শেখ হাসিনা নির্বাচনে অযোগ্য
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলেই তিনি আর নির্বাচন করার যোগ্য হবেন না। এ ছাড়া জনপ্রতিনিধি হয়ে থাকলে সেই পদে থাকার যোগ্যতাও হারাবেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আইন এক বছরের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো সংশোধন করে এই বিধান যুক্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ভোটে অংশ নেওয়ার সব সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল।
১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে ২০ সি নামে একটি নতুন ধারা যোগ করার প্রস্তাবে গত ৪ সেপ্টেম্বর অনুমোদন দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে গত সোমবার রাতে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়েছে, যার শিরোনাম ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (তৃতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’।
২০ সি ধারায় বলা হয়েছে – কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইসিটি আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বা ওই পদে বহল থাকার অযোগ্য হবেন। একইভাবে তিনি যে কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সদস্য, কমিশনার, চেয়ারম্যান, মেয়র বা প্রশাসক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার বা বহাল থাকার অযোগ্য হবেন। এমনকি প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার বা অন্য কোনো সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ারও অযোগ্য হবেন তিনি। যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালের রায়ে অব্যাহতি বা খালাস পান, তাহলে এ অযোগ্যতা তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে অভিযুক্ত কেউ যেন বিচারাধীন অবস্থায় রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্বে থাকতে না পারেন, তা নিশ্চিত করাই আইন সংশোধনের মূল উদ্দেশ্য।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক আমাদের সময়কে বলেন, বিচার করে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আইন তাঁকে নির্দোষ মনে করে। বিচার করে দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁকে বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু অভিযোগ এলে তাঁকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি ১৮০০ সালের আগের আইনে ছিল। আমরা এখন মধ্য যুগে ফিরে যাচ্ছি। এই আইনকে বেসিক আইনের মূলনীতির বরখেলাপ বলে মনে করেন তিনি।
শাহদীন মালিক বলেন, ধরুন একটি আসনে দুজন প্রার্থী। এক প্রার্থী অন্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার অভিযোগ দাখিল করল, সেটা সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক। তখন একজনের প্রার্থিতা বাতিল হলে অপরজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাবেন। তিনি প্রশ্ন রাখেনÑ একটা অভিযোগ দায়ের করলেই কেউ যদি অযোগ্য হয়ে যায়, তাহলে বিচার প্রক্রিয়ার দরকার কী?
এ আইন প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এ
আরেকটি সংশোধন আনা হয়েছে। এ সংশোধনীর মূল বিষয় হলোÑ কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়, তাহলে তিনি বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্য হবেন না। অর্থাৎ, তিনি জাতীয় নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবেন না। একইভাবে সেই ব্যক্তি কোনো সরকারি চাকরি করতে পারবেন না।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। সেদিন দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। অনেকেই বিদেশে বা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাঁদের অধিকাংশই এখন বিভিন্ন হত্যা মামলার আসামি।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমন-পীড়নকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে সেই আদালতেই এর বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আন্দোলন দমনে ১ হাজার ৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচ অভিযোগ আনা হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।
গত ১০ মে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের পথ তৈরি করা হয়েছে। সেই বিচার শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। নিবন্ধন স্থগিত হওয়ায় শেখ হাসিনার দলীয়ভাবে নির্বাচন করার সুযোগ আগেই বন্ধ হয়েছিল। এখন ট্রাইব্যুনাল আইনে নতুন ধারা যুক্ত হওয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার পথও বন্ধ হলো।