কারো চরিত্রহনন করা নিজের ব্যক্তিত্বহননেরই সমানুপাতিক। ব্যক্তিগত শত্রুতা, সহকর্মীদের মাঝে অসুস্থ প্রতিযোগিতা কিংবা রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় এক পক্ষ অন্য পক্ষকে আঘাত করার জন্য চরিত্রহননকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে—এ আমাদের সমাজের নিত্যকার চিত্র। অথচ এর চেয়ে ঘৃণিত, জঘন্য ও নগণ্য কাজ আর কিছু হতে পারে না। কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রকাশ করা, দুর্বলতায় খোঁচা দিয়ে বিতর্ক জিইয়ে রাখা কিংবা স্বার্থসিদ্ধির প্রতিযোগিতায়, তাকে আক্রমণ করা—এসব অসুস্থ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। তবুও ঘুণধরা সমাজে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করার জন্য তার ব্যক্তিগত চরিত্রকেই সমাজ ও রাষ্ট্রীয় আলোচনার মশলা বানানো হয়।
নারীঘটিত প্রসঙ্গ রাজনীতিতে রঙ মেখে হাজির হওয়ার চালচিত্র আজও চলমান। পরিবারের ঝড়ঝাপটা টেনে এনে কর্মক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে নাকানিচুবানি দেওয়ার বদঅভ্যাস বহু পুরোনো অস্ত্র। কারো অতীত টেনে এনে তার বর্তমানকে রুদ্ধ করার এই প্রবণতা কি কখনো সুস্থ ফল বয়ে আনে? না, বরং এটি থার্ড ক্লাস মানসিকতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। গোয়ার শ্রেণীর মানুষ যুক্তিতে হেরে গেলে কিংবা কৌশলে ধরা খেলে শেষ খোঁচাটা দেয় প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত জীবনে। ব্যক্তিগত আক্রমণ করে পথ রোধ করার মতো ছোটলোকি জগৎ-জীবনে দ্বিতীয় আর কিছু নেই। মানুষের আদিম হিংস্রতা এখানে স্বার্থপরতার ছদ্মবেশে প্রকাশিত হয়।
প্রায়শই দেখা যায়, আলোচনার বিষয় দু’জনের হলেও টেনে আনা হয় বাবা-মা; অকারণে গালাগালি করা হয় অতীতকে। এ ধরনের বুনো স্বভাব মানুষকে পশুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে আনে। অতীতের ঘাটাঘাটি অনেকের আত্মরূপান্তরকে বাধাগ্রস্ত করে। ব্যক্তিজীবনের সংকটগুলোকে জাতীয় সমস্যারূপে প্রতিষ্ঠা করার অপপ্রয়াস মানুষকে তার নিজস্ব মর্যাদার স্তর থেকে বিচ্যুত করে। যখন দানবীয়তা মনে ভর করে, হিংস্রতা আচরণে প্রকাশ পায় কিংবা মিথ্যাচার জিহ্বা দখল করে নেয়, তখন সেই মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাতের তবকায় রাখা যায় না। উত্তম-অধমের পার্থক্য আলোর মতো স্পষ্ট; ভালো ও মন্দকে বিভাজিত করে দেয় তার নিজস্ব স্বরূপ।
চরিত্রহননের মাধ্যমে কাউকে চাপে রাখা, জিম্মি করে ফায়দা লোটা কিংবা সুবিধা নেওয়া—এসব সভ্যতার আলোতে চরম অসভ্যতা। শাসকের স্ত্রী কিংবা শাসিতের স্ত্রী—চরিত্রের প্রশ্নে ভিন্নতা নেই। মানুষ দেবতাকে অস্বীকার করতে পারে, কিন্তু দেবত্বকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কাউকে অপছন্দ হলে তাকে পরিত্যাগ করুন; কিন্তু তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনকে বাজারের নিলামে তোলে বিষিয়ে তোলা অন্যায়। প্রেমিকার সঙ্গে গোপন আলাপন কিংবা স্ত্রীর সঙ্গে একান্ত কথোপকথন সমাজ বা রাজনীতির আলোচনার উপজীব্য হতে পারে না।
আজকের সমাজে সুস্থ মানুষের সংখ্যা কমছে; সহনশীলতা মানুষের স্বভাব থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন যেন জাতীয় জীবনও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে—কে কাকে কীভাবে পরাস্ত করবে, সেটিই যেন প্রধান লক্ষ্য। অন্যের চরিত্রহনন করে যারা নিজেদের চরিত্রবান প্রমাণ করতে চায়, তারাও অজান্তে দুশ্চরিত্রের বীজ বপন করছে। ভয় ও শঙ্কা মানুষের জিহ্বাকে সংযত করছে। অথচ স্বাধীন মতপ্রকাশ অন্যের স্বাধীনতা ব্যাহত করে ভোগ করা কখনোই সম্ভব নয়—এই সত্য অনেকেই মানতে চায় না। এমনকি কারো ভুল, অন্যায় বা পাপও স্রষ্টা গোপন রাখেন, যাতে সে অনুতপ্ত হয়ে সংশোধনের সুযোগ পায়।
কিন্তু মানুষ কারো গোপন কিছু জানলেই তা হাটবাজারে বিক্রি করে পৈশাচিক সুখ অনুভব করে। কারো দোষ পেলে তা গোপন রাখার বদলে বিনিয়োগ করে ফায়দা তোলে। অথচ এতে তারা পাপীর চেয়েও বড় পাপে নিমজ্জিত হয়—সে উপলব্ধি তাদের জাগে না। কারো বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ছড়ানো কিংবা গুজব রটানো নিঃসন্দেহে অন্যায়। কিন্তু সত্যিকার কোনো ত্রুটি থাকলেও তা গোপন রেখে সংশোধনে সাহায্য করা মহত্ত্বের পরিচয়। রাজনীতি কিংবা নেতা কোনো স্থায়ী পরিচয় নয়; স্থায়ী পরিচয় কেবল মানুষ ও মনুষ্যত্বের। তাই শুধু স্বার্থ চরিতার্থ করতে কারো ব্যক্তিগত জীবনকে জনসম্মুখে লাঞ্ছিত করলে সেটি বিনিময়বিহীন থাকবে না। আজ না হয় অন্যের পালা গেছে, কাল তোমার পালাও আসবে—এই বিশ্বাসই অকাট্য সত্য।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।