল্লাহ তাকে তার দেওয়া নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সে তা স্মরণ করবে। এরপর আল্লাহ বলবেন, ওই নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কী আমল করে এসেছ? সে বলবে, আমি আপনার সন্তুষ্টির জন্য জিহাদ করে শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি আসলে এজন্য জিহাদ করেছ, যাতে লোকেরা তোমাকে বলে, অমুক একজন বীর পুরুষ। তাই বলা হয়েছে। এরপর ফেরেশতাদের আদেশ করা হবে, আর তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে জাহান্নামে ছুড়ে দেওয়া হবে।
দ্বিতীয় লোক সে, যে ইলম শিক্ষা করেছে, অন্যকে শিখিয়েছে এবং কোরআন পড়েছে। তাকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হবে। আল্লাহ তাকে (পৃথিবীতে দেওয়া) তার সব নেয়ামতের কথা মনে করিয়ে দেবেন। সে সবকিছু মনে করবে। এরপর আল্লাহ বলবেন, এসব নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কী আমল করে এসেছ? সে বলবে, আমি ইলম শিখেছি, অন্যকে শিখিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য কোরআন পড়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি আসলে এ উদ্দেশ্যে ইলম শিখেছ, যাতে লোকেরা তোমাকে আলেম বলে, এ উদ্দেশ্যে কোরআন পড়েছ, যাতে লোকেরা তোমাকে কারি বলে। আর (দুনিয়াতে) তা বলা হয়েছে। এরপর ফেরেশতাদের আদেশ দেওয়া হবে, আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
তৃতীয় লোকটি হলেন তিনি, যার রুজিকে আল্লাহ প্রশস্ত করেছিলেন এবং সব ধরনের সম্পদ দিয়েছিলেন। তাকে আল্লাহর দরবারে হাজির করা হবে। আল্লাহ তাকে তার দেওয়া সব নেয়ামতের কথা মনে করিয়ে দেবেন। সে সবকিছু মনে করবে। এরপর আল্লাহ প্রশ্ন করবেন, তুমি ওই সব নেয়ামতের বিনিময়ে কী আমল করে এসেছ? সে বলবে, যেসব রাস্তায় দান করলে আপনি খুশি হন, সেসব রাস্তার মধ্যে কোনোটিতে আপনার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে খরচ করতে ছাড়িনি। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি আসলে এ কারণে দান করছিলে, যাতে লোকে তোমাকে দানবীর বলে। আর তা বলা হয়েছে। এরপর ফেরেশতাদের হুকুম করা হবে এবং তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহিহ মুসলিম)
এই হাদিসের শিক্ষা অত্যন্ত গভীর ও হৃদয়বিদারক। এটি আমাদের জানিয়ে দেয় যে, দুনিয়াবি খ্যাতি, প্রশংসা বা লোকদেখানো আমল দিয়ে কখনো পরকালের মুক্তি পাওয়া যাবে না।