ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রাথমিক খসড়া তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে এনেছে বিএনপি। দেশের ৯টি বিভাগকে ভাগ করে নিয়ে আগ্রহীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এই তালিকা প্রণয়নের কাজ করছেন দলের শীর্ষ পাঁচ নেতা। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ উচ্চ পর্যায়ের এই টিমে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির আরও তিনজন নেতা।
বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতা ও সাক্ষাৎদাতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থী নির্ধারণের প্রাথমিক খসড়া তালিকার কাজ শেষ দিকে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সিলেট ও খুলনা বিভাগ, নজরুল ইসলাম খান রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন কুমিল্লা ও বরিশাল বিভাগ এবং সালাহ উদ্দিন আহমেদ ময়মনসিংহ বিভাগের আগ্রহী প্রার্থীদের সঙ্গে পর্যালোচনা করে খসড়া তালিকা প্রস্তুত করছেন।
সাক্ষাৎ করে আসা কয়েকজন আগ্রহী প্রার্থী জানান, আলোচনায় প্রত্যেক আসনের আগ্রহীদের সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কথা বলেছেন। জানাচ্ছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা। তবে খসড়া তালিকা প্রণয়ন করলেও চূড়ান্ত তালিকা ঘোষণায় ভিন্ন কৌশল নেবে বিএনপি।
দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা প্রার্থীদেরকে দলের নির্দেশনা জানিয়ে উল্লেখ করেছেন— প্রত্যেক আসনে একজনই চূড়ান্ত মনোনয়ন পাবেন। এক্ষেত্রে আগ্রহীরা যেন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দিকেও মনোযোগী হন। বিশেষ করে আগামী নির্বাচন দলের দীর্ঘদিনের চ্যালেঞ্জে পরিণত হওয়ায়, বিদ্রোহী প্রার্থিতা নিয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন তারেক রহমান।
গত কয়েকদিনে সাক্ষাৎ করে আসা একাধিক আগ্রহী প্রার্থী জানিয়েছেন, আগ্রহীর সংখ্যা একাধিক হলেও দল থেকে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, তাকে বিজয়ী করতে পুরো কার্যক্রম সমন্বয় করতে হবে। এক্ষেত্রে আসনের দাবিদার শক্ত প্রার্থীদেরকে পরবর্তী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মেয়র, পৌর মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব, সরকারে আসার সুযোগ হলে নতুন দায়িত্ব প্রদানসহ নানা ধরনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সোমবার (১৩ অক্টোবর) স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘এটা তো খুবই স্বাভাবিক। দিজ ইজ গুড। বিএনপি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, একের অধিক প্রার্থী থাকবে, নিজেদের মধ্যে উৎসাহ, উদ্দীপনা, আগ্রহ, প্রতিযোগিতা থাকাটা খুব স্বাভাবিক। এখন তাদের মধ্য দিয়ে যাকে ফিট মনে করা হয়, কে উইন করতে পারেন, গ্রহণযোগ্যতা যার বেশি, তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। অন্যরা তাকে সহযোগিতা করবেন।’’
দলের একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘এবার প্রার্থী নির্ধারণে তরুণদের প্রাধান্য থাকবে আশা করা যায়। প্রার্থীদের তালিকা প্রণয়নে প্রস্তুতির কাজ চলছে।’’
চূড়ান্ত প্রার্থী নির্ধারণে সময় নেবে বিএনপি
তারেক রহমানসহ সিনিয়র পাঁচ নেতার সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ এই সেল প্রাথমিকভাবে আলোচনার ভিত্তিতে একটি খসড়া তালিকা তৈরি করবেন। এই তালিকা স্থায়ী কমিটিতে আলোচনার পর চূড়ান্ত করা হবে, বলে জানান কমিটির একজন নেতা।
তিনি উল্লেখ করেন, অনেককেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সরাসরি সবুজ সংকেত দিয়েছেন। প্রার্থী নির্ধারণেও থাকবে নানা কৌশল। কয়েক স্তরে সাজানো হবে তালিকা। একটি তালিকা হবে দলের আগ্রহীদের সমন্বয়ে। এরপর স্থায়ী কমিটিতে যুক্তি-তর্ক শেষে হবে যোগ-বিয়োজন। এরপর যুগপতে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আসন বণ্টনের আলোচনা শেষে করা হবে আরেকটি তালিকা।
প্রথম দিকে আগ্রহীদের নাম ও জটিল আসনগুলোতে একাধিক প্রার্থীর নাম রাখবে বিএনপি। বিশেষ করে শেষ মুহূর্তে কাকে বাদ দেওয়া হবে, সেটি নির্ভর করবে তারেক রহমানের ওপর। তিনি নির্বাচনি কৌশল বিবেচনায় নিয়ে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন।
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। তিনি জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ঢাকার আসনগুলোতে প্রার্থী নির্ধারণে তারেক রহমান নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জানিয়ে দেন।
দলের নেতৃত্বের দীর্ঘদিনের অনুশীলনের কথাও উল্লেখ করেন স্থায়ী কমিটির এই নেতা। তিনি মনে করেন, বিগত সময়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হতো। এ বছরও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারেক রহমানকেই দল দায়িত্ব দেবে। এক্ষেত্রে নতুনত্ব আসতে পারে বেগম জিয়ার কোনও বিশেষ সুপারিশের মাধ্যমে। কোনও কোনও আসনে তিনি নিজে নিজের কোনও পছন্দের কাউকেও মনোনয়ন দিতে পারেন।
জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘এইটা তো আমরা দলের কাজ করছি, বাইরে দেওয়ার জন্য না। দলের সংসদীয় বোর্ডে, চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেওয়া হবে। তিনি আবার সংসদীয় বোর্ডে তুলবেন।’’
দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির চূড়ান্ত মনোনয়নের আগে যুগপতে যুক্ত ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে সামনের সারিতে থাকা কোনও কোনও পক্ষ, ব্যক্তিকেও আমলে নেবেন শীর্ষ নেতৃত্ব। ইতোমধ্যে নানা তরফে আলোচনায় বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করবে কারা এবং বিএনপির বিরুদ্ধ পক্ষ হয়ে কারা করবে, এই সমীকরণ চলছে।
দলের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু মনে করেন, নির্বাচনি সমীকরণে এখনও প্রবেশ করেনি বাংলাদেশ। আরও সময় লাগতে পারে। সমীকরণে আরও পরিবর্তন, নতুনত্ব থাকতে পারে।
যুগপতে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কয়েকজন শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক জেএসডিকে ৩টি, গণসংহতি আন্দোলনকে ১টি, নাগরিক ঐক্যকে ২টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিকে ১টি, ভাসানী জনশক্তি পার্টিকে ১টি, গণঅধিকার পরিষদকে ২টি, এনডিএমকে ১টি, গণফোরামকে ২টি, ১২ দলীয় জোটকে ৫-৬টি আসন দেওয়ার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে উভয় তরফে আলোচনা চলছে।
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য মনে করেন, আগামী নির্বাচনে মূল চ্যালেঞ্জ জামায়াতকে ঠেকানো। বিশেষ করে বিরোধী দলের আসনে জামায়াত যেন না বসতে পারে, সে বিষয়টিও বিএনপির মধ্যে সূক্ষ্মভাবে আলোচনায় রয়েছে।
এক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিকে অন্তত ৪-৫টি আসনে বিজয়ী হওয়ার মতো শক্তি জোগাতে চায় বিএনপি। নতুন এই দলটির শীর্ষ অন্তত তিনজনকে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী করতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে চায় বিএনপি। এ বিষয়ে কোনও নেতাই উদ্ধৃত হতে সম্মত হননি। স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য উল্লেখ করেছেন, বিষয়টি নিয়ে তিনটি পক্ষ তৎপর। এখনও কোনও সুরাহা না হওয়ায় মন্তব্য করা সহজ নয়।
যুগপৎসঙ্গীদের নিয়ে নির্বাচনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে জবাবে স্থায়ী কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘আরেকটু পরে গেলে জিনিসটা… এখনও পর্যন্ত এটা কোনও ফরম্যাটে যায়নি। ডিসকাশনের পর্যায়ে আছে, সব লেবেলেই। পার্টি একটা বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধের অ্যাপ্রোচ করতে পারে।’
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য জানান, আসন চূড়ান্ত করার কোনও সময় এখনও আসেনি। কোন দল কত আসন পাবে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন প্রার্থী জিতবে। এক্ষেত্রে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা, নির্বাচনের ধরন, অংশগ্রহণমূলক কিনা— এসব বিষয় সেটেলড হলেই স্পষ্ট হবে। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত প্রার্থী প্রত্যাহারের আগে পর্যন্ত অনেকেই আসন নিশ্চিত হতে পারবে না।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন