রাজনীতিতে সবুজ সংকেত: কখনও সত্য, কখনও গুজব, কখনও কৌশল

সবুজ মানে ‘চলো’। ট্রাফিকের ভাষায় এটি নিরাপত্তা, নিয়ম ও শৃঙ্খলার প্রতীক। লাল আলো থামায়, হলুদ সাবধান করে, আর সবুজ নির্দেশ দেয়—পথ পরিষ্কার, সামনে এগিয়ে যাও। কিন্তু রাজনীতিতে এই সবুজ রঙের অর্থ অনেকটাই বদলে গেছে। এখন এটি আর শুধু রাস্তার সংকেত নয়; এটি ক্ষমতার, অনুমতির, কিংবা গোপন সম্পর্কের ইঙ্গিত। বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতিতে “সবুজ সংকেত” শব্দটি এক অদৃশ্য অথচ প্রচণ্ড শক্তিশালী রাজনৈতিক ভাষায় পরিণত হয়েছে।

নির্বাচন ঘনিয়ে এলে এক আসনে একই দলের একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়ে ওঠেন। দল এখনো কারও নাম ঘোষণা করেনি, কিন্তু কেউ কেউ আগেভাগেই প্রচারণা শুরু করে দেন। তাদের যুক্তি—“আমি সবুজ সংকেত পেয়েছি।” চায়ের দোকান থেকে শুরু করে ফেসবুকের স্ট্যাটাস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এই খবর। ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মীরাও বলেন, “উচ্চপর্যায় থেকে অনুমতি এসেছে।” এক মুহূর্তেই গুজব পরিণত হয় ‘অর্ধ-সরকারি সত্যে’। সাধারণ মানুষ ধরে নেয়, যিনি “সবুজ সংকেত” পেয়েছেন, চূড়ান্ত মনোনয়নও নিশ্চয় তাঁরই হবে।

এই “সবুজ সংকেত” আসলে এক ধূসর অঞ্চলের জন্ম দিয়েছে—যেখানে সত্য, গুজব আর কৌশল একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়। রাজনীতির এই অদৃশ্য প্রপঞ্চে অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন গুজব রটান, যাতে তাঁদের প্রভাব ও অবস্থান জোরালো দেখায়। এক ধরনের ‘মনস্তাত্ত্বিক প্রপাগান্ডা’ তৈরি হয়—যিনি আগে দাবি করেন যে তিনি “সংকেত” পেয়েছেন, তিনি মাঠে অনেকটাই এগিয়ে যান। কর্মীদের মনোবল বাড়ে, প্রতিদ্বন্দ্বীরা হতাশ হয়, ভোটাররা মনে করেন—এই লোকটিই ‘দলের লোক’। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাও সতর্ক হয়ে যান, যেন ভুল করে প্রকৃত প্রার্থীকে বিরক্ত না করেন। এভাবেই “সবুজ সংকেত” হয়ে ওঠে এক ধরনের অঘোষিত প্রশাসনিক ভাষা।

দলীয় রাজনীতির যোগাযোগ প্রায়ই স্পষ্ট নয়; বরং ইঙ্গিতনির্ভর। “উর্ধ্বতন পর্যায়ে আলোচনা চলছে”, “নেতা খুশি হয়েছেন”, “নাম গেছে সেলেকশন বোর্ডে”—এইসব অস্পষ্ট বাক্যই মাঠে একধরনের ‘সংকেতের রাজনীতি’ তৈরি করে। অনেক সময় দল ইচ্ছাকৃতভাবেও অস্পষ্টতা রেখে দেয়, যাতে প্রার্থীরা সক্রিয় থাকে, কর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বজায় থাকে। এই প্রেক্ষাপটে “সবুজ সংকেত” এক অনির্দিষ্ট, কিন্তু কার্যকর শব্দ—যার মানে জানে না কেউ, তবু সবাই মানে তা মেনে নেয়।

মনোনয়ন প্রক্রিয়া যত জটিল, “সংকেত” ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মনোনয়ন শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক বিষয়ও বটে। প্রচার চালাতে লাগে বিপুল অর্থ, মানবসম্পদ ও সময়। যিনি দাবি করেন যে তিনি “সবুজ সংকেত পেয়েছেন”, তিনি সহজেই অর্থ সংগ্রহ, প্রচারণা ও মানবসম্পদের জোগান পেয়ে যান। তাঁর ওপর ভরসা করে অনেকে বিনিয়োগ করেন, কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন—এই বিনিয়োগ বৃথা যাবে না। এইভাবেই “সবুজ সংকেত” হয়ে ওঠে অর্থনৈতিক বৈধতার প্রতীক; যেন বলা যায়—“আমি অনুমতি পেয়েছি, তাই খরচ করছি।”

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতা-কেন্দ্রিক আনুগত্যের সংস্কৃতি এত প্রবল যে কেউ যদি ঘোষণা দেন “সংকেত পেয়েছি”, তা চ্যালেঞ্জ করার সাহস খুব কম মানুষেরই থাকে। গুজব ক্রমে পরিণত হয় সত্যে। এমনকি পরবর্তীতে যদি তিনি মনোনয়ন না-ও পান, তখনও বলা হয়—“শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলেছে।” এই সংস্কৃতি দলীয় রাজনীতির অভ্যন্তরীণ অস্বচ্ছতা, প্রভাবশালী কেন্দ্রের ভয় এবং গণতন্ত্রহীন সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার প্রতিফলন।

রাজনীতিতে সংকেতের এই মানসিক খেলা বহু পুরোনো। উপনিবেশিক আমল থেকেই প্রশাসনিক ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ছিল ‘ইঙ্গিত’ বা ‘আশীর্বাদ’-এর ধারণা। স্বাধীন বাংলাদেশেও এই সংস্কৃতি টিকে গেছে। এখনকার দলীয় রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতিটি নীরবতা, প্রতিটি হাসি, এমনকি ফোন না ধরাও একধরনের সংকেত হিসেবে ব্যাখ্যা হয়। কখনও ইতিবাচক, কখনও সতর্কবার্তা। আর এখানেই “সবুজ সংকেত” শব্দটির সাংস্কৃতিক শক্তি—এটি প্রকাশ্য কোনো অনুমতি নয়, বরং গোপন এক সম্পর্কের প্রকাশ।

কিন্তু এই সংস্কৃতির ভয়াবহ দিক হলো—এটি গণতন্ত্রের ভেতর গোপন রাজনীতি সৃষ্টি করে। প্রকৃত রাজনৈতিক যোগ্যতা বা জনসমর্থন নয়, বরং ‘কাকে উপরের লোকজন পছন্দ করে’—এটাই হয়ে ওঠে নির্ধারণের মাপকাঠি। যারা সত্যিকারের জনপ্রিয় কিন্তু ‘সংকেত’ পাননি, তাদের জায়গা হয় প্রান্তে। ফলে রাজনীতি হয়ে যায় সংকেত-নির্ভর প্রতিযোগিতা, যেখানে সিদ্ধান্ত আসে উপরে, মাঠ কেবল অনুসরণ করে।

“সবুজ সংকেত” এক অর্থে আত্মবিশ্বাসের প্রদর্শনও বটে। কেউ যদি নিজের প্রার্থীতা নিশ্চিত না হয়েও ঘোষণা দেন যে তিনি সংকেত পেয়েছেন, সেটি একধরনের ‘পলিটিক্যাল পারফরম্যান্স’। এটি জনগণের সামনে নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠার কৌশল। যে রাজনীতিতে প্রতিদিন অবস্থান বদলায়, সেখানে সংকেত একধরনের মনস্তাত্ত্বিক ঢাল, যার আড়ালে প্রার্থী নিজের স্থান রক্ষা করতে চান। এভাবেই বাংলাদেশে রাজনীতি ধীরে ধীরে নীতির রাজনীতি থেকে সংকেতের রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে।

ট্রাফিক সিগন্যালে সবুজ মানে—সবাই এগিয়ে যেতে পারবে, পথ উন্মুক্ত। কিন্তু রাজনীতির “সবুজ সংকেত” মানে—পথ খোলা কেবল একজনের জন্য, বাকিদের জন্য থামার নির্দেশ। শব্দটি তাই এক অদ্ভুত রূপান্তর পার করেছে—নিয়মের প্রতীক থেকে ক্ষমতার প্রতীকে, শৃঙ্খলার প্রতীক থেকে গোপন অনুমতির প্রতীকে।

আজকের বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতিতে “সবুজ সংকেত” কেবল একটি বাক্য নয়, বরং এক সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক প্রপঞ্চ। এটি এমন এক অদৃশ্য যন্ত্র, যা একদিকে আশা ও প্রতিযোগিতা তৈরি করে, আবার অন্যদিকে বিভ্রান্তি ও গুজব ছড়ায়। এই সংকেতের সংস্কৃতি রাজনীতির স্বচ্ছতা নষ্ট করছে, দলীয় গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে, আর জনগণের চোখে রাজনীতিকে পরিণত করছে গুজব ও প্রভাবের খেলায়।

যিনি বলেন, “আমি সবুজ সংকেত পেয়েছি”, তিনি কেবল প্রার্থী নন—তিনি গল্পকারও। তিনি এমন একটি গল্প বলেন, যা মানুষ শুনতে চায়: তাঁর নেতৃত্ব বৈধ, ভবিষ্যৎ নিশ্চিত, ভাগ্য উন্মুক্ত। কিন্তু বাস্তবে, ট্রাফিকের মতো রাজনীতিতেও সবুজ সংকেত সবসময় নিরাপদ নয়—কখনও তা গন্তব্যে পৌঁছে দেয়, আবার কখনও নিয়ে যায় নতুন জটিল মোড়ে।
লেখকঃ সাংবাদিক

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন