সম্প্রতি সিলেটের স্কলার্স হোম স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আজমান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনা আমাদের সকলকে নাড়িয়ে দিয়েছে। পরীক্ষায় ব্যর্থতার কারণে শিক্ষক কর্তৃক প্রকাশ্যে অপমানিত হওয়ার পর এক কিশোর আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এটি নিছক একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের এক ভয়াবহ বিকৃত রূপ। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীকে আঘাত, অপমান বা মানসিক চাপে ফেলেন, তবে তা কখনোই শিক্ষা নয়—এটি হয়ে ওঠে মানসিক নির্যাতন।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক মানবসমাজের সবচেয়ে প্রাচীন ও শ্রদ্ধার সম্পর্কগুলোর একটি। প্রাচীন গুরুকুল ব্যবস্থা থেকে শুরু করে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা পর্যন্ত শিক্ষক শুধু জ্ঞান দানকারীই নন, তিনি শিক্ষার্থীর পথপ্রদর্শক, মানসিক শক্তি জাগ্রতকারী এবং চরিত্র গঠনের কারিগর। শিক্ষকই শিক্ষার্থীর ভেতরে সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করতে পারেন এবং তাকে একজন সৎ, দক্ষ ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন।
একজন প্রকৃত শিক্ষক কেবল পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান দেন না, তিনি শিক্ষার্থীর জীবনদর্শন তৈরি করেন। তিনি শিক্ষার্থীর মনের অন্ধকার দূর করে আলো দেখান। পরীক্ষায় ব্যর্থতা কিংবা জীবনের বিপর্যয়গুলোকে কিভাবে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হয়, সে শিক্ষা-ও শিক্ষকের কাছ থেকেই পাওয়া যায়। শিক্ষক যদি শাসনের নামে অপমান করেন, তাহলে তা শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। অন্যদিকে ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও উৎসাহ একজন শিক্ষার্থীকে কঠিন সময়েও সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কেবল একতরফা নয়। শিক্ষার্থীকে তার শিক্ষকের প্রতি সম্মান, আস্থা ও শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। শিক্ষকের নির্দেশনা মেনে চলা, আন্তরিকভাবে পড়াশোনা করা এবং সৎ আচরণের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই একজন শিক্ষার্থীর কর্তব্য। এই পারস্পরিক সম্পর্কই শিক্ষাকে অর্থবহ করে তোলে।
আধুনিক যুগে শিক্ষা আর কেবল বই-পুস্তকের জ্ঞান অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কারণে শিক্ষার লক্ষ্য, ধরন ও প্রয়োগে এসেছে আমূল পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কেও এসেছে নতুন মাত্রা। একসময় শিক্ষককে কেবল কঠোর নিয়ন্ত্রক হিসেবে ভাবা হতো। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাদর্শে শিক্ষক আর শুধুমাত্র শাসনকারী নন, বরং তিনি একজন পরামর্শদাতা (Mentor), পথপ্রদর্শক এবং বন্ধুর মতো সহায়ক ব্যক্তি।
শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীর প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল হন, তবে শিক্ষার্থীরা খোলামেলা পরিবেশে শিখতে পারে। তারা প্রশ্ন করতে ভয় পায় না, নিজের মতামত প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না। এর ফলে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য—জ্ঞান অর্জন ও চিন্তার বিকাশ—বাস্তবায়িত হয়। অপরদিকে, যেখানে শিক্ষক কেবল ভয় দেখান বা শাস্তি দেন, সেখানে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতা হারায়, মানসিক চাপগ্রস্ত হয় এবং ভুলকে সংশোধনের সুযোগ হিসেবে দেখতে পারে না।
ভুল করা মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তেই পারে বা পরীক্ষায় ব্যর্থ হতে পারে। আধুনিক শিক্ষাদর্শে শিক্ষক সেই ভুলকে শাস্তির নয়, বরং শেখার সুযোগ হিসেবে দেখান। শিক্ষার্থীদের বোঝান—ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুনভাবে শুরু করাই আসল শক্তি। এভাবেই তারা আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হয়।
এছাড়া আধুনিক শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হয় শিক্ষার্থীর আগ্রহ, প্রতিভা ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীর মনের ভেতরকার সমস্যাগুলো বুঝতে পারেন এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দেন, তবে শিক্ষার্থীরা হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসী, সৃজনশীল ও দায়িত্বশীল। প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি মানবিকতা, সহমর্মিতা ও ভালোবাসাকে অগ্রাধিকার দেওয়াই আজকের শিক্ষাদর্শের মূল বৈশিষ্ট্য।
আজমান আহমেদের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে—শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কেবল পাঠদানের সীমায় আবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি মানবিক ও মানসিক বন্ধন। শিক্ষক যদি কেবল নম্বরের বিচারক হয়ে ওঠেন, তবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। কিন্তু যদি তিনি ভালোবাসা, ধৈর্য ও সহমর্মিতা দিয়ে শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলেন, তবে সেই শিক্ষার্থী হয়ে উঠতে পারে আত্মবিশ্বাসী, দায়িত্বশীল ও সফল নাগরিক।
আধুনিক বিশ্বে জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো মানুষের ভেতরে মানবিক গুণাবলি বিকাশ করা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, তবে তা শুধু একজন শিক্ষার্থীর নয়, পুরো সমাজের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনে। একজন স্নেহশীল ও প্রেরণাদায়ী শিক্ষক শিক্ষার্থীর জীবনকে আলোকিত করে তুলতে পারেন, আর একজন নির্দয় বা অসহিষ্ণু শিক্ষক তার জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারেন।
তাই শিক্ষাক্ষেত্রে আজ সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো শিক্ষকের মানসিকতার পরিবর্তন। শিক্ষকের কাছে শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়, মানবিক মূল্যবোধ, সহনশীলতা ও দায়িত্ববোধ থাকা আবশ্যক। শিক্ষার্থীদের সম্মান দেওয়া, তাদের সম্ভাবনাকে লালন করা এবং ব্যর্থতাকে সফলতার সোপান হিসেবে দেখতে শেখানো—এগুলোই প্রকৃত শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য।
অতএব, আজমানের মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের জন্য এক গভীর শিক্ষা। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক যদি মানবিকতা ও ভালোবাসার আলোয় উদ্ভাসিত হয়, তবে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, গোটা জাতি আলোকিত হবে। শিক্ষক যদি সত্যিকারের পথপ্রদর্শক হয়ে শিক্ষার্থীকে দিকনির্দেশনা দেন, তবে তারা হয়ে উঠবে আগামী দিনের যোগ্য নেতৃত্ব, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের প্রধান ভিত্তি।
—–
লেখক: কবি, সাংবাদিক, নাট্যকার ও গীতিকার বাংলাদেশ বেতার