সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হোক হজের শিক্ষা
মাত্র কয়েক দিন আগেই শেষ হলো আল্লাহ প্রেমের মিলন মেলা হজের আনুষ্ঠানিকতা। যা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য প্রতি বছর ঐক্য, শৃংখ্যলা আর ভ্রাতৃত্ববোধের সবক শিখিয়ে যায়। কেননা হজ শুধু একটি আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় রীতি নয়, বরং এটি একটি সর্বব্যাপী প্রশিক্ষণ। যেটি আত্মগঠন, সমাজগঠন ও রাষ্ট্রগঠনের মতো সর্বব্যাপী পথ আমাদের জন্য উন্মোচন করে।
হজের প্রত্যেকটি আনুষ্ঠানিকতা যেমনই বাহ্যিক মনে হোক না কেন, তা ভিতরে ভিতরে এক একটি মূল্যবোধের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি।
এই মূল্যবোধগুলো আজকের জাতিগত দুর্বিপাক ও আদর্শগত সংকটের দিনে আমাদের জাতীয় চরিত্র গঠনের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে।
তাওহীদের ভিত্তিতে ঐক্য: ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’— এই আহ্বানের শিক্ষা
হজের মৌলিক শিক্ষা হলো তাওহীদ তথা একত্ববাদ। লক্ষ লক্ষ মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত “لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ” (তোমার দরবারে হাজির হে আল্লাহ!) এই আহ্বান কেবল ব্যক্তি নয়, জাতির হৃদয়কেও এক কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে শেখায়।
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
‘বল, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু — সবই আল্লাহর জন্য, যিনি সকল জগতের পালনকর্তা।’ (সুরা আন’আম, আয়াত: ১৬২)
জাতি যখন এই ঐক্যবোধ হারিয়ে কখনো জাত, কখনো দল, কখনো ভাষা, কখনো শ্রেণীর নামে বিভক্তিতে জর্জরিত হয়। তখন হজ এসে স্মরণ করিয়ে দেয়, “তোমরা সকলেই এক উম্মত, তোমাদের রব এক, তোমাদের কিবলা এক”।
আত্মত্যাগ ও ত্যাগের সংস্কৃতি
হজ মানে ত্যাগ। ইহরাম বস্ত্র পরা মানে ব্যক্তির সমস্ত পরিচিতি, বিত্ত-বৈভব, সামাজিক মর্যাদা ও পার্থিব ব্যাবধান ভুলে গিয়ে নিজের প্রকৃত অবস্থানকে আল্লাহর সামনে তুলে ধরা।
হজে ত্যাগের চূড়ান্ত প্রকাশ হলো কুরবানির মাধ্যমে। কিন্তু এই কুরবানি কেবল পশু জবাই নয়, বরং—
لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ
‘আল্লাহর নিকট তাদের গোশত ও রক্ত পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে।’ (সূরা হজ্ব, আয়াত: ৩৭)
আমাদের জাতীয় জীবনে আত্মত্যাগের এই শিক্ষা অনুপস্থিত। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ভারসাম্য ভেঙে পড়ছে।হজ শেখায়, নিজের ‘আমি’কে কোরবানি করে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে একাত্ম হও।
শৃঙ্খলা ও নিয়ম-নীতির আদর্শ
হজের লক্ষ লক্ষ হাজী যেভাবে সময়, স্থান ও পোশাকের নির্দিষ্ট নিয়মে অনড় থেকে তাওয়াফ, সাঈ, আরাফা, মিনা, মুযদালিফা ইত্যাদি পালন করেন—তা বিশ্বে শৃঙ্খলার এক অনুপম দৃষ্টান্ত।
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُم بُنيَانٌ مَّرْصُوصٌ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালবাসেন তাদের, যারা তাঁর পথে সংগ্রাম করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেন এক সুনির্মিত প্রাচীর।” (সূরা আস-সফ ৬১:৪)
আমাদের জাতীয় জীবনে এই শৃঙ্খলা, নিয়ম ও কর্তব্যনিষ্ঠার চর্চা থাকলে দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, দায়িত্বহীনতা ও নৈরাজ্য দূর হতো। কিন্তু এই মূল্যবোধগুলোর অনুপস্থিতিই আমাদের অসংখ্য বেদনাদায়ক ঘটনার কারণ।
মানবিক সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ
হজের জমায়েত একটি বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্বের রূপ। কোনো রঙ, জাতি, ভাষা বা পেশার ভেদ নেই। এ এক বাস্তব জাতিসংঘ—যেখানে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সমতা দেখা যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেন:
“لا فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى أَعْجَمِيٍّ، وَلَا لِأَعْجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ، وَلَا لِأَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ، وَلَا لِأَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ، إِلَّا بِالتَّقْوَى”
‘একজন আরবের ওপর অনারবের, অনারবের ওপর আরবের, শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষাঙ্গের, কৃষাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই; শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২২৯৭৮)
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যখন আমরা আঞ্চলিকতা, দলীয় বিভাজন, শ্রেণীসংঘাত ও বৈষম্যে জর্জরিত, তখন হজ আমাদের শিখায়: একটি জাতি তখনই উন্নতি করে, যখন তারা পরস্পরকে ভাই ভাবে, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।
হজ থেকে ফিরে আসা মানে আত্মিক পরিশুদ্ধি, চিন্তায় বিশুদ্ধতা, এবং সমাজে দায়িত্বশীলতা অর্জন। রাষ্ট্র যদি চায় সৎ, চরিত্রবান, কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক—তবে হজের শিক্ষা শুধু হাজীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে জাতীয় জীবনেও প্রতিফলিত করতে হবে।
সুতরাং হজ একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি বিপ্লব; একটি আত্মসংযম ও সামাজিক ন্যায়ের বিপ্লব। রাষ্ট্র যদি হজের শিক্ষা থেকে নেতৃত্ব তৈরি করে, আর নাগরিক যদি হজের অনুশীলন দ্বারা চরিত্র নির্মাণ করে—তবে এই জাতির পূণর্জাগরণ কেউ ঠেকাতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ।