সিলেটে বিএনপির ভোটের রাজনীতির নতুন মেটাফর ‘মেড ইন ছাত্রদল’ আওয়াজ বেশ জোরেশোরে বইছে। দাবি উঠেছে, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল থেকে তৈরি অথবা ছাত্রদলে নেতৃত্ব দেওয়া বিএনপি নেতাদের দলীয় মনোনয়ন মূল্যায়নের। এই মেটাফরে আওয়াজ ওঠার আগেই বাস্তবায়ন করেছে বিএনপির একসময়ের ভোটের জোটসঙ্গী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
প্রায় সাত মাস আগে ঘোষিত সিলেট বিভাগের চার জেলার ১৯টি সংসদীয় আসনে জামায়াতের দলীয় প্রার্থীদের রাজনৈতিক বৃত্তান্ত ঘেঁটে পাওয়া গেছে এ তথ্য। জামায়াত তার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় ও প্রতিষ্ঠাকালীন নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন করে স্থান দিয়েছে প্রার্থী তালিকায়। চার জেলার ১৯টি আসনের মধ্যে ১৬টিতেই ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতারা প্রার্থী হয়েছেন। এতে দলটির প্রান্তিক সমর্থকরাও খুশি হয়েছেন। বলা হচ্ছে, এবার ভোটের মাঠে শিবিরসজ্জিত জামায়াত।
হবিগঞ্জে শতভাগ ‘মেড ইন শিবির’
হবিগঞ্জ জেলার চারটি আসনে জামায়াতের দলীয় মনোনয়ন পাওয়া চারজনই ‘মেড ইন শিবির’। হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের প্রার্থী শাহজাহান আলী সিলেট মহানগর ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি সিলেট মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি পদে আছেন। হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনের প্রার্থী শেখ জিল্লুর রহমান আজমী হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের শুরা সদস্য। হবিগঞ্জ-৩ (সদর-লাখাই-শায়েস্তাগঞ্জ) আসনের প্রার্থী অধ্যক্ষ কাজী মহসিন আহমেদ হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারি। বর্তমানে তিনি জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি পদে আছেন। হবিগঞ্জ-৪ আসনের (চুনারুঘাট-মাধবপুর) প্রার্থী কাজী মাওলানা মুখলিছুর রহমান ছাত্রশিবিরের ‘সাথি’ (দলীয় ক্যাডারভিত্তিক দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ) ছিলেন। বর্তমানে তিনি জেলা জামায়াতের আমির।
সিলেটের ৬ আসনে ৫ জন
সিলেট জেলার ছয়টি নির্বাচনি আসনে ছয়জন প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজনই ছাত্রশিবির প্রজন্মের। সিলেট-১ আসনের দলীয় প্রার্থী মাওলানা হাবিবুর রহমান জেলা জামায়াতের আমির। তিনি সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ও মাদ্রাসা ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) আসনের প্রার্থী অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নান ছাত্রশিবির প্রজন্মের নন। তিনি সরাসরি জামায়াত করা নেতা। সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ) আসনের প্রার্থী দক্ষিণ সুরমা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান লোকমান আহমদ সিলেট মহানগর ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি ও সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
সিলেট-৪ (জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট-কোম্পানীগঞ্জ) আসনের প্রার্থী জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন ছিলেন সিলেট মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি। বর্তমানে তিনি জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি। সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনের প্রার্থী জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির আনোয়ার হোসাইন খান ছাত্রশিবিরের একজন প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা। তিনি অবিভক্ত সিলেট জেলা (সিলেট বিভাগের চার জেলা) ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে সিলেট জেলা আলাদা হওয়ার পর জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) আসনের প্রার্থী মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন জামায়াতের ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থীদের একজন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের দুই মেয়াদে (২০০০-২০০২) তিনি কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। তিনি বর্তমানে জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির।
সুনামগঞ্জের ৫টি আসনে ৪ জন প্রার্থীই শিবিরের
সুনামগঞ্জ জেলার পাঁচটি আসনের মধ্যে চারজন প্রার্থী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা। সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর-জামালগঞ্জ-ধরমপাশা-মধ্যনগর) আসনের প্রার্থী তোফায়েল আহমেদ খান ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক জেলা সভাপতি। বর্তমানে তিনি জামায়াতের জেলা আমির। সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে জামায়াতের ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থী মুহাম্মদ শিশির মনির ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি ছিলেন। আইন পেশায় পরিচিত মুখ শিশির মনির বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী। সুনামগঞ্জ-৩ (জগন্নাথপুর-শান্তিগঞ্জ) আসনের প্রার্থী অ্যাডভোকেট ইয়াছিন খান। তিনি সিলেটের এমসি কলেজ শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন। সুনামগঞ্জ-৪ (সদর-বিশ্বম্ভরপুর) আসনের প্রার্থী অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ সামস-উদদীন ছাত্রশিবিরের জেলা সভাপতি ছিলেন।
সুনামগঞ্জ-৫ (ছাতক-দোয়ারাবাজার) আসনের প্রার্থী আব্দুস সালাম আল মাদানী ছাত্রশিবির প্রজন্মের নন। তিনি ফুলতলি অনুসারী আল-ইসলাহ থেকে জামায়াতে যোগ দেওয়া নেতা।
মৌলভীবাজারের ৪ আসনে ৩
মৌলভীবাজার জেলার চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা। মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ী) আসনের প্রার্থী মাওলানা আমিনুল ইসলাম ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় বায়তুল মাল সম্পাদক। মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) আসনের প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার এম শাহেদ আলী সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্র সংসদে ছাত্রশিবিরের ভিপি ছিলেন। বর্তমানে তিনি বর্তমান জেলা আমির। মৌলভীবাজার-৩ (মৌলভীবাজার সদর-রাজনগর) আসনের প্রার্থী সাবেক জেলা আমির আব্দুল মান্নান সরাসরি জামায়াত করা নেতা। মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আব্দুর রব মৌলভীবাজার শহর শাখা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি।
জয়ের টার্গেট ‘এক থেকে একাধিক’
ভোটের রাজনীতিতে মর্যাদার আসন হিসেবে পরিচিত সিলেট-১। দলীয় প্রার্থী জয়ের ছক এ আসন থেকে শুরু করতে চায় জামায়াত। ‘মিথ’ রয়েছে, এ আসনে যে দলের প্রার্থী জেতেন, সেই দলই সরকার গঠন করে। ১৯৯১ সাল থেকে নির্বাচনি রাজনীতিতে ওই মিথটি প্রচলিত এবং সব কটি নির্বাচনে তার প্রতিফলনও দেখা গেছে। তবে জামায়াত বরাবর মিথ এড়িয়ে চলছে। ১৯৯১ সাল থেকে জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল থেকে জানা গেছে, সিলেট-১ আসনে একক প্রার্থী হিসেবে জামায়াত সর্বশেষ নির্বাচন করেছিল ১৯৯৬ সালে। এর আগে ১৯৯১ সালে প্রথম একক প্রার্থী দিয়েছিল জামায়াত। বর্তমানে কেন্দ্রীয় আমির ডা. শফিকুর রহমান ৯১ ও ৯৬ সালে প্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী খন্দকার আব্দুল মালিক।
জামায়াত প্রার্থী তৃতীয় হয়েছিলেন। প্রাপ্ত ভোট ছিল ১৭ হাজার ৫১৭। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বিজয়ী হয়েছিলেন। আর জামায়াত প্রার্থী ডা. শফিকুর রহমান চতুর্থ হলেও ৯১ সালের তুলনায় ভোট বেড়েছিল। প্রাপ্ত ভোট ছিল ১৮ হাজার ২৯। এরপর ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে চারদলীয় জোটের হয়ে নির্বাচন করায় একক প্রার্থী নিয়ে জামায়াতকে আর নির্বাচনি মাঠে দেখেননি ভোটাররা।
১৯৯৬ সালে সিলেট-৫ আসনে জয়ী আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মাওলানা ফরিদ উদ্দিন আহমদ। ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে মাওলানা ফরিদ বিজয়ী হন। সিলেট অঞ্চলে সেটাই ছিল জামায়াতের প্রার্থীর প্রথম সংসদীয় আসন জয়।
১৯ আসনের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত কতটি আসনে জয়লাভ করতে পারে, এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দায়িত্বশীল এক নেতা জানান, বাংলাদেশের অন্যান্য বিভাগীয় বা অঞ্চলের চেয়ে সিলেট পিছিয়ে রয়েছে। চট্টগ্রাম বা রাজশাহী অঞ্চলের মতো সিলেট ও ময়মনসিংহ অগ্রসর হতে পারেনি। এ কারণে জয়ের টার্গেট আর ভোটের মাঠের বাস্তবতায় ফারাক ধরা পড়তে পারে। এমনটি হলে কেন্দ্রীয় আমিরকে তার নিজ এলাকার (কুলাউড়া) আসনে এনে জয়ের টার্গেট ফিলাপ করা যেতে পারে।
জয়ের টার্গেট কতটি আসনে? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘চারটি আসনে ইতোমধ্যে জয়ের আবহ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে অগ্রগামী সুনামগঞ্জ ও সিলেটের দুটি আসন। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থী (বিএনপির প্রার্থী) দেখে আগামীতে এ সংখ্যা বাড়বে বৈ কমবে না। এতে করে জয়ের টার্গেট এক থেকে একাধিক হবে, এটা নিশ্চিত।’
‘আগের মতন না পরিবর্তন’
জামায়াত দলীয় প্রতীক নিয়ে সর্বশেষ নির্বাচন করেছিল ১৯৯৬ সালে। এরপর ২০০১ ও ২০০৮ সালে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করেছে। এর আগে ১৯৯১ সালে করেছিল এককভাবে নির্বাচন। দীর্ঘ বিরতির পর, এবার জোট ছাড়া দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে এবং দলটির নেতারা জানাচ্ছেন যে, প্রথম দিকে তারা ভালো সাড়া পাচ্ছেন।
কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগরীর আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বলেন, ভোটার এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে জামায়াত সম্পর্কে ইতিবাচক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। তাঁর মতে, মানুষ এখন পরিবর্তনের প্রত্যাশা করছে এবং আগের মতো পরিস্থিতি চায় না।
সিলেট-১ আসনে ১৯৯১ ও ১৯৯৬-এর পর জামায়াত একক প্রার্থী না দিলেও জোটগতভাবে নির্বাচনি মাঠেই ছিল। এরপর রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রে প্রচারবিহীন থাকলেও জামায়াত কখনো রাজনীতি বা ভোটের মাঠ ছাড়া ছিল না। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে এবার মাঠে জামায়াত বাধাহীন বলা যায়। আগের মতন না পরিবর্তন- এ রকম এক আগ্রহের কেন্দ্রে এখন জামায়াত।’
‘মেড ইন শিবির’ মেটাফরে প্রার্থিতায় প্রান্তজনের মতামত জানতে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শ্যামারচর ও সিলেটের বিয়ানীবাজারের মুড়িয়া এলাকার বাসিন্দা দুজন ভোটার জানিয়েছেন, তারা প্রার্থী দেখে জামায়াত সমর্থক হয়েছেন। দুজনের অভিন্ন ভাষ্য, ‘এবার ভোটের মাঠে পুরাই শিবিরসজ্জিত জামায়াত। অতীত নিয়া ঘাঁটাঘাঁটির আর সুযোগ নাই!’ সূত্র: খবরের কাগজ