বিশ্বের বড় যে ১০ দুর্গ এখনো স্বমহিমায় টিকে আছে

শত্রুর আক্রমণ থেকে শহরকে সুরক্ষা দিতে এবং আক্রমণ প্রতিহত করতে মধ্যযুগ বা তারও আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় বড় দুর্গ তৈরি করা হয়েছে। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় এ রকম অনেক দুর্গ রয়েছে। দুর্গগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এগুলো থেকে ইতিহাস–ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারছে। শিক্ষামূলক সাইট ডিসকভারি বিশ্বের বৃহত্তম দুর্গের একটি তালিকা করেছে। তালিকায় অনুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দুর্গ সম্পর্কে তুলে ধরা হলো।

১। মালবর্ক দুর্গ

পোল্যান্ডের মালবর্কে ১৩ শতকে নির্মিত এই দুর্গ প্রায় ৫২ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। জার্মান ক্যাথলিক ধর্মীয় ক্রুসেডারদের সংগঠন টিউটনিক নাইটস এ দুর্গ নির্মাণ করেছে। উত্তর পোল্যান্ডের নোগাত নদীর তীরে অবস্থিত মালবর্ক দুর্গটি আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম দুর্গ। এর নির্মাণের সময় পাথরের পরিবর্তে স্থানীয় লাল ইট ব্যবহার করা হয়েছিল।এটি ছিল ইউরোপের সর্ববৃহৎ সুরক্ষিত গথিক স্থাপনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্গটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তবে পরে এর অধিকাংশই পুনর্নির্মাণ করা হয়। ১৯৯৭ সালে ইউনেসকো এটিকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

২। মেহরানগড় দুর্গ

ভারতের রাজস্থান রাজ্যের যোধপুরে ১৫ শতকে প্রায় ২০ একর জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছিল মেহরানগড় দুর্গ। সমতল থেকে ১২২ মিটার উঁচু ভাকুরচিরিয়া পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত দুর্গটি। এটি পাখির পাহাড় নামেও পরিচিত। খ্যাতনামা সেনানায়ক রাও যোধা রাঠোর এই দুর্গ নির্মাণ করেন। বিশ্বের বৃহত্তম দুর্গগুলোর একটি এবং সম্ভবত সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন এই দুর্গকে ‘দানবদের কাজ’ বলে বর্ণনা করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিং।দুর্গে সাতটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। প্রতিটি ফটকই ভিন্ন ভিন্ন শাসক নির্মাণ করেছিলেন। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর সেটি হলো, দীর্ঘ ইতিহাসে এটি কোনো দিন শত্রুর হাতে যায়নি।

৩। প্রাগ দুর্গ

চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগে ৯ শতকে প্রায় ১৭ দশমিক ২ একর জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছিল প্রাগ দুর্গ। প্রাগ দুর্গকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাচীন দুর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বে এখনো যেসব দুর্গ টিকে আছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি বৃহত্তম দুর্গ এটি। ৮৭০ সালে প্রথম দুর্গের প্রাচীরঘেরা স্থাপনাটি নির্মিত হয়। বছরের পর বছর ধরে রোমান সম্রাট ও বোহেমিয়ার রাজাদের দখলে ছিল। বর্তমানে এটি চেক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দুর্গের ভেতরে গথিক, বারুক ও রোমানেস্ক স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য সমাহার রয়েছে। বোহেমিয়ান রাজমুকুটের রত্নভান্ডার এখানে সংরক্ষিত। যার মধ্যে সেন্ট ভেনসেসেলাসের মুকুটও রয়েছে। এসব অমূল্য রতন দুর্গের গভীরে একটি গোপন কক্ষে রাখা হয়েছে।

৪। হোয়েনসালবার্গ দুর্গ

অস্ট্রিয়ার সালজবার্গ ১১ শতকে ১৩ দশমিক ৫ একর জায়গার ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম দুর্গ হোয়েনসালবার্গ। ইউরোপের সবচেয়ে সংরক্ষিত মধ্যযুগীয় দুর্গ এটি। ১০৭৭ সালে গেবহার্ড ফন হেলফেনস্টাইন থেকে শুরু করে শহরের আর্চবিশপদের উদ্যোগে এটি নির্মিত হয়। এটির বিশেষত্ব হলো, হাজার বছরের ইতিহাসে শত্রুবাহিনী কখনো দুর্গটি দখল করতে পারেনি। ১৫২৫ সালের জার্মান কৃষক বিদ্রোহে অবরোধের মুখে পড়েছিল এই দুর্গ। তবে দুর্গের পতন হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালীয় যুদ্ধবন্দীদের কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল দুর্গটি।

৫। উইন্ডসর দুর্গ

যুক্তরাজ্যের বার্কশায়ারে ১১ শতকে প্রায় ১৩ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত হয়েছিল উইন্ডসর দুর্গ। প্রায় এক হাজার বছর আগে রাজা উইলিয়াম উইন্ডসর দুর্গটি নির্মাণ করেন। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ দুর্গ এটি।মূলত একটি ক্ল্যাসিক মট অ্যান্ড বেইলি দুর্গ হিসেবে এটি নির্মাণ করা হয়। প্রথম হেনরির শাসনামল (১১০০-১১৩৫) থেকে দুর্গটি ব্যবহার করা হচ্ছে। সপ্তাহান্তে বিশ্রামের জন্য রানির প্রিয় একটি জায়গা ছিল এটি। এ ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ভবনগুলোর মধ্যে একটি এটি।

৬। স্পিশ দুর্গ

স্লোভাকিয়ার পূর্বাঞ্চলে ১২ শতকে প্রায় ১২ একর জায়গার ওপর নির্মাণ করা হয় স্পিশ দুর্গ।স্লোভাকিয়ার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত স্পিশ দুর্গ মধ্য ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম দুর্গ কমপ্লেক্স। বিশাল পাথরের প্রাচীর ও বিস্তৃত ধ্বংসাবশেষ ঘিরে গড়ে ওঠা এই দুর্গকে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া দিয়েছে। একসময় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল এটি। বিভিন্ন রাজা ও অভিজাত পরিবার একসময় দুর্গটির মালিক ছিল। বর্তমানে স্লোভাকিয়া সরকারের মালিকানাধীন এই দুর্গ ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম দুর্গ হিসেবে আজও পর্যটকদের কাছে একটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান।

৭। বুদা দুর্গ

হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ১৩ শতকে নির্মিত বুদা দুর্গের আয়তন প্রায় ১১ একর। বুদা অঞ্চলে দানিউব নদীর তীরে বুদা দুর্গ অবস্থিত। মোঙ্গলদের আক্রমণ থেকে শহর রক্ষার জন্য ১২৬০–এর দশকে দুর্গটি নির্মাণ করা হয়। অনন্যসুন্দর এই দুর্গের কাজ শেষ হয় ১৮ শতকের মাঝামাঝি। এটি বিশ্বের বৃহত্তম দুর্গগুলোর একটি। দুর্গটির দীর্ঘ ও নির্মম ইতিহাস রয়েছে। এটি ৩০ বারের বেশি অবরোধ করা হয়েছে। বর্তমানে দুর্গটি হাঙ্গেরির শিল্প জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

৮। হিমেজি দুর্গ

জাপানে চৌদ্দ থেকে ১৭ শতকে প্রায় ১০ দশমিক ২ একর জায়গার ওপর হিমেজি দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল। জাপানের সাবেক রাজধানী কিয়োটোর কাছে হিমেজি দুর্গ অবস্থিত। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ১৭ শতকের শুরুর দিকের দুর্গটিকে স্থাপত্যের সর্বোত্তম উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করেছে। সৌন্দর্য ও উড়ন্ত পাখির মতো আকৃতির কারণে দুর্গটি শিরাসাগি জো বা সাদা বকের দুর্গ নামেও পরিচিত। বিশ্বের বৃহত্তম দুর্গগুলোর একটি এটি। প্রতিরক্ষা প্রাচীর ও দুটি খাল দিয়ে দুর্গের ৮৩টি ভবন ঘিরে রাখা হয়েছে। এটি জাপানের সবচেয়ে বড় সামুরাই কেল্লা।

৯। আলেপ্পো দুর্গ

সিরিয়ার আলেপ্পোতে বারো ও ১৩ শতকে প্রায় ১০ একর জায়গার ওপর আলেপ্পো দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল। বিশ্বের বৃহত্তম দুর্গগুলোর একটি আলেপ্পো দুর্গ। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এ দুর্গ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন দুর্গ। অবিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করা শহরগুলো রক্ষা করার জন্য নির্মিত হয়েছিল। চুনাপাথরের একটি পাহাড়ের ওপর দুর্গটি নির্মাণ করা হয়েছে। সমতল থেকে প্রায় ৪০ মিটার উঁচুতে দুর্গ অবস্থিত। মূল কাঠামোগুলো মধ্যযুগীয় ইসলামি সামরিক স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য বহন করে। অধিকাংশই আইউবি শাসকেরা নির্মাণ করেন। হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন সভ্যতার কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে দুর্গটি ব্যবহার করা হয়েছে। আর্মেনিয়ান, বাইজেন্টাইন, গ্রিক, আইউবি, মামলুক ও অটোমানরা দুর্গটি ব্যবহার করেছে।

১০। এডিনবরা দুর্গ

স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় ১১ শতকে নির্মিত দুর্গটির আয়তন ৮ দশমিক ৮ একর। স্কটল্যান্ডের রাজধানীতে অবস্থিত আকাশচুম্বী এডিনবরা দুর্গ বিশ্বের বৃহত্তম দুর্গগুলোর মধ্যে একটি। ইউরোপের প্রাচীনতম সুরক্ষিত দুর্গের মধ্যে এটি অন্যতম। দুর্গটি ১১ শতকে নির্মাণ করা হয়। রাজা প্রথম ডেভিড ১১৩০ সালে দুর্গটিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন। দুর্গটিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজকীয় বাসভবন, কারাগার ও সেনাব্যারাক। দুর্গটি স্কটল্যান্ডের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পর্যটকেরা স্কটল্যান্ডের রাজধানীতে গেলে এডিনবরা দুর্গ দেখা মিস করেন না। বিভিন্ন উৎসবের সময় দুর্গের সামনে আতশবাজিসহ নানা আয়োজন করা হয়। পর্যটকেরা মধ্যযুগীয় রাজপরিবারের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও খাবার খাওয়ার সুযোগ পান।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন