ঐতিহ্য, জ্ঞানচর্চা ও গৌরবের ১৩৪ বছরে মুরারিচাঁদ কলেজ
বাংলাদেশের শিক্ষাজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ ১৩৪ তম বছরে পদার্পণ করছে। ১৮৯২ সালের এই দিনে অবিভক্ত ভারতের সিলেট অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত এই মহাবিদ্যালয় দীর্ঘ ১৩৩ বছর ধরে জ্ঞান বিতরণের আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে আসছে এবং অসংখ্য গুণী, মেধাবী ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করেছে, যারা দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে স্বীয় কর্মক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন। এম সি কলেজের এই ১৩৪ বছরে পদার্পণ কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বয়স বৃদ্ধি নয়, এটি একটি জাতির মেধা, মনন ও সাংস্কৃতিক বিকাশের অবিস্মরণীয় ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি।
মুরারিচাঁদ কলেজের গোড়াপত্তন হয়েছিল এক দূরদর্শী স্বপ্নের হাত ধরে। ১৮৯২ সালের ২৭ জুন সিলেটের প্রখ্যাত জমিদার রাজা গিরিশচন্দ্র রায় তার পিতামহ মুরারিচাঁদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য এবং পিছিয়ে পড়া সিলেট অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার মহৎ উদ্দেশ্যে এই শিক্ষালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে এটি একটি চতুষ্পাঠী বা টোল হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও, অচিরেই এর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় এবং এটি একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। শিক্ষার প্রতি রাজা গিরিশচন্দ্রের গভীর অনুরাগ এবং অদম্য ইচ্ছাই এই প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপন করে। পরবর্তীতে, ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এটি পূর্ণাঙ্গ কলেজে উন্নীত হয়, যা সিলেটের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। সেই সময় এর নামকরণ করা হয় ‘মুরারিচাঁদ কলেজ’ বা সংক্ষেপে ‘এমসি কলেজ’ নামে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে শিক্ষাবিস্তারের এই প্রচেষ্টা ছিল ব্যতিক্রমী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি কেবল সিলেট নয়, বৃহত্তর আসাম ও পূর্ববঙ্গের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। এর দীর্ঘ ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলনের সাথে এই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল, যা এর বিপ্লবী ঐতিহ্যের প্রমাণ বহন করে।
এমসি কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা সবসময়ই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত হয়েছে। বর্তমানে এই কলেজে ১৬টি ভিন্ন বিষয় রয়েছে, যার মধ্যে ১৫টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৬ টি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য, সমাজবিজ্ঞান- সকল শাখাতেই কলেজটি তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। এখানে প্রায় ১৪ হাজারেরও বেশি নিয়মিত শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে, যা এটিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। ১০৭ জন অত্যন্ত অভিজ্ঞ, নিবেদিতপ্রাণ এবং উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক-শিক্ষিকা এখানে কর্মরত রয়েছেন, যারা শিক্ষার্থীদেরকে শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষিত করেন না, বরং তাদের মধ্যে প্রজ্ঞা, মুক্তচিন্তা এবং মানবিক মূল্যবোধের বীজ রোপণ করেন। কলেজের গ্রন্থাগারটি ২৭ হাজার ৯১২ হাজারেরও অধিক মূল্যবান বই, জার্নাল ও গবেষণাপত্র দিয়ে সমৃদ্ধ, যা শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চার এক বিশাল সুযোগ করে দেয়।
এমসি কলেজের ক্যাম্পাস শুধু একটি শিক্ষাঙ্গন নয়, এটি নিজেই এক জীবন্ত ইতিহাস। এর সুবিশাল, নৈসর্গিক ও সবুজ শ্যামল ক্যাম্পাসটি প্রায় ১২৪ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত, যা এটিকে দেশের বৃহত্তম কলেজ ক্যাম্পাসগুলোর অন্যতম করে তুলেছে। কলেজের প্রাচীন ভবনগুলো, বিশেষ করে দৃষ্টিনন্দন মূল ভবনটি, ঔপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলীর এক চমৎকার নিদর্শন। এর প্রতিটি ইঁট যেন শত বছরের ইতিহাস আর অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীর পদচারণার সাক্ষ্য বহন করে। ক্যাম্পাসে রয়েছে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন শ্রেণীকক্ষ, সুসজ্জিত বিজ্ঞানাগার, একটি সুবিশাল কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার যা শিক্ষার্থীদের জন্য জ্ঞানার্জনের এক অফুরন্ত উৎস। এছাড়া, একটি সমৃদ্ধ উদ্ভিদ উদ্যান (বোটানিক্যাল গার্ডেন), মসজিদ, টেনিস কোর্ট এবং একটি সুপরিসর অডিটোরিয়াম এর অবকাঠামোগত সমৃদ্ধির পরিচায়ক। কলেজের ছাত্রাবাসগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করে। ক্যাম্পাসের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, সারি সারি গাছপালা এবং পাখির কিচিরমিচির শব্দ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য এক শান্ত ও মনোমুগ্ধকর আবহ তৈরি করে। এটি কেবল একটি ক্যাম্পাস নয়, এটি প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মিলনমেলা, যা শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করে।
এম সি কলেজ শুধু একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নয়, সহশিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের জন্যও বিশেষভাবে পরিচিত। এই কলেজের শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও নেতৃত্ব বিকাশের জন্য এখানে অসংখ্য ক্লাব ও সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। রোভার স্কাউট, বিএনসিসি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর), এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি, মোহনা, থিয়েটার, বিতর্ক ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাব, কবিতা পরিষদ সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন এখানে বছরজুড়ে নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে। বার্ষিক বিজ্ঞান মেলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং রক্তদান কর্মসূচির মতো আয়োজনগুলো শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটায় এবং তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। এই কলেজ প্রাঙ্গণেই দেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের চিন্তার আদান-প্রদান করেছেন, যা এখানকার সাংস্কৃতিক পরিবেশকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এম সি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নয়, বরং তাদের সৃজনশীলতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মাধ্যমেও দেশ ও সমাজে অবদান রেখেছেন।
এমসি কলেজ অসংখ্য কৃতি সন্তানের জন্ম দিয়েছে, যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এই কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের তালিকা অত্যন্ত দীর্ঘ এবং গৌরবোজ্জ্বল। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে, শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, প্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং সামরিক বাহিনীতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের অবদান কেবল এমসি কলেজের গৌরব বৃদ্ধি করেনি, বরং সমগ্র জাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বাংলাদেশের মেধা ও মননের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
আজ ২৭ জুন এম সি কলেজের ১৩৪ তম বছরে পদার্পণ এক বিশাল তাৎপর্য বহন করে। এটি কেবল একটি সংখ্যার হিসাব নয়, এটি একটি দীর্ঘ যাত্রার স্মারক, যেখানে অগণিত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারী এবং শুভানুধ্যায়ীর শ্রম, মেধা ও ভালোবাসা মিশে আছে। প্রতিষ্ঠাকালীন দিক দিয়ে নবম স্থান দখল করা এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলো ছড়িয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এমসি কলেজ নিরন্তর গবেষণা, উদ্ভাবন এবং মানসম্মত শিক্ষাদানের মাধ্যমে একুশ শতকের উপযোগী নাগরিক তৈরিতে বদ্ধপরিকর। এটি শুধু সিলেট অঞ্চলের নয়, সমগ্র বাংলাদেশের জন্য একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে তার গুরুত্ব ধরে রেখেছে।
মুরারিচাঁদ কলেজ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার এক জীবন্ত কিংবদন্তি। এর ১৩৪ বছরে পদার্পণ এক অবিচ্ছিন্ন সাফল্য, গৌরব ও ঐতিহ্যের গল্প। এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু ডিগ্রি বিতরণকারী একটি কেন্দ্র নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক আলোকবর্তিকা, একটি জ্ঞানপীঠ এবং নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন বুননের এক সুবর্ণ ক্ষেত্র। এমসি কলেজের এই দীর্ঘ এবং বর্ণাঢ্য ইতিহাস সকলকে মনে করিয়ে দেয় যে, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার এই মহৎ কাজটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অব্যাহত থাকবে এবং এই কলেজ ভবিষ্যতেও দেশের সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে এক উজ্জ্বল বাতিঘর হিসেবে দ্যুতি ছড়াবে।